বাংলাদেশকে যদি চোখ বন্ধ করে কল্পনা করি, মনে হবে রূপকথার এক বিশাল ছবি। সবুজ মাঠ, নদীর বুকে সোনালি রোদ, বর্ষার বৃষ্টিতে কাদামাখা পথ—যেন কোনো শিল্পীর তুলিতে আঁকা এক অমলিন দৃশ্যপট। কিন্তু এই সৌন্দর্যের আড়ালে, প্রতিটি গলির বাঁকে, প্রতিটি মানুষের চোখের গভীরে লুকিয়ে আছে অসংখ্য অজানা গল্প। গল্পগুলো বইয়ের পাতায় জায়গা পায় না, পত্রিকার শিরোনামে আসে না, টেলিভিশনের পর্দায়ও দেখা মেলে না। তবুও সেই গল্পগুলো প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে—আমাদের চারপাশেই, নীরবে, অবিরাম।
এগুলো সেই গল্প, যারা জীবনের সাথে প্রতিদিন যুদ্ধ করে, না থেমে, না হেরে। তাদের কেউ ভোরবেলায় হাতে বই নিয়ে স্কুলে যায়নি, কারণ বইয়ের বদলে হাতে উঠেছে পরিবারের দায়ভার; কেউ কলম ধরার বয়সে ধরেছে হাতুড়ি, কোদাল, সেলাই মেশিন কিংবা চুলার খুন্তি। জীবন তাদের খুব তাড়াতাড়ি বড় করে দিয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়—তাদের চোখের ভেতর এখনও ঝিলিক মারে স্বপ্নের আলো, যেন রাতের আকাশে জ্বলজ্বল করা অদম্য এক তারা।
তেমনই এক কিশোরী—জয়ী। নামের মতোই যার ভেতর লুকিয়ে আছে জেতার তীব্র বাসনা। জয়ী হয়তো কোনো শহরের আলোঝলমলে রাস্তায় বড় হয়নি; তার বাড়ি হয়তো নদীর ধারে কুঁড়েঘর, কিংবা গ্রামবাংলার মাটির উঠোনে। বাবার অসুস্থতা আর সংসারের ভার তার শৈশবটাকে বইয়ের পাতার বাইরে ঠেলে দিয়েছে। ভোরের প্রথম আলো ফুটতেই সে নেমে পড়ে কাজের মাঠে—কখনও ক্ষেতের ধান কাটা, কখনও গৃহস্থালির কাজ, আবার কখনও অন্যের বাড়িতে সাহায্য করা। তবুও, দিনের শেষে আকাশের দিকে তাকিয়ে সে ভাবে—“একদিন আমিও অন্যরকম জীবন পাবো।”
তার স্বপ্ন ছোট নয়। সে চায় পড়াশোনা শেষ করে নিজে দাঁড়াতে, নিজের হাতে সংসারের দায়িত্ব নিতে, ভাইবোনদের পড়াতে। চারপাশের মানুষ যখন বলে, “মেয়েদের জন্য এসব স্বপ্ন খুব বড়,” জয়ী তখন মনে মনে বলে, “স্বপ্নের কোনো লিঙ্গ নেই, কেবল সাহস লাগে।”
জয়ীর এই লড়াই শুধু তার একার নয়—এ আমাদের দেশের হাজারো তরুণ-তরুণীর প্রতিচ্ছবি। যারা দারিদ্র্য, প্রতিকূলতা আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মাঝেও হার মানতে শেখেনি। তারা প্রমাণ করেছে, মানুষের ইচ্ছাশক্তি সবচেয়ে বড় অস্ত্র; সুযোগ হয়তো সবাই পায় না, কিন্তু সাহস থাকলে পথ তৈরি করাই যায়।
আমাদের সমাজে এরা নীরব নায়ক—যারা শিরোনামে আসে না, পুরস্কার পায় না, তবুও প্রতিদিনের ঘামে, কষ্টে আর আত্মত্যাগে এই দেশকে টিকিয়ে রাখছে। তাদের গল্প বলা হয় না, অথচ তাদের গল্পই আমাদের শেখায়, টিকে থাকা মানে কী, স্বপ্নের পেছনে লড়াই চালিয়ে যাওয়া মানে কী।
তাই আসুন, জয়ীর গল্প পড়ি না শুধু—অনুভব করি। কারণ প্রতিটি জয়ী, প্রতিটি অদম্য মানুষের ভেতরেই লুকিয়ে আছে আমাদের সবার প্রেরণা। হয়তো একদিন, এই নীরব গল্পগুলোই বদলে দেবে দেশের চেহারা, আর আমরা বুঝব—সত্যিকারের উন্নয়ন শুধু বড় বড় প্রোজেক্টে নয়, বরং এমন হাজারো ছোট ছোট স্বপ্ন পূরণের ভেতরেই লুকিয়ে আছে।
শরতের নরম রোদ জানালার ফাঁক দিয়ে এসে জয়ীর অঙ্ক খাতার ওপর আলতো করে পড়ছিল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে, বাইরের পৃথিবী তখন কর্মব্যস্ততার আবেশে ঝিমিয়ে পড়ছে। কিন্তু জয়ীর কাছে এই আলো যেন এক উপহাস, এক নির্মম বাস্তবতার কশাঘাত। অক্ষরগুলো তার চোখের সামনে এক এক করে দুলছে, যেন তারা অবাধ্য প্রজাপতির মতো উড়তে উড়তে এক অনির্দিষ্ট গন্তব্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। ওর চোখে তখন কেবলই বাবার ক্লান্ত মুখখানা ভাসছিল। গ্রামের দিনমজুর করিম শেখ, তার বাবা, আজ সারাদিন অন্যের জমিতে ধান কেটেছেন; পিঠে আর কোমরে একটানা ব্যথা, প্রতিটি শিরা-উপশিরা যেন যন্ত্রণায় জানান দিচ্ছে তার সীমাহীন পরিশ্রমের কথা। তিনি যখন রাতে ফেরেন, তখন তার মুখে ফুটে ওঠে চরম ক্লান্তি; কপালে জমাট বাঁধা ঘামের রেখাগুলো যেন এক দীর্ঘ নীরব উপাখ্যান শোনায়। সারা দিনের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের স্বল্প আয় দিয়ে কেবল চাল, ডাল, তেল কেনা হয়েছে, আর বাকি যৎসামান্য টাকা দিয়ে শয্যাশায়ী দাদী ও চোখে ভালো দেখতে না পাওয়া দাদার ওষুধ কিনতে হবে। তাদের ছোট্ট মাটির ঘরটা, যার ছাদ হয়তোবা এক পশলা বৃষ্টিতেও ফোঁটা ফোঁটা জল চুঁইয়ে দেয়, সেই ঘর যেন প্রতি মুহূর্তে জানান দিচ্ছিল, ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’—এমন এক চরম আর্থিক বাস্তবতার করুণ সুর। এই অভাব যেন এক অদৃশ্য দৈত্যের মতো তাদের চারপাশে লেপ্টে আছে, যার থাবার ছোবলে প্রতিটি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসে।
জয়ীর পাঁচ বোনের মধ্যে সে-ই সবার বড়। শিমুল ক্লাস ফোরে, সোনা সবে অক্ষর জ্ঞান লাভ করেছে, আর মণি ও রীনা এখনো হাঁটি হাঁটি পা পা করছে। শিমুল, সোনা, মণি ও রীনা—ছোট এই চার বোনের ভবিষ্যতের স্বপ্ন যেন তার নিজেরই চোখে আটকে থাকে। জয়ী যখন নিজের অঙ্ক খাতা নিয়ে বসে, তখন তার কানের কাছে ভেসে আসে শিমুলের কলকাকলি, সোনার নতুন আবদার, মণির নীরব কান্না আর রীনার ভাঙা খেলনার সেই অস্পষ্ট শব্দ। এই শব্দগুলো তার কানের পর্দায় নয়, বরং হৃদয়ে গিয়ে আঘাত করে। তার মনে হয়, তারা যেন তার দিকেই তাকিয়ে আছে, তাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তার প্রতিটি পদক্ষেপের ওপর। বাবা প্রায়শই দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নিচু করে বলেন, "জয়ী, তোকে আমরা পড়াতে পারি না। আমাদের সামর্থ্য নেই। কিন্তু তুই আমাদের সব আশা।" জয়ী জানে, বাবার এই কথাগুলো শুধু মুখের কথা নয়। এটি তাদের পরিবারের চরম আর্থিক বাস্তবতার এক নির্মম প্রতিচ্ছবি, এক অসহায় পিতার আত্মগ্লানি। এই কথাগুলো তার বুকে তীরের মতো বিঁধে, অথচ মুখে ফোটে না একটিও প্রতিবাদী শব্দ। শুধু নীরব সংকল্পের এক অদম্য শিখা জ্বলে ওঠে তার চোখে, যেন সে মনে মনে নিজেকেই বলে, "আমাকে পারতেই হবে। আমার স্বপ্ন শুধু আমার নয়, এ যে আমার পরিবারের প্রতিটি সদস্যের স্বপ্ন!"
পাশের ঘরে মা ফরিদা বেগম অসুস্থ হয়ে শুয়ে আছেন, তার শরীরটা যেন এক ভাঙা নৌকার মতো দুলছে জীবন-মৃত্যুর ফারাকে। তার হাতের সেলাই মেশিনটা কয়েক বছর ধরে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে, মরিচার আস্তরণে ঢাকা পড়ে গেছে তার সোনালী অতীত, যেন এক জীবন্ত স্মৃতিস্তম্ভ। একসময় এই মেশিনটাই ছিল তাদের পরিবারের একমাত্র সম্বল, মা এই মেশিন চালিয়েই পাঁচটা মেয়ের মুখে হাসি ফোটাতেন, অভাবের কষাঘাত থেকে বাঁচিয়ে রাখতেন তাদের। এখন সেই মেশিনটা নীরব, তার ছন্দময় শব্দ আর শোনা যায় না। জয়ী প্রায়ই সেই মেশিনটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। একটা মেশিনই যেন তাদের জীবনের গতিপথ বদলে দিয়েছে, তাদের স্বপ্নগুলোকে হঠাৎই থমকে দিয়েছে। মা'র অসুস্থতার কারণে ঘরের সব কাজ জয়ীর কাঁধে এসে পড়েছে। ছোট বোনদের গোসল করানো, খাওয়ানো, ঘর পরিষ্কার করা, এমনকি রাতের বেলা দাদা-দাদীর দেখাশোনাও তার রুটিনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। পড়াশোনার জন্য বরাদ্দ সময়গুলো যেন প্রতিদিন আরও ছোট হয়ে আসছে, হাতের মুঠোয় ধরা বালি কণার মতো।
আজ দুপুরে জয়ী এসএসসি পরীক্ষার অঙ্ক প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু তার মাথায় তখন কেবলই টাকার হিসাব, প্রতিটি সংখ্যা যেন তার মাথার ভেতর কিলবিল করছিল। সে ভাবছিল, যদি সে একটা সেলাই মেশিন নিয়ে কিছু কাজ করতে পারত, তাহলে হয়তো পরিবারের মুখে হাসি ফুটত। এই চিন্তাটা তার মাথার মধ্যে পাক খাচ্ছিল, ঘুরপাক খাচ্ছিল এক অস্থির ঘূর্ণাবর্তের মতো। এই অভাবের বেড়াজাল থেকে কীভাবে বের হওয়া যায়, তার কোনো পথই যেন খুঁজে পাচ্ছিল না। এই পরিস্থিতিতে পড়াশোনা করাটা যেন এক বিলাসিতা। তবুও সে হাল ছাড়তে নারাজ। তার হৃদয়ের গহীনে লুকিয়ে ছিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার এক সুপ্ত বাসনা, যা দিনের পর দিন পুষ্ট হয়েছে দারিদ্র্যের আগুনে। বাবার স্বপ্ন, মা'র নীরব কষ্ট আর বোনদের নিষ্পাপ মুখগুলো যেন তাকে এই স্বপ্ন থেকে একচুলও নড়তে দিত না।
হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। জয়ী চমকে ওঠে, বইটা প্রায় হাত থেকে পড়ে যাচ্ছিল। মকবুল চাচা এসেছেন। হাতে এক প্যাকেট মিষ্টি। মকবুল চাচা, জয়ীর বাবার আজীবনের বন্ধু, বাবার মৃত্যুর পর থেকে প্রায়ই তাদের খোঁজখবর নেন, যেন এক অদৃশ্য অভিভাবক, এক ছায়াময় বটবৃক্ষ। তার উপস্থিতি যেন এক শীতল ছায়ার মতো, এক শান্তির বার্তা। তার মুখে সবসময় এক স্নিগ্ধ হাসি লেগে থাকে। "জয়ী, শোন," মকবুল চাচার কণ্ঠস্বরে মিশে ছিল এক গভীর ভালোবাসা, যা পিতৃতুল্য। তার চোখের গভীর চাহনি যেন এক সমুদ্রের মতো, যেখানে লুকিয়ে আছে অগাধ স্নেহ। "তোর বাবা আমাকে কিছু টাকা দিয়েছিল। বলেছিল, 'যদি আমরা না থাকি, তবে এই টাকাটা জয়ীকে দিও, যাতে তার স্বপ্ন পূরণ হয়।' আমি জানি, তোর বাবার স্বপ্ন ছিল তুই বড় হবি।" জয়ীর চোখ দিয়ে অজান্তেই জল গড়িয়ে পড়ে, এক অবর্ণনীয় আবেগে তার বুক ভারী হয়ে আসে। তার মনে পড়ে তার বাবার কথা, যিনি বলতেন, "আমি কৃষকের ছেলে হলেও তুই একদিন ইঞ্জিনিয়ার হবি।" বাবার এই কথাগুলো ছিল যেন এক অলিখিত অঙ্গীকার, এক প্রতিজ্ঞাপত্র, যা তার বুকের গভীরে গেঁথে আছে। মকবুল চাচার দেওয়া টাকাটা শুধু অর্থ ছিল না, সেটা ছিল বাবার স্বপ্নের বীজ, যা আজ আবার নতুন করে জয়ীর মনে আশার অঙ্কুরোদগম ঘটিয়েছে। সেই টাকাটা হাতে নিয়ে জয়ীর মনে হলো, এটা কেবল আর্থিক সচ্ছলতার একটি ছোট্ট ঝলক নয়, এটি যেন তার বাবার আত্মা থেকে আসা এক আশীর্বাদ, এক নতুন প্রেরণা। তার চোখে আর টাকার হিসাব নয়, বরং বাবার স্বপ্ন ও পাঁচ বোনের ভবিষ্যৎ। তার কলম যেন এক নতুন শক্তি নিয়ে দৌড়াতে থাকে। সে জানে, এই কঠিন বাস্তবতাকে মোকাবিলা করার জন্য তার শিক্ষাই একমাত্র অস্ত্র। জ্ঞানই তার মুক্তি, জ্ঞানই তার শক্তি।
জয়ীর জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হলো। মকবুল চাচার দেওয়া টাকাটা দিয়ে মা'র পুরনো সেলাই মেশিনটা সারাই করা হলো। পুরনো মেশিনটা যখন ঘড়ঘড় করে চলতে শুরু করলো, তখন তার শব্দ জয়ীর কানে শুধু যন্ত্রের শব্দ হয়ে বাজেনি, তা যেন ছিল নতুন এক জীবনের সুর, এক নতুন ভোরের আগমনী গান। রওশন আপা, তাদের প্রতিবেশী এবং মা'র পুরনো বন্ধু, এগিয়ে এলেন। তিনি নিজেও একটি ছোট দর্জির দোকান চালান, তার হাতে যেন জাদু আছে, প্রতিটি সেলাই যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। তিনি জয়ীকে পুরোনো সেলাইয়ের কৌশলগুলো ঝালাই করে দিলেন, নতুন নতুন নকশা শেখালেন। তার প্রতিটি উপদেশ ছিল যেন এক একটি রত্ন, যা জয়ীর ভবিষ্যতের পথকে আলোকিত করছিল। প্রথম দিন যখন জয়ী সেলাই মেশিনটা চালালো, তখন মা ফরিদা বেগমের চোখে এক ঝলক আনন্দ দেখা গেল। সেই মেশিনের ছন্দে যেন লুকিয়ে ছিল এক নতুন শুরুর গল্প, এক নতুন আশার গান। রওশন আপা জয়ীকে কিছু ছোটখাটো সেলাইয়ের কাজ দিলেন। প্রথম সেলাই করা কামিজ থেকে যখন জয়ী সামান্য কিছু টাকা পেল, সেই টাকাটা তার কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ মনে হলো। সে সেই টাকা দিয়ে তার অসুস্থ দাদীর জন্য ফল আর ছোট বোনদের জন্য চকোলেট কিনে আনলো। তাদের মুখের হাসি দেখে জয়ীর মনে হলো, এই কাজ শুধু পেটের ক্ষুধা মেটাচ্ছে না, আত্মারও খোরাক যোগাচ্ছে। এক অদ্ভুত তৃপ্তি তাকে ঘিরে ধরল, যা শত কষ্টের মাঝেও এক চিলতে সুখ এনে দিত।
পড়াশোনার পাশাপাশি সেলাইয়ের কাজ চালিয়ে যাওয়াটা মোটেও সহজ ছিল না। দিনের বেলায় স্কুল, বিকেলে সেলাইয়ের কাজ, রাতে অসুস্থ মা-দাদী-দাদার সেবা আর ছোট বোনদের দেখভাল—যেন এক ত্রিমুখী যুদ্ধ। কখনও কখনও মনে হতো, সে বুঝি ভেঙে পড়বে, তার শরীর আর সায় দিচ্ছে না, মন চাইছে সব ছেড়েছুড়ে দিতে। কিন্তু তার মনে বাবার সেই কথাগুলো প্রতিধ্বনিত হতো, "তুই আমাদের সব আশা।" এই কথাগুলোই তাকে নতুন করে শক্তি যোগাতো, যেন এক অদৃশ্য হাত তাকে সামনে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল, তাকে পরাজয়ের দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরিয়ে আনত। সে রাত জেগে পড়াশোনা করত, মোমবাতির টিমটিম আলোয় বইয়ের পাতায় চোখ রাখত, কারণ বিদ্যুতের খরচ তাদের জন্য বিলাসিতা। কখনও কখনও ঘুম তার দু’চোখকে ভারী করে তুলত, কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন তাকে জাগিয়ে রাখত, তার দু’চোখে তখন এক নতুন দীপ্তি।
তার স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক ফারুক স্যার জয়ীর মেধা সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন জয়ী ক্লাসে আজকাল কেমন যেন চুপচাপ থাকে, হোমওয়ার্ক জমা দিতেও দেরি হয়। তার উজ্জ্বল চোখজোড়া যেন নিভে আসছে, সেখানে ফুটে উঠেছে ক্লান্তির ছাপ। একদিন তিনি জয়ীকে ডেকে পাঠালেন। জয়ী সবকিছু খুলে বলল, তার কন্ঠস্বর কাঁপছিল, চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। ফারুক স্যার মনোযোগ দিয়ে শুনলেন, তার চোখে ছিল এক গভীর সহানুভূতি, এক পিতৃতুল্য মমতা। তিনি জয়ীকে আশ্বস্ত করলেন, "জয়ী, তোমার মেধা অনেক। তুমি যদি হাল না ছাড়ো, তবে তুমি অনেক দূর যাবে। আমি তোমাকে বিনা পয়সায় পড়াবো, পরীক্ষার আগে সব বিশেষ ক্লাস দেবো। তোমার পড়াশোনা কোনোভাবেই থামবে না, আমি কথা দিচ্ছি।" স্যারের এই আশ্বাস জয়ীর মনে এক নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি করলো। এই পৃথিবীতেও যে নিঃস্বার্থ মানুষ আছে, যারা আলোর দিশা হয়ে দাঁড়ায়, তা সে নতুন করে উপলব্ধি করলো।
জয়ীর সহপাঠী রুবেল, যে ধনী পরিবারের ছেলে, সেও জয়ীর প্রতি এক গভীর সম্মান ও সহানুভূতি পোষণ করত। রুবেল সরাসরি কোনো সাহায্য না করলেও, মাঝে মাঝে জয়ীকে নোটস দিত, কখনও কখনও নীরবে তার টিফিনের অংশ বাড়িয়ে দিত। তার নীরব সমর্থন জয়ীর মনকে হালকা করত, যেন এক অদৃশ্য হাত তাকে পেছন থেকে ঠেলে দিত। এই ছোট ছোট বিষয়গুলো জয়ীকে মানসিকভাবে শক্তি দিত, যেন সে একা নয়, আরও অনেকে আছে যারা তার পাশে আছে, তার এই অদম্য যাত্রায় সঙ্গী। এলাকার চায়ের দোকানদার আব্দুল চাচা, যিনি জয়ীর বাবার সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করতেন, বাজারের মাছ বিক্রেতা সেলিম ভাই, আর মুদি দোকানি কামাল চাচা—সবাই জয়ীকে চিনতেন। তারা করিম শেখের সততা জানতেন। যখন জয়ী তাদের দোকানে যেত, তারা কখনও বাকিতে জিনিসপত্র দিতেন, কখনও অল্প কিছু দাম কম রাখতেন, আবার কখনও মাছের সঙ্গে বাড়তি একটা ছোট মাছ গুঁজে দিতেন। এই প্রতিটি ছোট সাহায্যই জয়ীর কাছে ছিল বিশাল ব্যাপার। যেন অদৃশ্য এক হাত তাকে কঠিন পরিস্থিতিতে আগলে রেখেছিল, গ্রামের এই সহজ সরল মানুষের ভালোবাসা তাকে ঘিরে রাখত এক নিবিড় ভালোবাসার জালে।
এসএসসি পরীক্ষার দিনগুলো ঘনিয়ে আসছিল, প্রতিটি মুহূর্ত যেন এক একটি মাইলফলক। জয়ীর প্রস্তুতি নিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছিল, সময় যেন তার হাত থেকে বালি কণার মতো ফস্কে যাচ্ছিল। ভোর রাতে উঠে সে অঙ্ক কষত, কারণ দিনের বেলায় সেলাইয়ের কাজ আর সংসারের দায়িত্ব তাকে সময় দিত না। রাত জেগে বাংলা আর ইংরেজি বইয়ের পাতা উল্টাতো, কখনও কখনও তার মাথা ঝিমঝিম করত। তার চোখে ঘুম আসত না, কারণ চোখের সামনে ভাসত তার পরিবারের অসহায় মুখগুলো। সে জানত, এই পরীক্ষার ফলই তার জীবনের গতিপথ নির্ধারণ করবে। এই এসএসসি পাসের সার্টিফিকেট শুধু একটি কাগজ নয়, এটি তার পরিবারের মুক্তির সনদ, তার বাবা-মা'র স্বপ্ন পূরণের চাবিকাঠি। তার প্রতিটি অক্ষর জ্ঞান, প্রতিটি অঙ্ক সমাধান ছিল যেন এক একটি যুদ্ধ জয়, এক একটি দুর্ভেদ্য দেয়াল ভেঙে ফেলা।
পরীক্ষা কেন্দ্রে ঢোকার আগে তার বুকের ভেতরটা ধুকপুক করছিল, যেন হৃদপিণ্ডটা লাফিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। মনে হচ্ছিল, তার কাঁধে যেন পুরো পৃথিবীর ভার, প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর তার কাঁধের বোঝা আরও ভারী করে তুলছে। তার ভেতরের ভয় তাকে গ্রাস করতে চাইছিল। কিন্তু যখনই সে তার বাবার সেই মুখটা স্মরণ করলো, তার মনে পড়লো মা'র অসুস্থতার কথা, ছোট বোনদের নিষ্পাপ চাহনি—তখন তার ভেতরের ভয় কেটে গেল। সে মনে মনে বললো, "আমি পারবো, আমাকে পারতেই হবে। এই সার্টিফিকেটই আমার একমাত্র অস্ত্র।" প্রতিটি উত্তর লেখার সময় তার মনে হচ্ছিল, সে যেন নিজের ভাগ্য নিজেই লিখছে, তার প্রতিটি শব্দ যেন এক একটি পাথরে খোদাই করা বার্তা।
ফল প্রকাশের দিন জয়ী ভয়ে ভয়ে স্কুলের নোটিশ বোর্ডের দিকে গিয়েছিল। তার বুকটা ধুক ধুক করছিল, মনে হচ্ছিল এই বুঝি সব স্বপ্ন ভেঙে গেল, জীবনের সব আলো নিভে গেল। কিন্তু যখনই সে তার রোল নম্বরটা খুঁজে পেল আর তার পাশের ‘উত্তীর্ণ’ লেখাটা দেখল, তখন তার চোখে আনন্দের জল। সে খুব ভালো ফল করেছে! এই ফল শুধু তার একার সাফল্য নয়, এটা তার বাবা-মা, দাদা-দাদী, ছোট বোনদের আর মকবুল চাচা, রওশন আপা, ফারুক স্যার এবং এলাকার সব মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল। তার সাফল্যের খবর গ্রামে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল, যেন বাতাসে সুগন্ধির মতো ভেসে বেড়াল। সবাই জয়ীকে অভিনন্দন জানাতে এলো, তাদের চোখে ছিল এক গভীর শ্রদ্ধা। ফরিদা বেগম তার অসুস্থ শরীর নিয়ে জয়ীকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, তার চোখে ছিল অশ্রু আর এক অদ্ভুত অহংকার। করিম শেখ, যিনি তখনো অন্যের জমিতে কাজ করছিলেন, খবরটা শুনে মাঠে বসেই আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলেন। তার ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন হয়তো এইবার সত্যি হবে, এইবার তাদের জীবনে সত্যিই আলোর দেখা মিলবে।
জয়ী আজ শুধুমাত্র একজন এসএসসি পাস করা ছাত্রী নয়, সে যেন এক প্রতীক। বাংলাদেশের প্রতিটি তরুণ-তরুণীর প্রতীক, যারা দারিদ্র্য, হতাশা আর প্রতিকূলতাকে জয় করে নিজেদের স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে যায়। জয়ীর গল্প আমাদের শেখায়, জীবনের কঠিন পথ পেরোতে প্রয়োজন শুধু অদম্য সাহস আর একবিন্দু আশা। যখন চারিদিকে অন্ধকার নেমে আসে, তখন হয়তো মকবুল চাচার মতো কেউ এসে আলো হয়ে দাঁড়ায়, অথবা ফারুক স্যারের মতো কোনো শিক্ষক তার পথের দিশা হয়ে ওঠেন। আর অদৃশ্যভাবে, রুবেলের মতো বন্ধুরা, আব্দুল চাচা বা কামাল চাচার মতো প্রতিবেশীরা, তাদের অজান্তেই তাদের স্বপ্ন পূরণে ভূমিকা রাখে।
জয়ী এখন কলেজের দিকে পা বাড়িয়েছে, তার প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্ন এখন আর শুধু স্বপ্ন নয়, বাস্তবতার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা এক দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। সে জানে, পথটা আরও কঠিন হবে, প্রতিটি ধাপে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ আসবে, কিন্তু সে প্রস্তুত। কারণ তার চোখে এখন আর কেবল ক্লান্তি নয়, বরং এক নতুন দিনের আলো, এক ঝলক সূর্যোদয়। বাংলাদেশের এমন প্রতিটি জয়ীই প্রমাণ করে, স্বপ্ন দেখা যায়, স্বপ্ন ছোঁওয়াও যায়—যদি শুধু থাকে একটুখানি প্রচেষ্টা, একটুখানি বিশ্বাস আর চারপাশের মানুষের ভালোবাসা। এই গল্প হয়তো আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমাদের চারপাশেই কতশত জয়ী নীরবে লড়ে যাচ্ছে, আর তাদের অদম্য সংগ্রামই আমাদের জাতির সত্যিকারের শক্তি। এই জয়ীরাই একদিন বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে, তাদের প্রতিটি জয়ই হবে দেশের এক একটি নতুন বিজয়, এক নতুন সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচন।
আমরা যারা জয়ীর গল্প শুনলাম, তারা হয়তো অনেকেই বুঝতে পারছি না, এমন জয়ী আমাদের চারপাশে কতজন! হয়তো আপনার পাশের বাড়ির কিশোরীটি, অথবা আপনার স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট ছেলেটি—তারাও হয়তো প্রতিদিন এমন এক অদৃশ্য যুদ্ধে লড়ছে। তাদের চোখে হয়তো হাজারো অব্যক্ত স্বপ্ন, যা দারিদ্র্যের নির্মম ছোবলে ধূসর হয়ে যাচ্ছে। জয়ীর গল্প কেবল একটি বিজয়গাথা নয়, এটি আমাদের জন্য এক গভীর বার্তা। এ বার্তা আমাদের বলে, প্রতিটি মানুষই অনন্য, প্রতিটি স্বপ্নই পবিত্র। হয়তো আমরা তাদের জীবনের কঠিন পথটুকু সহজ করতে পারব না, কিন্তু একটু সহানুভূতি, একটু সাহায্য, আর একটুখানি বিশ্বাসই তাদের অদম্য যাত্রায় হতে পারে এক বিশাল অনুপ্রেরণা।
চলুন, আমরা আমাদের চারপাশে এমন জয়ীদের খুঁজে বের করি। তাদের পাশে দাঁড়াই, তাদের স্বপ্ন পূরণের অংশীদার হই। হয়তো আমাদের ছোট একটি পদক্ষেপই তাদের জীবনে বিশাল পরিবর্তন আনতে পারে। একজন ফারুক স্যার, একজন মকবুল চাচা, বা একজন রওশন আপা হয়ে উঠতে পারি আমরাও। আসুন, সমাজের প্রতিটি কোণায় ছড়িয়ে থাকা এই লুকানো গল্পগুলোকে আলোর মুখ দেখাই। আসুন, আমরা এমন এক সমাজ গড়ি যেখানে কোনো স্বপ্নই দারিদ্র্যের ভারে হারিয়ে যাবে না, যেখানে প্রতিটি তরুণ-তরুণী পাবে তাদের আকাশ ছোঁয়ার সুযোগ। জয়ী একা লড়েনি, আর কোনো জয়ীকেই একা লড়তে হবে না—এই হোক আমাদের সম্মিলিত প্রতিজ্ঞা। কারণ এই ছোট ছোট জয়ের গল্পগুলোই একদিন আমাদের বাংলাদেশকে এক সোনালী ভোরের দিকে নিয়ে যাবে। এই গল্পটা শুধু শেষ নয়, এ যে নতুন এক শুরুর আহ্বান।
জয়ীর এই অদম্য লড়াইয়ের গল্পটি কি আপনার মনকেও ছুঁয়ে গেল? হয়তো তার চোখে দেখা স্বপ্ন, তার কাঁধে নেওয়া সংসারের ভার, আপনার আশপাশের কোনো অচেনা মুখকেও মনে করিয়ে দিল। এমন অসংখ্য জয়ী আমাদের চারপাশে নীরবে লড়ে যাচ্ছে। তাদের গল্পগুলো আরও অনেকের জানা দরকার, যেন আমরা একে অপরের পাশে দাঁড়াতে শিখি।
এই গল্পটি নিয়ে আপনার ভাবনা কী? আপনার মূল্যবান মতামত জানাতে ভুলবেন না। আপনার প্রতিটি কথা আমাদের প্রেরণা। আর যদি মনে করেন, এই আলোর দিশারী গল্পটি অন্যদেরও নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শেখাবে, তাহলে দ্বিধা না করে শেয়ার করুন। কারণ আপনার একটি শেয়ারই হয়তো হাজারো ঘুমন্ত চোখে নতুন করে আশার প্রদীপ জ্বালাতে পারে। আসুন, আমরা সবাই মিলে এই আলো ছড়াই।
জয়ী, এসএসসি, সংগ্রাম, স্বপ্ন, বাংলাদেশ, অনুপ্রেরণা, দারিদ্র্য, শিক্ষা।


🌸 আপনার মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ!
আপনার মতামত আমাদের অনুপ্রাণিত করে এবং আগামীতে আরও মানসম্পন্ন কনটেন্ট তৈরিতে সহায়তা করে।
আপনি যদি কোনো নির্দিষ্ট বিষয় বা গল্প পছন্দ করে থাকেন, জানালে ভালো লাগবে।
নিয়মিত পাশে থাকুন — আপনার সহযোগিতা ও ভালোবাসাই আমাদের এগিয়ে চলার শক্তি।
শুভ কামনায়,
✍️ কল্পকথা-৩৬০ ব্লগ টিম
https://kalpakatha360.blogspot.com