বৃষ্টির পর বিকেলটা যেন এক বিষণ্ণ কাব্য হয়ে নেমে এসেছে। পশ্চিমের আকাশে রঙের খেলা শেষ হয়েও হয়নি, তার আগেই ধূসর মেঘেদের আস্তরণ সরে গিয়ে মেঘমুক্ত নীলের সামান্য উঁকি। সূর্যের শেষ রশ্মিটুকু যেন মাটির সঙ্গে অভিমান করে লুকিয়েছে অনেকক্ষণ। গাছপালার পাতায় পাতায় লেগে থাকা জলবিন্দু চিকচিক করছে। গ্রামের কাঁচা রাস্তাটা তখনো মাখনের মতো পিচ্ছিল। পা ফেললেই মাটি যেন গভীর প্রেমে টেনে নিতে চায়, প্রতি পদক্ষেপে পিছলে যাওয়ার আশঙ্কা। এই পথ, এই কাদা, এই একঘেয়ে বর্ষা এসবই গ্রামের চিরন্তন চিত্র। কিন্তু আজ এই পরিচিত ছবিতেই একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে চলেছে, যার চিত্রকর এই কাদাপথের পথিকেরা।
শিমুলের পরনে শাদা সালোয়ার-কামিজ। শাদার উপর কালচে মাটির ছোপ পড়েছে পায়ের গোড়ালির উপর। সে খুব সাবধানে আঁচলটা বুকের উপর টেনে ধরেছে, যাতে নোংরা জল ছিটকে তার পোশাকে না লাগে। তার চোখে মুখে এক ধরনের দৃঢ় সংকল্প, যা এই মাটির রাস্তার পিচ্ছিলতাকে পাত্তা দেয় না। তার মন তখন মফস্সলের কলেজে তার স্বপ্নের বইগুলো নিয়ে বিভোর। তার স্বপ্ন, সে একদিন বড় সাংবাদিক হবে, কলমের শক্তিতে এই গ্রামের দারিদ্র্য আর দুর্দশার কথা সারা বিশ্বকে জানিয়ে দেবে। এই গ্রামের অনেক ছেলেমেয়েদের মতোই সে-ও উচ্চশিক্ষার জন্য প্রতিদিন মাইলের পর মাইল পথ হেঁটে যায়। শহরে যাওয়ার একমাত্র উপায় এই কাঁচা রাস্তা, তারপর আধা পাকা রাস্তা, এবং সবশেষে বাস। আর এই রাস্তা পার হতেই প্রতিদিন তাকে মুখোমুখি হতে হয় একদল অলস মানুষের কটূক্তি আর বিদ্রূপের।
শিমুলের ঠিক পাশেই চলছিল রুবি। রুবি আর শিমুল ছোটবেলার বন্ধু। রুবি খুব লাজুক স্বভাবের। সে সবসময় চারপাশটা দেখছিল ভয়ে ভয়ে। তার দুচোখে এক ধরনের জড়তা, যেন সে এই কাদামাটির দুনিয়ার অংশ নয়, বরং এক কোমল ফুলের পাপড়ি। তার স্বপ্ন এই গ্রাম থেকে অনেক দূরে, শহরের সুশৃঙ্খল জীবনে পা রাখা। একটি সুন্দর ঘর, পরিপাটি বাগান, একজন আদর্শ জীবনসঙ্গী এসবই তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। রুবি লাজুক চোখে চারপাশ দেখছিল, যেন এই কাদামাটির মানুষের কাছ থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। মাঝে মাঝেই তার নরম শাদা জুতোটা কাদায় ডুবে যাচ্ছিল, আর সে যেন আরও গুটিয়ে নিচ্ছিল নিজেকে।
তন্বী হাঁটছিল সবার আগে। তার চোখে যেন আগুন জ্বলছে। তন্বীর চোখে শুধু স্বপ্ন নয়, তার চোখে ছিল এক ধরনের বিদ্রোহ, যা এই নোংরা সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে তার নীরব প্রতিবাদ। তন্বী ছিল এই দলের সবচেয়ে প্রতিবাদী কণ্ঠ। সে গ্রামের প্রথাগত নিয়ম ভাঙতে চায়। সে মনে করে নারী শুধু ঘরে থাকবে না, নারীও ছেলেদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবে, প্রতিবাদ করবে। তার স্বপ্ন এই গ্রামের পিছিয়ে পড়া মেয়েদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা। তাই যখনই কেউ তাদের নিয়ে হাসাহাসি করে, তন্বীর ভেতরে যেন এক আগ্নেয়গিরি জেগে ওঠে।
পেছন থেকে বন্যার শান্ত কণ্ঠ শোনা গেল, “কাদা আমাদের কাপড়ে লাগতে পারে, কিন্তু মনের ভেতরে নয়।” বন্যার কথায় ছিল এক ধরনের গভীরতা, যা কেবল একজন দার্শনিকের পক্ষেই সম্ভব। বন্যা ছিল তাদের দলের সবচেয়ে পরিণত সদস্য। সে এই গ্রামের কাদা, নোংরামি, আর দারিদ্র্যকে মেনে নিয়েছে, কিন্তু সে একই সাথে বিশ্বাস করে যে মানুষের মনকে এইসব আবর্জনার দ্বারা কলুষিত হতে দেওয়া যাবে না।
রাস্তার ধারে একটি চায়ের দোকানের সামনে বসেছিল কিছু মানুষ। তাদের মুখগুলো যেন জীবনের সব হতাশা আর গ্লানি নিয়ে বসে আছে। তারা নিজেদের কোনো কাজ না করে অন্যের জীবন নিয়ে মজা করাতেই আনন্দ পায়। কামাল, রহিম, ছলিম এরা তাদের মধ্যে প্রধান। কামালের মুখটা ছিল কুৎসিত, তার চোখে ছিল এক ধরনের শয়তানি হাসি। সে বিদ্রূপের স্বরে বলে উঠল, “ওরে বাবা, দেখো দেখো, কলেজের রাজকন্যারা আসছেন। কাদা লেগে যাবে না তো?” রহিম আর ছলিম হো হো করে হাসিতে ফেটে পড়ল। তাদের হাসি যেন বর্শার ফলার মতো বিঁধতে লাগল মেয়েদের হৃদয়ে।
কিন্তু এই হাসি আর বিদ্রূপের মাঝেও মেয়েরা চুপ করে থাকল না। তাদের মধ্যে তন্বী সরাসরি প্রতিবাদ করল। সে সোজা দাঁড়িয়ে বলল, “রাস্তা সবার, কাদা সবার। কিন্তু কটূক্তি তোদের একার!” তন্বীর কথা শুনে কামাল এবং তার দলবল যেন একটু থমকে গেল। তারা যেন এমন প্রত্যাশা করেনি। তারা যেন ভেবেছিল এই মেয়েগুলো হয়তো চুপচাপ মাথা নিচু করে চলে যাবে, যেমনটা সাধারণত সবাই করে। কিন্তু তাদের এই প্রত্যাশা ভেঙে দিল তন্বীর সাহস।
হঠাৎ করে ইমন হুড়মুড় করে পড়ে গেল কাদায়। সে তার বইয়ের ঝোলাটা সামলাতে পারল না, আর কাদামাটির ওপর ধপ করে পড়ে গেল। বইগুলোও ছিটকে পড়ল চারিদিকে। তার শার্টের শাদা অংশে লেগে গেল ঘন কাদার দাগ। এই অপ্রত্যাশিত ঘটনায় রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা কামাল, রহিম আর ছলিম হাসিতে ফেটে পড়ল। তাদের হাসির শব্দ যেন সমস্ত গ্রামের নৈঃশব্দ্য ভেঙে দিল।
তাদের পেছনে থাকা নাফিস ঠাট্টা করে বলল, “জামাটা এখন 'কাদা ডিজাইন'!” তার কথায় রনি গাইতে লাগল, “এই পথ যদি না শেষ হয়…” এই পরিস্থিতিটা যেন তাদের মাঝে এক ধরনের অদ্ভুত কৌতুক আর উদ্দীপনা তৈরি করল। তারা সবাই একসাথে হো হো করে হেসে উঠল। তাদের হাসি যেন সেই কাদা আর বিদ্রূপের উপর এক ধরনের বিজয় ঘোষণা করল। এই হাসিটা ছিল তাদের সম্মিলিত সাহসের, একতার এবং স্বপ্নের।
ইমন উঠে দাঁড়াল। তার জামাকাপড়ে কাদার দাগ লাগলেও, তার চোখে মুখে ছিল এক ধরনের হাসি। সে তার বইগুলো তুলে নিল, আর তার বন্ধুরা তাকে সাহায্য করল। আসিফ ফিসফিসিয়ে বলল, “ভয় আমাদেরও কাদা। একসাথে নামালে ভয়ও সরে যাবে।” আসিফের কথা শুনে শিমুল, রুবি আর তন্বী একে অপরের দিকে তাকাল। তাদের চোখে ছিল এক ধরনের নতুন বোধ। তারা যেন বুঝতে পারল যে এই কাদা, এই ভয়, এই বিদ্রূপ এসবই তাদের সামনে এক কঠিন চ্যালেঞ্জ।
আফিসে কাজ করা আজাদ নামের এক যুবক বলল, “এই কাদা শুধু বর্ষার নয়, রাজনীতিরও। বাজেট গেছে কোথায়?” আজাদের কথা সত্য। গ্রামের রাস্তা মেরামতের জন্য প্রতি বছর বাজেট আসে, কিন্তু সেই বাজেট কোথায় যায় তা কেউ জানে না। রাস্তা ঠিক করার নামে কিছু ঠিকাদার নিজেদের পকেট ভরে নেয়। গ্রামের মানুষের এই দুর্ভোগ দেখার যেন কেউ নেই। আনোয়ার মাস্টার দূর থেকে তাকিয়ে ছিলেন। তার চোখে ছিল এক ধরনের নীরব বেদনা, আর একই সাথে এক ধরনের আশা। তিনি যেন মনে মনে ভাবছিলেন, “এই রাস্তা যদি তরুণরা না বানায়, তবে আর কেউ বানাবে না।” তার চোখের ভাষা যেন এই তরুণ-তরুণীদের সংকল্প আরও দৃঢ় করে দিল।
বন্যা শিমুলের হাত ধরে বলল, “আমরা থামব না।” বন্যার কথায় ছিল এক ধরনের দৃঢ়তা, যা তাদের সমস্ত ভয়কে দূর করে দিল। রাশেদ নীরব থেকে শুধু তাকাল। তার চোখে ছিল এক ধরনের অদ্ভুত ভালোবাসা, যা এই দলের প্রতিটি সদস্যের প্রতি তার সম্মান আর সমর্থন প্রকাশ করছিল। হাসনা ব্যাগ থেকে একটি পুরোনো ঝুড়ি বের করল। ফারিয়া কচুরিপানা কাটতে লাগল। এই কচুরিপানাগুলো দিয়ে তারা কাদা পথের উপর মাটি দিতে চেয়েছিল। তারা সবাই হাসতে হাসতে, ঠাট্টা করতে করতে কাজ শুরু করল।
তারা তাদের বইয়ের ঝোলাগুলো একপাশে রেখে দিল। তাদের লক্ষ্য ছিল শুধু নিজেদের জন্য রাস্তা তৈরি করা নয়, বরং এই গ্রামের সমস্ত মানুষের জন্য একটি সহজ পথ তৈরি করা। তারা একে অপরের দিকে তাকাল, আর তাদের চোখে ছিল এক ধরনের অদম্য শক্তি।
কামাল তাদের দিকে এগিয়ে আসল। তার চোখে এবার বিদ্রূপের হাসি নেই, বরং এক ধরনের কৌতুহল। সে গম্ভীর স্বরে বলল, “আগে আমাদের বলে কাজ করো!” সুজন জবাব দিল, “যারা হাঁটে, রাস্তার দায় তাদেরই। তোমাদের নয়।” সুজনের কথায় কামাল যেন কোনো উত্তর খুঁজে পেল না। সুজন এই দলের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক ছিল। তার মুখের এই দৃঢ় কথায় কামাল ও তার সঙ্গীরা কিছুটা পিছিয়ে গেল।
নালা কাটা শুরু হলো। তারা কাদামাটি সরিয়ে জল বের করে দিল। কাদা আর জল আলাদা হয়ে গেল। পানি ছুটে গেল মাঠের দিকে। হালিমা খালা, যে তাদের বাড়িতে কাজ করে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত তুলে বললেন, “আলহামদুলিল্লাহ, আমার নাতির জ্বরের পানি নেমে যাবে এবার।” হালিমা খালার কথা শুনে তারা যেন আরও অনুপ্রেরণা পেল। তারা বুঝতে পারল যে তাদের এই কাজ শুধু নিজেদের জন্য নয়, এই গ্রামের সবার জন্য।
সবাই একসাথে বলল, “কাদা আমাদের কাপড়ে লাগবে, কিন্তু আমাদের স্বপ্নে নয়। কাদা ভয় দেখাতে পারে, আটকে রাখতে পারে না।” তাদের এই দৃঢ় সংকল্প যেন সারা গ্রামের মাঝে এক ধরনের ঢেউ তৈরি করল। তাদের এই কাজ দেখে আরও অনেক গ্রামের মানুষ এগিয়ে আসল। তারা তাদের সাথে যোগ দিল, আর রাস্তা তৈরি করার এই সংগ্রামে হাত মেলাল।
সন্ধ্যা হয়ে এল। সূর্য দিগন্তে ডুব দিল। রাস্তা পুরো শুকোয়নি। তবু আর পা ডোবে না। বন্যা ছোট্ট একটা ফুল গুঁজে দিল কাদার স্তূপে। তন্বী জিজ্ঞেস করল, “প্রতীক নাকি?” বন্যা বলল, “প্রতিশ্রুতি।” তাদের এই প্রতিশ্রুতি ছিল নিজেদের প্রতি, গ্রামের প্রতি এবং স্বপ্নের প্রতি। শিমুল মাথা উঁচু করে বলে উঠল, “যে পথ কাদায় ভিজে যায়, সেই পথই একদিন ফুলে ভরে ওঠে।”
এই গল্পটা কেবল গ্রামের নয়। এ গল্প আমাদের সবার যেখানে পথ আটকায় কাদা, কটূক্তি, ভয় আর অবহেলা। কিন্তু যদি একসাথে হাত ধরা যায়, তবে কাদা সরিয়ে পথ বানানো যায়।
আমাদের এই কাদা, এই ভয়, এই বিদ্রূপ এসবই আমাদের জীবনে এক কঠিন পরীক্ষা। কিন্তু আমরা যদি এই পরীক্ষা থেকে ভয় না পাই, তাহলে আমরা এই পরীক্ষায় জয়ী হতে পারব। এই জয় শুধু আমাদের ব্যক্তিগত জয় নয়, এটি আমাদের সম্মিলিত জয়।
🌸 আপনার মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ!
আপনার মতামত আমাদের অনুপ্রাণিত করে এবং আগামীতে আরও মানসম্পন্ন কনটেন্ট তৈরিতে সহায়তা করে।
আপনি যদি কোনো নির্দিষ্ট বিষয় বা গল্প পছন্দ করে থাকেন, জানালে ভালো লাগবে।
নিয়মিত পাশে থাকুন — আপনার সহযোগিতা ও ভালোবাসাই আমাদের এগিয়ে চলার শক্তি।
শুভ কামনায়,
✍️ কল্পকথা-৩৬০ ব্লগ টিম
https://kalpakatha360.blogspot.com