প্রতুল বাবুর সকালগুলোয় যেন একটা পুরনো দিনের গানের সুর বাজত, যে সুর মন ছুঁয়ে যেত অথচ কোনো কথা বলতে পারত না। ফিকে রোদ আর এক বুক অব্যক্ত শূন্যতা নিয়েই তাঁর দিন শুরু হত। প্রায় সাতটা দশক পেরিয়ে আসা শরীরটা বয়সের ভারে নূয়ে পড়লেও, ভেতরের মানুষটা ছিল এক নিথর, শীতল জলাশয়ের মতো। এই নিথরতা কেবল তাঁর একাকীত্বের রেশ নয়, এ যেন স্মৃতির ধূসর চাদরে মোড়া এক নিদারুণ দীর্ঘশ্বাস।
পুরনো বাড়িটার প্রতিটা ইঁট, প্রতিটা আসবাবপত্র যেন তাঁর দীর্ঘ জীবনের নীরব সাক্ষী। দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়ছে একটু একটু করে, ঠিক যেমন তাঁর জীবনের বহু সুখস্মৃতির উজ্জ্বল রঙগুলোও খসে পড়েছে সময়ের সাথে। ঘরের প্রতিটা কোণায় জমে আছে একরাশ ধূলো আর অজস্র চাপা পড়ে থাকা দীর্ঘশ্বাসের স্তূপ। আর এর মাঝেই প্রতুল বাবু যেন এক প্রাচীন কচ্ছপের মতো ধীর পায়ে হেঁটে চলেন, যার খোলসের ভেতর লুকিয়ে আছে এক অনন্ত অতীত, এক বুক না বলা কথা।
প্রতিদিন সকালে বারান্দার সেই পুরনো ইজিচেয়ারটায় বসাটা ছিল তাঁর বহুদিনের অভ্যাস। মাথার ওপর বিবর্ণ সবুজ টিনের চালার ছাদ, যেখানে শ্যাওলার পুরু আস্তরণ। তার ওপর দিয়ে গলে আসা এক চিলতে ফিকে রোদ এসে পড়ত তাঁর শীর্ণ শরীরে। রোদটা যেন তাঁর রুগ্ন শরীর ভেদ করে সোজা আত্মার গভীরে প্রবেশ করত, কিন্তু হায়! সেই গভীরে এতটুকু উষ্ণতা জাগাতে পারত না। চোখের সামনে কেবলই ভেসে থাকত এক দীর্ঘ, ধূসর শূন্যতা।
পাশের রাস্তা দিয়ে জীবনের চিরচেনা কোলাহল ভেসে আসে – বাচ্চাদের হাসি, ফেরিওয়ালার হাঁকডাক, গাড়ির অবিরাম শব্দ। এই সব কিছুই যেন তাঁর নির্জন দ্বীপের বাইরের পৃথিবীর প্রতিধ্বনি। প্রতুল বাবু এই কোনো শব্দকেই তাঁর মস্তিষ্কের ভেতর প্রবেশ করতে দিতেন না। সব শব্দই যেন তাঁর কানের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে যেত, ঠিক প্রখর গ্রীষ্মে তৃষ্ণার্ত মানুষের পাশ দিয়ে যেমন অচেনা এক নদীর স্রোত বয়ে যায়, তার দিকে ফিরেও তাকায় না।
লাবণ্য চলে গেছে প্রায় বিশটা বছর গড়িয়ে। অথচ এই ঘরবাড়ির প্রতিটি ধূলিকণা যেন আজও তার জন্য হাহাকার করে। লাবণ্য, যার উপস্থিতিতে এই ছন্নছাড়া বাড়িতেও প্রাণ ফিরত, যার এক চিলতে হাসিতে প্রতুল বাবুর জীবন রঙিন হয়ে উঠত। কিন্তু লাবণ্যর অনুপস্থিতি যেন বাড়ির প্রতিটি কণাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে, এক অদৃশ্য শোকের চাদরে মুড়ে ফেলেছে সব কিছু।
এখন প্রতুল বাবুর সময় কাটে হয়তো পুরনো খবরের কাগজ নেড়েচেড়ে, যার ভেতরের কোনো খবরই তাঁর মনে ঢেউ তোলে না, কোনো আগ্রহ জাগায় না। নয়তো তিনি একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন জানালার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা পুরনো আম গাছটির দিকে। সেই সবুজ পাতার আড়ালে লুকিয়ে আছে শয়ে শয়ে লাবণ্যর সাথে কাটানো গ্রীষ্ম দুপুরের অলস সময়, বৃষ্টির মাতাল গান, আর শিউলি ফুলের মন ভোলানো মিষ্টি গন্ধ। কিন্তু এখন সে সব স্মৃতি যেন এক পাতলা কুয়াশার চাদরে ঢাকা, স্পর্শ করতে চাইলেও হাতের মুঠোয় আসে না।
একদিন বিকেলে, টিফিন বক্সের পুরনো একটা কৌটো খুঁজতে খুঁজতে প্রতুল বাবু হাতড়ালেন তাঁর লেখার টেবিলের সেই পুরনো ড্রয়ারটা। কাঠের তৈরি ড্রয়ারটা খুললেই একটা ঘষা লাগার পরিচিত শব্দ হতো। তার ভেতর জমে ছিল পুরনো বিলের কাগজ, কালি ফুরিয়ে যাওয়া কিছু অব্যবহৃত কলম, আর কিছু চিঠি, যাদের ঠিকানা মুছে গেছে সময়ের ধুলোয়। হাতড়াতে হাতড়াতে হঠাৎ তাঁর আঙুলে এসে ঠেকল একটা শক্ত, ঠাণ্ডা জিনিস। টেনে বের করলেন – একটা ছোট, চামড়ার বাঁধানো ডায়েরি। বহু পুরনো সেই ডায়েরির পাতাগুলো কালচে হলুদ হয়ে গেছে, আর মলাটের চামড়া স্থানে স্থানে ফেটে গেছে, ঠিক তাঁর হাতের বলিরেখা পড়া চামড়ার মতো। মোটা সুতো দিয়ে সেলাই করা ডায়েরিটির কিছু পাতা এতটাই জীর্ণ যে, প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে ঝুলে আছে।
ডায়েরিটা হাতে নিয়ে প্রতুল বাবু কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। এর অস্তিত্ব তাঁর স্মৃতিতে ছিলো না। কে লিখেছিলো? কী আছে এর ভেতর? একটা মৃদু কৌতূহল তাঁর নিস্তরঙ্গ মনকে সামান্য হলেও নাড়িয়ে দিলো। চশমাটা নাকের ডগায় নামিয়ে সাবধানে একটা পাতা খুললেন। প্রথম লাইনগুলো যেন ঝাপসা, অস্পষ্ট। হাতের লেখাটা কেমন যেনো পরিচিত মনে হলো, কিন্তু ধরতে পারলেন না।
থমকে গেলেন প্রতুল বাবু। ‘তোমার সাথে, প্রতুল…’এই কথাগুলো তাঁর বুকের ভেতর এক অদ্ভুত কম্পন সৃষ্টি করলো। লাবণ্যর গলা! এই তো লাবণ্যর হাতের লেখা! এক নিমেষেই যেন স্মৃতির জমাট বরফ সামান্য গলতে শুরু করলো। এক সময় লাবণ্যর ডায়েরি লেখার অভ্যাস ছিলো, কিন্তু প্রতুল বাবু ভাবতেন সে অভ্যেস লাবণ্যর সাথে সাথেই চিরতরে হারিয়ে গেছে। তিনি এর আগে কোনোদিন এই ডায়েরিটি দেখেননি। এতো বছর ধরে এটা এই ড্রয়ারেই লুকোনো ছিলো? নাকি তিনি ভুলে গেছিলেন?
পৃষ্ঠা উল্টাতে লাগলেন প্রতুল বাবু। প্রতিটি পাতায় লাবণ্যর হাতের স্পর্শ, তার অনুভূতির ছোঁয়া। প্রথম দিকের পাতাগুলো ভরা ছিলো তাদের নববিবাহিত জীবনের উচ্ছল দিনলিপি।
'৯ই ফাল্গুন, ১৩৫২। আজ আমাদের বিয়ে। আকাশের মেঘগুলোও যেনো আনন্দে নেচে উঠছে। প্রতুলের চোখে এক অসীম ভালোবাসা, যা দেখে আমার বুক ভরে যাচ্ছে। আমি জানি, এই পথটা সহজ হবে না, কিন্তু তোমার হাত ধরে আমি সব পার হয়ে যাবো।'
প্রতুল বাবুর চোখ ভিজে উঠলো। লাবণ্যর ভালোবাসা, তার দৃঢ় বিশ্বাস, এই কথাগুলো যেনো তাঁর কানের কাছে ফিসফিস করে উঠলো। তিনি মনে করতে পারলেন সেই ফাল্গুনের দিনটা, যেদিন লাবণ্যর চোখে ছিলো একই রকম ভালোবাসা, একই রকম স্বপ্ন। তখন তিনি এতো ব্যস্ত থাকতেন জীবনের কর্মচক্রে, যে লাবণ্যর অনুভূতিগুলোকে হয়তো ঠিকভাবে অনুভব করার সময় পেতেন না। এখন এই নির্জন বিকেলে, লাবণ্যর নিজের হাতে লেখা কথাগুলো তাকে বিঁধে চলেছে তীক্ষ্ণ তীরের মতো।
তিনি পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা পড়তে লাগলেন। ডায়েরির প্রতিটি পাতায় তাদের জীবনের নানা ঘটনা। প্রতুল বাবুর চাকরির প্রথম দিনের টেনশন, লাবণ্যর প্রথম রান্না করা খিচুড়ির বর্ণনা, যা নাকি সামান্য পুড়ে গিয়েছিলো কিন্তু প্রতুল বাবু খেয়ে বলেছিলেন পৃথিবীর সেরা খাবার। তাদের ছোট্ট ঝগড়া, অভিমান, আর ভালোবাসার পুনর্মিলন। লাবণ্য লিখেছিলো, কিভাবে প্রতুল বাবু গভীর রাতে বাড়ি ফিরে ক্লান্ত শরীরে তার জন্য গান গাইতেন, আর লাবণ্য মুগ্ধ হয়ে শুনতো। প্রতুল বাবু বিস্ময়ে হতবাক হলেন। তিনি কি সত্যিই গান গাইতেন? কবে? তাঁর স্মৃতির ক্যানভাসে এই চিত্রটি একেবারেই অনুপস্থিত ছিলো।
ডায়েরির মাঝামাঝি পাতাগুলোয় দেখা গেলো তাদের সংগ্রামের দিনলিপি। যখন প্রতুল বাবুর চাকরি চলে গিয়েছিল, লাবণ্য কিভাবে তার পাশে ছিলো, তার মনোবল ফিরিয়ে এনেছিলো।
'৪ঠা ভাদ্র, ১৩৬১। প্রতুল খুব ভেঙে পড়েছে। ওর চোখে আমি হতাশার গভীর কালো ছায়া দেখছি। কিন্তু আমি জানি, আমার প্রতুল এত সহজে হার মানবে না। আমি ওর পাশে থাকবো, ওর হাতে হাত রেখে বলবো – আমরা একসঙ্গে সব পেরিয়ে যাবো। আমার বিশ্বাস আছে, এই আঁধার বেশিদিন থাকবে না।'
এই শব্দগুলো প্রতুল বাবুর হৃদয়ে এক গভীর ক্ষত সৃষ্টি করলো। সেই কঠিন দিনগুলোর স্মৃতি তাঁর মনে ফিরে এলো, কিন্তু এতো স্পষ্ট করে লাবণ্যর মানসিক অবস্থা তিনি আগে উপলব্ধি করেননি। তিনি কেবল নিজের হতাশার কথা মনে রেখেছিলেন, লাবণ্যর নীরব আত্মত্যাগ তিনি বুঝতে পারেননি তখন। এখন এই ডায়েরি তাকে লাবণ্যর ভেতরের জগৎটা চিনিয়ে দিচ্ছে।
ডায়েরির শেষ দিকের পাতাগুলো ছিলো লাবণ্যর অসুস্থতার দিনলিপি। যখন প্রতুল বাবু অফিস আর হাসপাতাল নিয়ে দিশেহারা ছিলেন, তখন লাবণ্য ডায়েরিতে লিখেছিলো তার ভেতরের ভয়, তার মনের জোর।
'২২শে বৈশাখ, ১৩৭২। শরীরটা বড় ক্লান্ত লাগছে। প্রতুল সারাদিন আমার পাশে থাকে। ওর চোখে আমি গভীর উদ্বেগ দেখি। আমি জানি, আমি চলে গেলে ওর বড় কষ্ট হবে। কিন্তু জীবন তো নদীর স্রোতের মতো, কখনো থামে না। প্রতুল যেনো একা না থাকে, আমার স্মৃতি যেনো ওকে বেঁধে না রাখে।'
এই লাইনগুলো পড়ে প্রতুল বাবু আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। তাঁর দু'চোখ থেকে অবিরত অশ্রুধারা নেমে এলো। লাবণ্য তার চলে যাওয়ার কথা আগেই জানতো, এবং তাঁর ভবিষ্যতের কথা ভেবে সে শঙ্কিত ছিলো। লাবণ্যর প্রতিটি শব্দে ছিলো তাঁর প্রতি গভীর ভালোবাসা, চিন্তা এবং এক নির্মোহ আত্মত্যাগ। এতদিন প্রতুল বাবু লাবণ্যর মৃত্যুতে নিজেকেই কেবল ভুক্তভোগী ভেবেছিলেন, কিন্তু এখন বুঝতে পারলেন, লাবণ্যও তাঁর জন্য কতটা ভেবে গিয়েছিলো।
ডায়েরিটা বন্ধ করে প্রতুল বাবু ঘরের ভেতর পায়চারি করতে লাগলেন। দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়া ঘরটা যেনো এখন নতুন করে কথা বলছে। প্রতিটি ধূলিকণা যেনো লাবণ্যর স্পর্শে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। তার মনে পড়লো, লাবণ্য কীভাবে প্রতিদিন সকালে ঘরের প্রতিটি জিনিস তার নিজের হাতে পরিষ্কার করতো, কিভাবে পুরনো ভাঙা ফুলদানিতে নতুন ফুল এনে রাখতো। প্রতুল বাবু এতো বছর ধরে কেবল লাবণ্যর শারীরিক অনুপস্থিতি অনুভব করেছেন। কিন্তু আজ এই ডায়েরি তাকে লাবণ্যর আত্মা, তার ভালোবাসা, তার চিন্তা, তার সম্পূর্ণ সত্তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে।
স্মৃতিগুলো যেনো নদীর মতো, কখনও প্রবল বেগে ছোটে, কখনও ধীর গতিতে প্রবাহিত হয়, কিন্তু কোনোদিন থামে না। ডায়েরিটা শেষ করার পর প্রতুল বাবু দেখলেন, দিনের আলো ম্লান হয়ে আসছে। বাইরের পৃথিবীটা শান্ত হয়ে গেছে। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। বারান্দায় গিয়ে বসলেন না, বরং সোজা গেলেন রান্নাঘরের দিকে। বহুদিন পর তিনি নিজের হাতে চা বানালেন। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে তিনি লাবণ্যর লাগানো ছোট্ট তুলসী গাছটার দিকে তাকালেন। তুলসী পাতাগুলো যেনো মৃদু বাতাসে দুলছে, লাবণ্যর মৃদু হাসির মতো।
পরদিন সকালে প্রতুল বাবুর জীবন অন্যরকম ছিলো। তার সকালে আর শূন্যতা ছিলো না। তিনি বারান্দায় বসলেন না, বরং পুরনো অ্যালবামগুলো ঘাঁটতে শুরু করলেন। লাবণ্যর তরুণী বেলার ছবি, তাদের বিয়ের ছবি, ছেলেবেলার প্রতুল – সব ছবিতেই লাবণ্যর চোখে সেই একই ভালোবাসা, যা তিনি ডায়েরির পাতায় পড়েছিলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, স্মৃতির সাথে বাঁচতে হয়। স্মৃতিগুলোই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। এই স্মৃতিগুলো কোনো বোঝা নয়, বরং জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের উজ্জ্বল সাক্ষী।
তিনি ডায়েরিটা সযত্নে নিজের মাথার কাছে রাখলেন। যখনই মনটা এলোমেলো হবে, যখনই শূন্যতা গ্রাস করবে, তখনই তিনি ডায়েরির পাতা উল্টাবেন। এই ডায়েরিটা শুধু লাবণ্যর ব্যক্তিগত অনুভূতির খাতা নয়, এটা যেনো তাদের দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনের এক জীবন্ত দলিল। লাবণ্য তার ভালোবাসাকে শুধু বাস্তবে নয়, শব্দের মাধ্যমেও অমর করে গেছে।
প্রতুল বাবু এখন আর একা নন। লাবণ্যর স্মৃতি, তার ভালোবাসা, তার অস্তিত্ব প্রতিটি মুহূর্তে তার সাথে আছে। তিনি জানালার পর্দা সরিয়ে দিলেন। সকালের রোদ ঝকঝক করে ঘরের ভেতর প্রবেশ করলো। ঘরের প্রতিটি কোণ, প্রতিটি আসবাবপত্র নতুন করে জীবন পেলো। তাঁর নিঃশ্বাসে এক নতুন প্রাণ, তাঁর চোখে এক নতুন দীপ্তি। তিনি হাসলেন। অনেকদিন পর এক নির্মল হাসি। এই হাসি ছিলো জীবনের প্রতি, ভালোবাসার প্রতি এক নতুন বিশ্বাস।
স্মৃতিগুলো ফিসফিস করে বলে, 'আমি আছি, আমি ছিলাম, আমি থাকবো…।' আর প্রতুল বাবু সেই ফিসফিসানি শুনে জীবনের নতুন গান শুনতে পেলেন। তিনি বুঝলেন, ভালোবাসা কোনোদিন শেষ হয় না, কেবল রূপ বদলায়। আর সেই ভালোবাসারই এক নতুন রূপ নিয়ে লাবণ্য বেঁচে আছে তার ডায়েরির প্রতিটি শব্দে, তার হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দনে।
এই ডায়েরি যেন প্রতুল বাবুর মনের বন্ধ কপাটগুলো খুলে দিয়েছে। যে প্রতুল বাবু বহু বছর ধরে নিজেকে এক শূন্য কারাগারে বন্দী করে রেখেছিলেন, আজ তিনি সেই কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তিনি উপলব্ধি করেছেন যে লাবণ্যর চলে যাওয়া মানে তাঁর জীবনের সব কিছুর শেষ হয়ে যাওয়া নয়। বরং লাবণ্য তাঁর জন্য যে ভালোবাসার বীজ বুনে গেছে, সেই বীজ এখন এক মহীরুহে পরিণত হয়েছে, যার শাখা-প্রশাখা প্রতুল বাবুর সমগ্র সত্তাকে আবৃত করে রেখেছে।
তিনি এখন প্রতিদিন কিছু না কিছু নতুন কাজ করার চেষ্টা করেন। হয়তো পুরনো বইপত্র সাজান, লাবণ্যর প্রিয় গাছগুলোর পরিচর্যা করেন, অথবা ছাদে গিয়ে সূর্যাস্তের রং দেখেন। এই ছোট্ট কাজগুলো একসময় তাঁর কাছে অর্থহীন মনে হলেও, এখন সেগুলোতে তিনি এক গভীর শান্তি খুঁজে পান। লাবণ্যর ডায়েরিতে তিনি দেখেছিলেন কিভাবে লাবণ্য ছোট ছোট আনন্দ খুঁজে নিতো, কঠিন পরিস্থিতিতেও হাসির কারণ খুঁজে বের করতো। প্রতুল বাবু এখন সেই পথেই হাঁটতে শুরু করেছেন।
তিনি বুঝতে পারলেন, জীবন আসলে একটি অবিরাম গল্প। আমরা তার কয়েকটি অধ্যায়ের সাক্ষী, কিন্তু গল্পটা চলতে থাকে। লাবণ্যর ডায়েরি তাকে শিখিয়েছে যে জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্তগুলো ছোট ছোট সাধারণ ঘটনার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে। একটি উষ্ণ হাসি, একটি শান্ত দুপুর, প্রিয়জনের হাতের স্পর্শ – এই সব কিছুই জীবনে এনে দেয় গভীর অর্থ। প্রতুল বাবু এখন সেসব অর্থ খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। তিনি আর অতীতের বেদনায় ডুবে থাকেন না। বরং স্মৃতিগুলোকে সম্মান জানিয়ে বর্তমানকে ভালোভাবে বাঁচতে শেখেন।
দিনের শেষে, যখন তারাভরা আকাশ তাঁর জানালার বাইরে এক অচেনা নীরবতা নিয়ে আসে, প্রতুল বাবু ডায়েরিটি হাতে নেন। লাবণ্যর হাতের লেখাগুলো যেনো তারা হয়ে জ্বলে ওঠে। তিনি লাবণ্যর সাথে নীরবে কথা বলেন, নিজেদের পুরনো দিনের গল্প করেন। তিনি জানেন, লাবণ্য হয়তো তাকে শুনতে পাচ্ছে, হয়তো হাসছে। এই নির্জন রাতের নীরবতা এখন আর তাকে একা করে না, বরং লাবণ্যর উষ্ণ উপস্থিতিতে তা ভরে ওঠে।
এই ডায়েরি প্রতুল বাবুর জন্য কেবল এক টুকরো অতীত ছিল না, এটি ছিল একটি সেতু, যা তাঁকে তাঁর নিজের হৃদয়ের গভীরে লুকিয়ে থাকা এক অন্য প্রতুল বাবুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। যে প্রতুল বাবু ভালোবাসতে ভুলে গিয়েছিলেন, জীবনকে উদযাপন করতে ভুলে গিয়েছিলেন, সেই প্রতুল বাবুকে আবার খুঁজে পেয়েছে এই ডায়েরি। লাবণ্যর ভালোবাসা, তার আত্মত্যাগ এবং তার গভীর বিশ্বাস যেনো তাঁর জীবনের প্রতিটি ধূলিকণাকে আবার জীবিত করে তুলেছে।
প্রতুল বাবু এখন জানেন, স্মৃতির ফিসফিসানি কেবল অতীতকে নয়, বর্তমানকেও সুন্দর করে তোলে, আর ভবিষ্যতের পথ আলোকিত করে।
স্মৃতি, শোক, পুনরুজ্জীবন, হারানো ভালোবাসা, একাকীত্ব, জীবন, ডায়েরি, সম্পর্ক, মানবীয় স্পর্শ।
🌸 আপনার মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ!
আপনার মতামত আমাদের অনুপ্রাণিত করে এবং আগামীতে আরও মানসম্পন্ন কনটেন্ট তৈরিতে সহায়তা করে।
আপনি যদি কোনো নির্দিষ্ট বিষয় বা গল্প পছন্দ করে থাকেন, জানালে ভালো লাগবে।
নিয়মিত পাশে থাকুন — আপনার সহযোগিতা ও ভালোবাসাই আমাদের এগিয়ে চলার শক্তি।
শুভ কামনায়,
✍️ কল্পকথা-৩৬০ ব্লগ টিম
https://kalpakatha360.blogspot.com