জীবন মানেই গল্প, কিন্তু সব গল্প বলা হয় না। কিছু গল্প মুখে আসে, কিছু গল্প জমে থাকে বুকের ভেতরে শব্দহীন, অথচ ভারি। এই না বলা গল্পগুলোই আসলে সবচেয়ে গভীর, সবচেয়ে সত্য। কারণ এখানে থাকে জীবনের আসল সংগ্রাম, ভাঙা স্বপ্নের ধুলো, আর ভেতরে ভেতরে জ্বালিয়ে রাখা আশার প্রদীপ।
আমরা প্রতিদিন রাস্তায় হাঁটি, বাসে-রিকশায় চড়ি, বাজারে যাই, অফিসে যাই চারপাশে অসংখ্য মানুষ দেখি। কিন্তু আমরা কি তাদের চোখে চোখ রেখে দেখি? তাদের ভেতরের না বলা কথা শুনি?
যে রিকশাচালক আপনাকে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়, যে চায়ের দোকানি আপনার সকালের প্রথম চুমুকটা সাজিয়ে দেয়, যে গ্রামের শিক্ষক বিনা পয়সায় পড়ান তাদের গল্প কি আমরা জানি?
এই লেখা সেইসব মানুষের জন্য যাদের জীবন এক অবিরাম সংগ্রামের নাম, যাদের গল্প হয়তো কখনো শিরোনাম হয় না, কিন্তু যাদের ছাড়া আমাদের সমাজের গতি থেমে যেত।
বাংলার এক প্রাচীন প্রবাদে বলা হয় "নদী যেমন বাঁক বদলায়, জীবনও তেমন।" এই একটি বাক্যেই যেন লুকিয়ে আছে মানব অস্তিত্বের গভীরতম দর্শন। নদীর মতোই আমাদের জীবন কখনো শান্ত, সমাহিত, ধীর স্রোতে বয়ে চলা; কখনো আবার বর্ষার ভরা নদীর মতো উত্তাল, ফুঁসে ওঠা, সবকিছু তোলপাড় করে দেওয়া। কখনো বা শীতের শীর্ণ নদীর মতো এমন নিস্তব্ধ, এমন স্থির যে মনে হয়, সব স্রোত বুঝি থেমে গেছে, সব গতি হারিয়ে গেছে কালের গহ্বরে।
আমরা যারা প্রতিদিন ভোরে অ্যালার্মের শব্দে জেগে উঠি, যন্ত্রের মতো তৈরি হয়ে জীবনের স্রোতে ঝাঁপিয়ে পড়ি, তারা কি কখনো এক মুহূর্তের জন্য থেমে ভেবেছি এই স্রোতের প্রতিটি ঢেউয়ের আড়ালে, প্রতিটি ঘূর্ণির ভেতরে লুকিয়ে আছে কত মানুষের না বলা গল্প? এই যে বিশাল জনসমুদ্র, তার প্রতিটি বিন্দু এক-একটি স্বতন্ত্র জীবন, এক-একটি মহাকাব্য।
ভোর হওয়ার আগেই রহিমের ঘুম ভেঙে যায়। পাশের বস্তির মসজিদ থেকে ভেসে আসা আজানের ধ্বনি তার কাছে অ্যালার্মের মতো। আধো-অন্ধকারে ছোট টিনের ঘর থেকে বেরিয়ে সে দিনের প্রস্ততি নেয়। পান্তা ভাতের সাথে কাঁচা মরিচ আর পেঁয়াজ এই তার সকালের শক্তি। এরপর হাঁটা দেয় শহরের বুকে গজিয়ে ওঠা নতুন অট্টালিকার দিকে, যা তার বর্তমান কর্মস্থল।
রহিমের জগৎটা লোহা, সিমেন্ট আর ইটের তৈরি। তার কাজ হলো দশতলা ভবনের নিচে থেকে মাথায় করে ইট বয়ে উপরে নিয়ে যাওয়া। প্রতিদিন সকালে যখন সে খালি পায়ে ভারা বেয়ে উপরে উঠতে থাকে, তখন নিচের পৃথিবীটা আস্তে আস্তে ছোট হয়ে আসে, কিন্তু তার কাঁধের বোঝাটা ঠিকই ভারী থেকে যায়। কড়া রোদে পিঠ পুড়ে যায়, ঘামে ভেজা শরীরটা সিমেন্টের গুঁড়োয় ধূসর হয়ে ওঠে। দুপুরে সহকর্মীদের সাথে বসে যখন গামছায় বাঁধা রুটি আর একটুখানি সবজি খায়, তখন এক মুহূর্তের জন্য সব ক্লান্তি ভুলে যায়। এইটুকুই তার বিশ্রাম।
কাজের ফাঁকে রহিম মাঝে মাঝে উপরের তলা থেকে নিচের ব্যস্ত শহরটাকে দেখে। সারি সারি গাড়ি, আধুনিক মানুষজন, ঝলমলে দোকানপাট সবকিছুই তার কাছে অন্য এক পৃথিবীর গল্প মনে হয়। সে যে ভবনটি তৈরি করছে, সেখানে থাকবে আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা। কিন্তু রহিম জানে, এই ভবনের ছাদের নিচে তার কোনোদিন থাকার সৌভাগ্য হবে না। তার বসবাস ওই দূরের ছোট টিনের ঘরটাতেই। এই বৈপরীত্যটা তাকে প্রায়ই ভাবায়, কিন্তু দীর্ঘশ্বাস ফেলারও সময় তার নেই।
দিন শেষে যখন সূর্যটা পশ্চিমে ঢলে পড়ে, তখন রহিমের ছুটি হয়। সারাদিনের খাটুনির পর শরীরটা আর চলতে চায় না, কিন্তু মনের মধ্যে একটা তাগিদ থাকে। মাসের শেষে যে টাকাটা সে পাবে, সেটা গ্রামে পাঠিয়ে দিতে হবে। তার ছোট মেয়েটা এবার ক্লাস ফাইভে উঠেছে। মেয়ের পড়ার খরচ, মায়ের ওষুধের টাকা আর সংসারের বাকি খরচ সবই তার এই ঘামের টাকার ওপর নির্ভরশীল।
রাতে ঘরে ফিরে রহিম যখন ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দেয়, তখন তার চোখে গ্রাম ভেসে ওঠে। তার মনে পড়ে, শেষবার যখন বাড়ি গিয়েছিল, মেয়েটা তার গলা জড়িয়ে ধরে বলেছিল, "বাবা, আমি বড় হয়ে ডাক্তার হব। তখন তোমারে আর এমন কষ্ট করতে হবে না।"
মেয়ের এই কথাগুলোই রহিমের শক্তি। এই ইট-পাথরের কঠিন শহরে সে নিজের জন্য বাঁচে না, বাঁচে ওই গ্রামের একটি স্বপ্নের জন্য। প্রতিটি ইট সে নিজের হাতে গাঁথে না, গাঁথে মেয়ের ভবিষ্যতের ভিত্তি। তাই তো শত কষ্ট আর অপূর্ণতার মাঝেও রহিম স্বপ্ন দেখে একদিন তার সন্তানরা এই ইটের খাঁচা থেকে মুক্তি পাবে এবং এক নতুন সকালের আলোয় নিজেদের জীবন গড়বে। এই স্বপ্নই তাকে প্রতিটি নতুন দিনে আবার কাজে ফেরার শক্তি জোগায়।
পথের ধারে গনগনে রোদে পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া চামড়া নিয়ে প্যাডেলে পা রাখা রিকশাচালক, বাসস্ট্যান্ডের কোণে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত দেহে চা বানানো মহিলা, শহরের আকাশছোঁয়া দালানের নিচে বসে থাকা নিরাপত্তা প্রহরী, কিংবা গ্রামের কোনো এক প্রান্তে বসে নীরবে বই বিলানো তরুণ তাদের গল্প হয়তো কখনো পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হয় না। তাদের জীবনের সংগ্রাম নিয়ে টক শো-তে ঝড় ওঠে না। অথচ তাদের জীবনই আসল সমাজের গল্প। তাদের ঘাম, শ্রম আর নিঃশব্দ আত্মত্যাগের উপরেই দাঁড়িয়ে আছে আমাদের এই তথাকথিত সভ্য, আধুনিক জীবন। এই লেখাটি সেইসব অদেখা নায়কদের গল্প, যাদের ছাড়া আমাদের একদিনও চলে না, অথচ যাদের আমরা দেখেও দেখি না।
ঢাকার মোহাম্মদপুরের এক সরু, স্যাঁতস্যাঁতে গলিতে একদিন আচমকা আমার পথ আটকে গেল। সামনে দাঁড়িয়ে হালকা হাসি মুখে প্যাডেল ঘোরাচ্ছেন এক মানুষ নাম আব্দুল হাকিম। বয়স পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই, ত্বকে রোদের তীব্র দহনের স্থায়ী ছাপ, চোখের কোণে এক ধরনের লাজুক অথচ গভীর ক্লান্তি। তার রিকশার ভাঙা আয়নায় প্রতিফলিত হচ্ছিল পেছনের গাড়ির হেডলাইট আর শহরের অন্তহীন ব্যস্ততা।
কথাবার্তা শুরু হতেই জানা গেল এক অন্য জীবনের গল্প। আব্দুল হাকিম একসময় পদ্মার বুকে নৌকা চালাতেন। নদীর উত্তাল ঢেউ ছিল তার জীবনের ছন্দ, পানির সোঁদা গন্ধে তার ঘুম ভাঙত, আর জ্যোৎস্না রাতে নদীর বুকে ভাসতে ভাসতে ভাটিয়ালি গান ছিল তার আত্মার খোরাক। তিনি বলছিলেন, “আগে যখন নদীতে নামতাম, মনে হইত পুরা দুনিয়া আমার। বাতাস যখন পালের মইধ্যে বাড়ি খাইত, নৌকা দৌড়াইত নিজের খুশিতে। আমরা মাঝিরা একে অপরেরে দেইখা হাঁক দিতাম, বিপদে-আপদে একজন আরেকজনের পাশে থাকতাম।” তার চোখে ভাসে সেই দিনের ছবি, যখন নদীর ঘাট ছিল মানুষের মিলনমেলা, আর তার নৌকা ছিল অনেকের ভরসা।
আমি জিজ্ঞেস না করে পারলাম না, “নৌকা ছেড়ে রিকশা ধরলেন কেন, চাচা?”
তিনি এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে রিকশার সিটে হেলান দিয়ে বললেন, “নদী তো আর আগের মতো নাই ভাইজান… পানি শুকাইয়া গেছে, চর পড়ছে মাইলের পর মাইল। আগে যেখানে বুকসমান পানি ছিল, অহন সেখানে গরু চরে। মাছও কইমা গেছে। সংসার তো চালাইতে হইব, তাই পেটের দায়ে এই শহরের জ্যামে আইসা চাকাটা ধরছি।”
তার কণ্ঠস্বরে নদী হারানোর যে হাহাকার আমি সেদিন শুনেছিলাম, তা কোনোদিন ভোলার নয়। তার চোখে আমি দেখেছিলাম এক বিশাল শূন্যতা যে শূন্যতা কেবল একজন মাঝিই বুঝতে পারে, যার নদী চুরি হয়ে গেছে। তিনি এখন আর নদীর স্রোতের শব্দ শোনেন না, শোনেন গাড়ির হর্ন আর মানুষের কোলাহল। তার হাত এখন আর বৈঠা ধরে না, ধরে রিকশার শক্ত হ্যান্ডেল, যা দিনের শেষে তাকে উপহার দেয় তীব্র যন্ত্রণা। মাঝে মাঝে যখন ঢাকার রাস্তায় বৃষ্টি নামে, ভেজা মাটির গন্ধ তাকে মনে করিয়ে দেয় পদ্মার পাড়ের কথা। তখন তার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। সেই নদী আর হয়তো ফিরবে না, হাকিম চাচার জীবনও আর আগের মতো হবে না। কিন্তু সংসারের চাকা তো থামানো যায় না।
বাংলা লোকগানে যেমনটা আছে "পানির সাথে ভাসে জীবন, তীরে ঠেকলে থামে না।" হাকিমের জীবনও তেমনই। পানি শুকিয়ে গেলেও জীবন থেমে থাকেনি, শুধু তার চলার পথটা বদলে গেছে পদ্মার প্রশস্ত বুক থেকে ঢাকার সংকীর্ণ গলিতে।
ভোরের আলো ফোটার আগের শহরটাকে খুব কম মানুষই দেখে। সেই সময়ে রাস্তাগুলো থাকে আশ্চর্যরকম ফাঁকা, বাতাসে ভেসে বেড়ায় ভেজা মাটির গন্ধ, আর ল্যাম্পপোস্টের হলদে আলোর নিচে রাতজাগা কুকুরগুলো অলস ভঙ্গিতে শুয়ে থাকে। ঠিক এমনই এক সময়ে মিরপুরের এক বস্তিতে ঘুম ভাঙে রোকসানা বেগমের।
ঘড়ির কাঁটায় তখন ভোর চারটা। রোকসানা উঠে পড়েন। ছেলেমেয়ে আর স্বামীর জন্য নাশতা আর দুপুরের খাবার তৈরি করে, ঘর গুছিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়েন তার কর্মক্ষেত্রের দিকে। পাশের বাজারের এক কোণে তার ছোট্ট একটি চায়ের দোকান। একটি টিনের চালার নিচে দুটো বেঞ্চি আর একটি গ্যাসের চুলা এই তার সাম্রাজ্য। সকাল থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত, দিনে প্রায় আঠারো ঘণ্টা তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। অবিরাম চা বানানো, কাপ ধোয়া, ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলা এক মুহূর্তের ফুরসত নেই। তার পায়ে এখন স্থায়ী ব্যথা, গরম পানির ছিটে লেগে হাতে তৈরি হয়েছে ছোট ছোট দাগ।
একদিন সন্ধ্যায় তার দোকানে চা খেতে গিয়ে আমি বললাম, “খালা, এত কষ্ট করেন কীভাবে?”
আমার প্রশ্নে রোকসানা প্রথমে একটু অবাক হলেন, তারপর তার ক্লান্ত মুখে ফুটে উঠল এক অসাধারণ আত্মবিশ্বাসের হাসি। বললেন, “কষ্ট তো আছেই ভাই। কিন্তু এই কষ্ট না করলে পোলাপান দুইটারে পড়াইতে পারুম না। আমার বড় মাইয়াটা, রিমি, ক্লাস সেভেনে পড়ে। বই পড়তে খুব ভালোবাসে। আর ছোটটা, রাজু, ক্লাস থ্রিতে। ওর ইচ্ছা, সে বড় হইয়া পাইলট হইব। আমি নিজে ক্লাস ফাইভের পর আর পড়তে পারি নাই। আমার স্বপ্ন, ওরা বড় হইব, অফিসার হইব। আমি রাইতে যখন বাসায় ফিরি, ওগো ঘুমন্ত মুখটা দেখি। তখন সব কষ্ট ভুইলা যাই। আমি না পারলে আর কে করব, কন?”
সেই হাসির ভেতরে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম বাঙালি মায়ের হাজার বছরের ত্যাগের ইতিহাস। সেখানে নিজের সুখ, নিজের আরাম, নিজের স্বপ্নের কোনো জায়গা নেই। সবটুকু বিলিয়ে দেওয়া হয়েছে সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য। রোকসানার কাছে তার এই চায়ের দোকানটি কেবল একটি ব্যবসা নয়, এটি তার সন্তানদের স্বপ্ন পূরণের যুদ্ধক্ষেত্র। তিনি এই শহরের এক নিঃশব্দ যোদ্ধা, যার লড়াইটা আমাদের অনেকেরই চোখ এড়িয়ে যায়।
শহরের কোলাহল আর কংক্রিটের জঙ্গল থেকে দূরে গেলে জীবনের ছবিটা অন্যরকম হয়ে যায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামে দেখা মিলল সেলিম মিয়ার। সাধারণ এক কৃষক, কিন্তু তার স্বপ্নটা অসাধারণ। নিজের মাটির ঘরের এক কোণে তিনি গড়ে তুলেছেন এক ছোট্ট লাইব্রেরি। সেখানে নেই কোনো আধুনিক আসবাবপত্র, নেই কোনো শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা। আছে শুধু বাঁশের তৈরি কয়েকটি তাক, আর তাতে থরে থরে সাজানো পুরনো বই। কিছু বই তিনি নিজে কিনেছেন, কিছু বই শহরের মানুষের কাছ থেকে চেয়ে এনেছেন, আর কিছু বই কুড়িয়ে পাওয়া।
তিনি এই লাইব্রেরি চালান সম্পূর্ণ বিনা পয়সায়। গ্রামের ছেলেমেয়েরা যখন স্কুল থেকে ফেরে বা বিকেলে খেলার পর ক্লান্ত হয়ে আসে, তারা ভিড় জমায় সেলিমের এই জ্ঞানের কুটিরে। তিনি তাদের বই পড়তে উৎসাহিত করেন, গল্প শোনান, আর স্বপ্ন দেখান এক আলোকিত ভবিষ্যতের। এর পেছনেরও একটি গল্প আছে। সেলিম মিয়া নিজেও ছোটবেলায় টাকার অভাবে পড়তে পারেননি। সেই যন্ত্রণা তাকে তাড়িয়ে বেড়াত। তাই তিনি পণ করেছিলেন, গ্রামের আর কোনো শিশুকে যেন বইয়ের অভাবে জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হতে না হয়।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “এই যে এত কষ্ট করে লাইব্রেরিটা চালাচ্ছেন, এতে আপনার কী লাভ হয়?”
সেলিম মিয়া মাটির দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে উত্তর দিলেন, “লাভ কি শুধু টাকায় হয় ভাই? এই যে পাশের বাড়ির মেয়েটা, আসমা, সে আমার এখান থেকে বই পইড়া রচনা লেখা শিখছে। এখন সে ক্লাসে ফার্স্ট হয়। ওই যে ছেলেটা, ও আমার বই পইড়া মহাকাশ নিয়া জানতে চায়। ওদের চোখগুলো যখন নতুন কিছু জানার আনন্দে চকচক করে ওঠে এর চেয়ে বড় লাভ আর কী আছে? ওরা যদি বই পইড়া মানুষ হইতে পারে, তাইলেই আমার সব পরিশ্রম সার্থক।”
তার কণ্ঠস্বরে ছিল এক অদ্ভুত তৃপ্তি, এক ধরনের অপার্থিব প্রশান্তি, যা হয়তো শহরের বড় চাকরিজীবী বা কোটিপতি ব্যবসায়ীদের মুখেও খুঁজে পাওয়া যায় না। সেলিম মিয়ার মতো মানুষেরা হয়তো প্রচারের আলোয় আসেন না, কিন্তু তারাই নীরবে, নিভৃতে আমাদের সমাজের ভবিষ্যতের শেকড় তৈরি করে দেন। তারা এক-একটি আলোর প্রদীপ, যা দিয়ে তারা দূর করে চলেছেন অশিক্ষা আর অজ্ঞতার অন্ধকার।
ঢাকার সবচেয়ে ব্যস্ত আর বিশৃঙ্খল জায়গাগুলোর একটি গাবতলী বাসস্ট্যান্ড। মানুষের ভিড়, বাসের হর্ন, কুলি আর হকারদের চিৎকারে কান পাতা দায়। এমনই এক পরিবেশে একদিন আমার চোখে পড়ল এক বৃদ্ধাকে। বয়স সত্তরের কাছাকাছি, পরনে মলিন একটি শাড়ি, হাতে কাপড়ের একটি ব্যাগ। তিনি কিন্তু ভিক্ষা চাইছেন না। বরং বাস থেকে নামা ক্লান্ত যাত্রীদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলছেন, “বাবা, ব্যাগটা আগাইয়া দেই?”
কেউ রাজি হলে তিনি সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তাদের ব্যাগ রিকশা বা সিএনজি পর্যন্ত পৌঁছে দেন। কৌতুহলবশত আমি তার সাথে কথা বললাম। জানলাম, তার সন্তানরা তাকে দেখে না। একাই থাকেন। কিন্তু কারো কাছে হাত পাততে তার আত্মসম্মানে বাধে।
তিনি বললেন, “আমি ভিক্ষা চাই না বাবা, হাত পেতে মানুষের করুণা নিতে আমার শরম করে। যতদিন শরীরে শক্তি আছে, কাজ কইরা খামু। দুই টাকা কম হইলেও সম্মানের টাকা। পোলাপান খোঁজ নেয় না, তাতে কী? আমি তো আর মইরা যাই নাই।”
আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম তার কথা শুনে। এই চরম দারিদ্র্যের মাঝেও তার আত্মমর্যাদা কতটা প্রখর! এই মর্যাদা, এই আত্মসম্মান আমাদের ব্যস্ত, আধুনিক শহরের মানুষদের অনেকের কাছ থেকেই হয়তো হারিয়ে গেছে। কিন্তু এই বৃদ্ধার ভাঙা শরীরের ভেতরে তা এখনও উজ্জ্বল হয়ে বেঁচে আছে। তিনি আমাদের শিখিয়ে দেন, কোনো কাজই ছোট নয়, আর সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার চেয়ে বড় কোনো সম্পদ নেই।
আব্দুল হাকিম, রোকসানা বেগম, সেলিম মিয়া, বা গাবতলীর সেই বৃদ্ধা মা এরা বিচ্ছিন্ন কোনো চরিত্র নন। তারা আমাদের সমাজের লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রতিচ্ছবি। আমরা যাদের পাশ কাটিয়ে যাই রিকশাচালক, গৃহকর্মী, কৃষক, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, দোকানদার তারা না থাকলে আমাদের জীবন এক মুহূর্তের জন্য থেমে যেত। তাদের হাতের পরিশ্রমেই আমরা প্রতিদিনের আরাম আর স্বাচ্ছন্দ্য উপভোগ করি। অথচ আমরা তাদের নামটিও জানার চেষ্টা করি না, ধন্যবাদ দেওয়া তো দূরের কথা।
বাংলার আরেক প্রবাদে আছে "মানুষের মর্যাদা কাজের মধ্যে লুকায়।" এই কথাটি যেন এইসব মানুষের জন্যই লেখা।
কিন্তু আমরা কতটা দেখি আর কতটা এড়িয়ে যাই? সোশ্যাল মিডিয়ার ঝলমলে ছবির ভিড়ে, বানানো হাসির আড়ালে এই কঠিন বাস্তবতার কষ্ট আমাদের চোখে পড়ে না। পত্রিকার শিরোনামে যখন দেখি “হাজার হাজার মানুষ বন্যায় গৃহহীন” তখন মুহূর্তের জন্য আমাদের মন খারাপ হয়, আমরা হয়তো ‘স্যাড’ রিয়্যাক্ট দিই, তারপর আবার পরের পোস্টে স্ক্রল করে চলে যাই। কিন্তু সেই গৃহহীন মানুষগুলোর কাছে এই কষ্ট এক মুহূর্তের নয়, সারা জীবনের। আমাদের সহানুভূতি এখন বড্ড সস্তা আর ক্ষণস্থায়ী হয়ে গেছে।
এখানে কোনো রূপকথার গল্প নেই। আব্দুল হাকিমের জীবনে তার হারানো নদী হয়তো আর কখনো ফিরে আসবে না। রোকসানা বেগমের হয়তো সারা জীবন এই চায়ের দোকানেই কষ্ট করে যেতে হবে। সেলিম মিয়ার লাইব্রেরি হয়তো একদিন অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে যাবে।
কিন্তু তাদের গল্প আমাদের কোনো অলীক স্বপ্ন দেখায় না, বরং জীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করায়। তাদের গল্প আমাদের শেখায় প্রতিদিনের ছোট ছোট ত্যাগ, নিঃশব্দ সাহস, আর দাঁতে দাঁত চেপে করা লড়াইয়ের মধ্যেই লুকিয়ে আছে মানুষের আসল মহিমা। সাফল্য মানে শুধু বড় গাড়ি বা বাড়ি নয়, সাফল্য মানে চরম প্রতিকূলতার মাঝেও নিজের নীতি আর আত্মসম্মানকে বাঁচিয়ে রাখা।
আপনি কি আজ অন্তত একজন মানুষকে মন থেকে ধন্যবাদ জানাবেন, যিনি আপনার জীবনকে একটু হলেও সহজ করে দেন, অথচ যাকে আপনি কখনো খেয়ালই করেননি? হতে পারে তিনি আপনার অফিসের দারোয়ান, আপনার বাসার পরিচ্ছন্নতাকর্মী, বা আপনার এলাকার রিকশাচালক।
আপনি কি একবার ভেবে দেখবেন আপনার চারপাশের এই সাধারণ মানুষগুলো আসলে আপনার জীবনের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
আপনি কি প্রস্তুত, তাদের মতো হতে, যদি একদিন আপনার জীবনেও এমন কঠিন পরীক্ষা আসে? আপনি কি পারবেন সব হারিয়েও আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে?
এই লেখাটি কেবল কয়েকটি গল্প নয়, এটি আমাদের সমাজের এক নির্মম আয়না। হাকিম, রোকসানা, সেলিম এই তিনটি নাম আসলে তিনটি প্রতীক। তারা সেই কোটি মানুষের প্রতিনিধি, যাদের শ্রমের উপর ভর করে আমাদের দেশটা টিকে আছে, আমাদের অর্থনীতি চলছে। আমরা যাদের ‘ছোটলোক’ বা ‘সাধারণ’ বলে পাশ কাটিয়ে যাই, তারাই এই সমাজের আসল ভিত্তি, আসল স্তম্ভ।
তাদের প্রতি সম্মান জানানো, তাদের কাজের স্বীকৃতি দেওয়া, এবং সম্ভব হলে তাদের পাশে দাঁড়ানো এটা কোনো করুণা নয়, এটা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। কারণ আমরা তাদের কাছে ঋণী।
তাহলে শেষ প্রশ্নটা আপনার কাছেই রেখে যাচ্ছি আমরা কি ধীরে ধীরে শুধু একজন অনুভূতিহীন ভোক্তায় পরিণত হচ্ছি, যারা কেবল নিতে জানে, কিন্তু বিনিময়ে কিছুই ফেরত দেয় না? নাকি আমরা এখনও মানুষ হয়ে বেঁচে থাকতে পারি, যে অন্যের কষ্ট বুঝতে পারে, অন্যের লড়াইকে সম্মান করে এবং তার পাশে দাঁড়ায়?
ভাবুন। কারণ পরিবর্তন সবসময় শুরু হয় একজন মানুষ থেকে। আর সেই মানুষটি আজ আপনিই হতে পারেন।
জীবন সংগ্রাম, সামাজিক বাস্তবতা, অদেখা নায়ক, মানবিক গল্প, আত্মমর্যাদা, বাংলাদেশ।
🌸 আপনার মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ!
আপনার মতামত আমাদের অনুপ্রাণিত করে এবং আগামীতে আরও মানসম্পন্ন কনটেন্ট তৈরিতে সহায়তা করে।
আপনি যদি কোনো নির্দিষ্ট বিষয় বা গল্প পছন্দ করে থাকেন, জানালে ভালো লাগবে।
নিয়মিত পাশে থাকুন — আপনার সহযোগিতা ও ভালোবাসাই আমাদের এগিয়ে চলার শক্তি।
শুভ কামনায়,
✍️ কল্পকথা-৩৬০ ব্লগ টিম
https://kalpakatha360.blogspot.com