কখনো কখনো জীবন এমন এক বাঁকে এসে দাঁড়ায়, যেখানে চারদিক নিস্তব্ধ, অনড়, শূন্য যেন কোনো দরজা খোলা নেই। বাতাস থমকে যায়, পরিচিত মুখগুলোও যেন হয়ে ওঠে অচেনা। এমন সময়ে বুকের ভেতর জন্ম নেয় এক অজানা হাহাকার, এক নিঃশব্দ আর্তনাদ "এবার বুঝি সবই শেষ।"
এই অনুভব শুধু আপনার একার নয়। পৃথিবীর প্রতিটি কোণায়, প্রতিটি হৃদয়ে কখনো না কখনো এই প্রশ্ন জাগে আলো কি আর আসবে?
এই লেখাটি ঠিক সেই অন্ধকার সময়ের কথা বলে। এখানে কোনো শুকনো উপদেশ নেই, নেই ঠোঁটস্থ ফর্মুলা। বরং রয়েছে বাস্তব জীবনের গল্প, নিঃশ্বাসের মতো সত্য কিছু অনুভব, আর তিনটি চিরন্তন আলোর দিকচিহ্ন ধৈর্য (সবর), ভরসা (তাওয়াক্কুল) এবং আল্লাহর রহমত।
এই তিনটি শব্দ একসাথে মিলে তৈরি করে এক অন্তর্জাগতিক শক্তি, যা ঝড়ের মধ্যেও দাঁড়িয়ে থাকার সাহস দেয়, কষ্টের মধ্যেও আশার আলো জ্বেলে দেয়।
লেখাটি আপনাকে শুধু মনে করিয়ে দেবে না যে আপনি একা নন, বরং তা আপনাকে হাতে ধরে এমন এক যাত্রায় নিয়ে যাবে যেখানে জীবনের হারিয়ে ফেলা অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়, যেখানে কান্না থেকে জন্ম নেয় নতুন লক্ষ্য, আর যেখানে পরাজয়ের ছায়ার মধ্যেও দেখা যায় আলোর রেখা।
এই লেখাটি হৃদয়ের কথা, রক্ত-মাংসের মানুষের কথা। যারা লড়ছে, যারা অপেক্ষা করছে, যারা থেমে গিয়েও আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে।
আসুন, আমরা একসাথে হাঁটি। এই লেখার প্রতিটি শব্দে আপনি হয়তো নিজের গল্প খুঁজে পাবেন। আর যদি খুঁজে না পান, তবুও এই কথা যেন মনে রাখেন আল্লাহর করুণার দরজা কখনো বন্ধ হয় না।
আমরা সবাই জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে এমন এক দেয়ালের সামনে এসে দাঁড়াই, যেখানে মনে হয় সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই। চারপাশের পৃথিবীটা হঠাৎ করে অচেনা হয়ে যায়, চেনা মানুষগুলোও যেন দূরের ছায়া। চাকরিটা চলে গেছে, ব্যবসায় বিশাল ক্ষতি হয়েছে, পরীক্ষায় বছরের পর বছর ধরে অকৃতকার্য হচ্ছি, কাছের কোনো মানুষ মারাত্মক অসুস্থ অথবা চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে কারণটা যা-ই হোক না কেন, বুকের ভেতর একটা শূন্যতা আর হাহাকার তৈরি হয়। মনে হয়, এই বুঝি সব শেষ। এই অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় কি আদৌ কোনো আলো আছে?
এই কঠিন সময়গুলোতে একজন বিশ্বাসী মানুষের আত্মার সবচেয়ে বড় শক্তি তিনটি ধৈর্য (সবর), ভরসা (তাওয়াক্কুল), এবং আল্লাহর রহমত (করুণা)। এই তিনটি শুধু শব্দ নয়, বরং এগুলো হলো এমন এক ঐশ্বরিক বর্ম যা আমাদের সবচেয়ে কঠিন সময়েও ভেঙে পড়তে দেয় না। চলুন, আজ এই বিষয়গুলো নিয়ে একটু গভীরভাবে কথা বলি, একেবারে বন্ধুর মতো, আমাদের নিজেদের ভাষায়, কিছু চেনা গল্পের আয়নায় নিজেদের মুখ দেখে।
আমাদের সমাজে ‘ধৈর্য’ বা ‘সবর’ শব্দটা শুনলেই চোখে ভেসে ওঠে এক অসহায়, নীরব মানুষের ছবি, যে নীরবে সবকিছু সহ্য করে যাচ্ছে। কিন্তু ইসলামে সবরের ধারণা এর চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী এবং সক্রিয়। সবর মানে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা নয়, বরং প্রতিকূলতার মাঝেও নিজের নৈতিকতা, বিশ্বাস এবং প্রচেষ্টা ধরে রাখা।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
"হে ঈমানদারগণ! তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।" (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৫৩)
এই আয়াতে আল্লাহ কিন্তু বলেননি যে, "ধৈর্য ধরো, আমি তোমাদের সব সমস্যা এক মুহূর্তে গায়েব করে দেব।" বরং তিনি বলেছেন, তিনি ধৈর্যশীলদের "সঙ্গে আছেন"। একবার ভেবে দেখুন, মহাবিশ্বের অধিপতি স্বয়ং আপনার সঙ্গে থাকার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন এর চেয়ে বড় আশ্বাস আর কী হতে পারে?
১. প্রথম আঘাতেই ধৈর্য: কোনো বিপদ বা দুঃসংবাদ শোনার সাথে সাথেই যে মানসিক স্থিতি বজায় রাখা, সেটাই আসল সবর। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, "প্রকৃত ধৈর্য হলো বিপদের প্রথম আঘাতেই ধৈর্যধারণ করা।" (সহীহ বুখারী)। হুট করে মেজাজ হারিয়ে ফেলা, ভাগ্যকে দোষারোপ করা বা আল্লাহর ওপর অভিমান করে বসা এগুলো সবরের পরিপন্থী। প্রথম ধাক্কাটা সামলে নিতে পারাটাই হলো পরীক্ষার প্রথম ধাপ।
২. সক্রিয় প্রচেষ্টা: ধরুন, আপনার চাকরি নেই। এখানে সবর মানে এই নয় যে আপনি জায়নামাজে বসে শুধু দোয়া করবেন আর আশা করবেন একদিন কোনো কোম্পানির এইচআর আপনাকে ফোন দেবে। না! এখানে সবর হলো প্রতিদিন নতুন করে জীবনবৃত্তান্ত তৈরি করা, বিভিন্ন জায়গায় আবেদন করা, নিজের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য চেষ্টা করা, এবং এই পুরো প্রক্রিয়া চলাকালীন হতাশ না হয়ে আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রাখা। চেষ্টা আপনার কাজ, ফলাফল আল্লাহর হাতে। এই চেষ্টাটুকু ধরে রাখাই সবরের অংশ।
ঢাকার এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে নাহিয়ান। ভালো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে তার চোখে ছিল অনেক স্বপ্ন। কিন্তু বাস্তবতা ছিল কঠিন। এক মাস, দুই মাস, ছয় মাস... প্রায় দেড় বছর কেটে গেল, কিন্তু ভালো কোনো চাকরি হলো না। এর মধ্যে তার বন্ধুরা কেউ কেউ ভালো চাকরিতে ঢুকেছে, কেউ বিয়ে করে ফেলেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বন্ধুদের সাফল্যের ছবি দেখে তার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠত। আত্মীয়স্বজনদের প্রশ্ন, "কী করছিস এখন?" তীরের মতো বিঁধত। রাতে ঘুম আসত না, নিজের যোগ্যতার ওপর থেকেই বিশ্বাস উঠে যাচ্ছিল।
নাহিয়ান প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু তার মা তাকে একটা কথা মনে করিয়ে দিলেন, "বাবা, আল্লাহ তোকে পরীক্ষা করছেন। ধৈর্য ধর, কিন্তু বসে থাকিস না।" নাহিয়ান নতুন করে ভাবল। সে শুধু চাকরির পেছনে না ছুটে নিজের দুর্বলতাগুলো খুঁজে বের করল। কিছু অনলাইন কোর্স করে নিজের দক্ষতা বাড়াল। ছোট একটা কল সেন্টারে কাজ নিল, শুধু অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য। প্রতিদিন ফজরের পর সে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইত। সে বলত, "আল্লাহ, আমি আমার চেষ্টা করছি, বাকিটা তোমার ইচ্ছা।"
প্রায় দুই বছর পর, এমন এক জায়গা থেকে তার চাকরির ডাক এলো, যা সে কল্পনাও করেনি। যে ছোট কল সেন্টারের কাজটাকে সে গুরুত্ব দেয়নি, সেখানকার অভিজ্ঞতাই তার নতুন চাকরির সাক্ষাৎকারে সবচেয়ে কাজে লেগেছিল। নাহিয়ান সেদিন বুঝেছিল, সবর মানে শুধু অপেক্ষা করা নয়। সবর হলো, চেষ্টার মাঠে নিজের সেরাটা দিয়ে দৌড়ানো, भलेই ফিনিশিং লাইনটা তখনো চোখে দেখা না যায়।
৩. কথাবার্তায় সংযম: কঠিন সময়ে আমাদের মুখ থেকে অনেক আজেবাজে কথা বেরিয়ে যেতে পারে। আমরা অন্যের কাছে নিজেদের কষ্ট এমনভাবে বর্ণনা করি, যা শুনে মনে হয় আমরা আল্লাহর সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট। সবর মানে হলো, নিজের জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণ করা। মানুষের কাছে অভিযোগের ঝাঁপি খুলে না বসে, নিজের কষ্টের কথাগুলো জায়নামাজে আল্লাহকে বলুন। তিনিই তো সর্বোত্তম শ্রোতা।
সবর হলো একটি মরিচা না পড়া ঢালের মতো। বাইরের আঘাত আসবেই, কিন্তু এই ঢাল আপনাকে ভেতর থেকে ভেঙে যেতে দেবে না। এটা সাময়িক কষ্টকে স্বীকার করে, কিন্তু স্থায়ী হতাশা থেকে আপনাকে রক্ষা করে।
দ্বিতীয় স্তম্ভ: ভরসা বা ‘তাওয়াক্কুল’ নিজের সেরাটা দিয়ে বাকিটা আল্লাহর ওপর ছেড়ে দেওয়া
ধৈর্য আর ভরসা একে অপরের হাত ধরে চলে। শুধু ধৈর্য ধরে থাকলেই হয় না, মনে এই বিশ্বাসও রাখতে হয় যে, যাঁর জন্য ধৈর্য ধরেছি, তিনি কখনো আমার অমঙ্গল করবেন না। এটাই হলো ‘তাওয়াক্কুল’ বা আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা।
তাওয়াক্কুলের সবচেয়ে সুন্দর উদাহরণগুলোর একটি হলো হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর ঘটনা। যখন নমরুদের সৈন্যরা তাঁকে আগুনে নিক্ষেপ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন ফেরেশতারা তাঁর কাছে এসে সাহায্যের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি উত্তরে বলেছিলেন, "আমার জন্য আমার আল্লাহই যথেষ্ট, তিনি কতই না উত্তম কর্মবিধায়ক!" তিনি তাঁর সাধ্যমতো সত্যের দাওয়াত দিয়েছেন, বাকিটা আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। ফলাফল? আল্লাহ আগুনকে নির্দেশ দিলেন, "হে আগুন, তুমি ইবরাহিমের জন্য শীতল ও শান্তিদায়ক হয়ে যাও।"
অনেকে মনে করে, তাওয়াক্কুল মানে হলো কোনো চেষ্টা না করে ভাগ্যের ওপর সব ছেড়ে দেওয়া। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এক ব্যক্তি এসে জিজ্ঞেস করেছিল, "আমি কি আমার উটটিকে না বেঁধে আল্লাহর ওপর ভরসা করব?" তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, "আগে উটের দড়ি বাঁধো, তারপর আল্লাহর ওপর ভরসা করো।" (তিরমিযি)
এর মানে হলো
আপনার অংশটুকু আপনাকে করতে হবে: একজন ছাত্রের কাজ হলো ভালোভাবে পড়াশোনা করা। একজন কৃষকের কাজ হলো জমিতে বীজ বপন করা ও পরিচর্যা করা। একজন অসুস্থ ব্যক্তির কাজ হলো ভালো ডাক্তারের কাছে যাওয়া এবং ঔষধ সেবন করা। এটা হলো "উটের দড়ি বাঁধা"।
ফলাফলের জন্য আল্লাহর ওপর নির্ভর করা: আপনার সর্বোচ্চ চেষ্টার পর পরীক্ষার ফলাফল কী হবে, ফসল কেমন ফলবে, বা রোগ থেকে মুক্তি মিলবে কি না সেটা পুরোপুরি আল্লাহর হাতে। এই বিশ্বাসটুকুই হলো তাওয়াক্কুল।
সুমাইয়া একজন গৃহিণী। তার স্বামী সামান্য বেতনে চাকরি করেন। দুই সন্তানকে ভালো স্কুলে পড়ানোর স্বপ্ন দেখেন তিনি। নিজের জমানো কিছু টাকা দিয়ে ঘরে বসে কেক বানানোর একটা অনলাইন ব্যবসা শুরু করলেন। সেরা উপকরণ দিয়ে, অনেক যত্ন করে কেক বানাতেন। ছবি তুলে পেইজে দিতেন। কিন্তু প্রথম কয়েক মাস তেমন কোনো অর্ডার ছিল না। যা দু-একটা অর্ডার আসত, তা দিয়ে খরচের টাকাও উঠত না।
একদিন ৫০ জনের জন্য একটা বড় অর্ডার এলো। সুমাইয়া খুশিতে আত্মহারা। সারা রাত জেগে কেক বানালেন। কিন্তু ডেলিভারির ঠিক আগে ক্লায়েন্ট ফোন করে অর্ডারটা বাতিল করে দিল। সুমাইয়ার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। তার সব পরিশ্রম, সব টাকা জলে গেল। তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন। সেদিন রাতে নামাজে দাঁড়িয়ে তিনি আল্লাহকে বললেন, "হে আল্লাহ, আমি তো আমার চেষ্টার কোনো কমতি রাখিনি। কেন এমন হলো? নিশ্চয়ই এর মধ্যে কোনো কল্যাণ আছে যা আমি জানি না। আমি তোমার ওপরই ভরসা করলাম।"
কয়েকদিন পর, বাতিল হওয়া কেকগুলো তিনি প্রতিবেশী আর এতিমখানায় বিলিয়ে দিলেন। যারা কেক খেল, তারা সবাই তার কেকের অসাধারণ স্বাদের প্রশংসা করতে লাগল। মুখে মুখে তার নাম ছড়িয়ে পড়ল। এক সপ্তাহের মধ্যে তিনি এতগুলো নতুন অর্ডার পেলেন, যা তার গত তিন মাসের মোট বিক্রির চেয়েও বেশি। পরে তিনি জানতে পারেন, যে ক্লায়েন্ট অর্ডার বাতিল করেছিল, সে আসলে একজন প্রতারক ছিল এবং টাকা দেওয়ার কোনো ইচ্ছাই তার ছিল না।
সুমাইয়া সেদিন বুঝেছিলেন, তাওয়াক্কুলের অর্থ। নিজের সেরাটা দিয়ে আল্লাহর ওপর ভরসা করলে, তিনি সাময়িক ক্ষতি থেকে বাঁচিয়ে এমন পথ খুলে দেন, যা আমরা কল্পনাও করতে পারি না।
যখন আপনি নিজের সেরাটা দিয়ে বাকিটা আল্লাহর হাতে সঁপে দেন, তখন এক অবিশ্বাস্য মানসিক শান্তি অনুভব করবেন। কারণ তখন ব্যর্থতার ভয় আপনাকে স্থবির করে দেবে না। আপনি জানেন, আপনার চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না। এখন আল্লাহ যে সিদ্ধান্ত নেবেন, সেটাই আপনার জন্য সেরা।
যখন আপনি ধৈর্য আর ভরসার পথ ধরে হাঁটেন, তখন আপনি আল্লাহর রহমতের ছায়াতলে আশ্রয় নেন। আল্লাহর রহমত বা করুণা এমন এক মহাসাগর, যার কোনো কূল-কিনারা নেই। আমাদের হতাশা, কষ্ট আর সমস্যাগুলো যতই বড় হোক না কেন, আল্লাহর রহমতের কাছে তা খুবই তুচ্ছ।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ আমাদের আশার বাণী শুনিয়েছেন:
"বলো, ‘হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজেদের ওপর বাড়াবাড়ি করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেন। তিনি তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’" (সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৫৩)
এই আয়াতটি শুধু পাপ মোচনের জন্য নয়, বরং জীবনের সব হতাশার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আল্লাহ বলছেন, "নিরাশ হয়ো না!"
রহমত কীভাবে আসে?
আল্লাহর রহমত সবসময় আমাদের প্রত্যাশিত পথে আসে না। আমরা যা চাই, তিনি হয়তো হুবহু তা দেন না, কিন্তু তিনি যা দেন, তা আমাদের প্রয়োজনের জন্য সবচেয়ে সেরা।
রফিক সাহেব তার স্ত্রীকে খুব ভালোবাসতেন। দীর্ঘ ৩৫ বছরের সংসার ছিল তাদের। হঠাৎ করেই তার স্ত্রী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন। রফিক সাহেবের পৃথিবীটা যেন থেমে গেল। যে ঘরটা স্ত্রীর হাসিতে মুখর থাকত, সেই ঘরের দেয়ালগুলো তাকে খেতে আসত। ছেলেমেয়েরা নিজেদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। একাকিত্ব আর কষ্ট তাকে গ্রাস করে ফেলল। তিনি নামাজ পড়তেন, কিন্তু মনে শান্তি পেতেন না। তার শুধু একটাই প্রশ্ন ছিল, "আল্লাহ, আমার কাছ থেকে আমার সবকিছু কেন কেড়ে নিলে?"
একদিন তিনি তার স্ত্রীর পুরনো জিনিসপত্র গোছাতে গিয়ে একটা ডায়েরি পেলেন। সেখানে তার স্ত্রী লিখে রেখেছিলেন, "আমার সবচেয়ে বড় ইচ্ছা, আমাদের এলাকার গরিব মেয়েদের জন্য একটা সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলা, যাতে তারা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে।" রফিক সাহেব লেখাটা পড়ে অনেকক্ষণ কাঁদলেন। তারপর তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, স্ত্রীর এই শেষ ইচ্ছাটা তিনি পূরণ করবেন।
তিনি তার পেনশনের সব টাকা দিয়ে একটা ছোট প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুললেন। সারাদিন তিনি সেখানেই কাটাতেন। মেয়েদের হাসি-আনন্দে তার নিজের ভেতরের শূন্যতাটা একটু একটু করে পূরণ হতে লাগল। তিনি দেখলেন, তার স্ত্রীর ভালোবাসা শুধু তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তা ছড়িয়ে পড়েছিল আরও অনেক মানুষের মধ্যে। তিনি আল্লাহর রহমতকে এক নতুন রূপে দেখতে পেলেন। রহমত মানে হারিয়ে যাওয়া মানুষকে ফিরে পাওয়া নয়, বরং তার রেখে যাওয়া ভালোবাসাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার নতুন একটা অর্থ খুঁজে পাওয়া। এই কাজের মাধ্যমে তিনি তার স্ত্রীর জন্য সদকায়ে জারিয়ার ব্যবস্থা করলেন এবং নিজের জন্যও খুঁজে পেলেন এক অনাবিল শান্তি।
আল্লাহর রহমত এমনই। কখনো তা আসে দোয়ার তাৎক্ষণিক কবুলিয়াতের মাধ্যমে, কখনো আসে ভিন্ন কোনো রূপে যা আমাদের জন্য আরও বেশি কল্যাণকর, আবার কখনো আসে বিপদের মাধ্যমে আমাদের পরিশুদ্ধ করে আরও শক্তিশালী করে তোলার জন্য।
ধৈর্য, ভরসা ও আল্লাহর রহমত এই তিনটি বিষয় আসলে একটি আরেকটির সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত।
আপনি ধৈর্য ধারণ করেন কারণ আপনার মনে আল্লাহর ওপর ভরসা আছে। আর যখন আপনি এই দুটিকে আঁকড়ে ধরেন, তখন আপনি আল্লাহর রহমতের জন্য নিজেকে যোগ্য করে তোলেন। আবার, যখন আপনি আল্লাহর রহমত দেখতে পান, তখন আপনার ধৈর্য ও ভরসা আরও বেড়ে যায়। এটি একটি চক্রাকার সফর, যা একজন বিশ্বাসীর জীবনকে অর্থবহ এবং শান্তিময় করে তোলে।
তাই পরেরবার যখন জীবনের রাস্তায় নিজেকে একা ও অসহায় মনে হবে, যখন চারদিকে অন্ধকার দেখবেন, তখন এই তিনটি কথা মনে রাখবেন:
১. ধৈর্য ধরুন: নাহিয়ানের মতো সক্রিয়ভাবে চেষ্টা চালিয়ে যান এবং শান্ত থাকুন। মনে রাখবেন, আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।
২. ভরসা করুন: সুমাইয়ার মতো নিজের সেরাটা দিয়ে ফলাফল আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিন। বিশ্বাস রাখুন, তাঁর পরিকল্পনা আপনার কল্পনার চেয়েও উত্তম।
৩. রহমতের আশা করুন: রফিক সাহেবের মতো করে ভাবুন। কখনো নিরাশ হবেন না। আল্লাহর করুণার দরজা সবসময় খোলা। ভোরের আলো ফোটার আগে রাত সবচেয়ে অন্ধকার হয়। আপনার জীবনের এই অন্ধকার সময়টাও হয়তো এক সুন্দর ভোরের পূর্বাভাস।
জীবন নামের এই সফরে ঝড় আসবে, ঢেউ আসবে, পথ হারানোর ভয়ও থাকবে। কিন্তু আপনার হাতে যদি ধৈর্য, ভরসা আর রহমতের আশার এই তিনটি বাতি থাকে, তবে আপনি নিশ্চিতভাবেই সেই মঞ্জিলে পৌঁছাতে পারবেন, যেখানে রয়েছে অফুরন্ত শান্তি ও পুরস্কার।
মানুষের জীবন চিরদিন সমতল থাকে না। কখনো তা শীতল নদীর মতো শান্ত, আবার কখনো তা উত্তাল সমুদ্রের মতো প্রচণ্ড। এই লেখাটি ঠিক সেই সময়ের জন্য যখন জীবন ক্লান্ত, মন বিষণ্ন, দৃষ্টি অস্পষ্ট। যেখানে সামনে কোনো পথ খোলা নেই বলে মনে হয়, আর ভেতরের আলোটাও নিভে যাওয়ার উপক্রম।
কিন্তু পাঠক, আপনি যদি এই লেখার প্রতিটি শব্দের গভীরে তাকান, তাহলে দেখবেন এখানে কেবল কষ্টের কাহিনি নেই, আছে আশা; আছে বিপদের মধ্যেও টিকে থাকার গল্প; আছে নিঃস্ব হয়ে পড়েও ভেঙে না পড়ার উদাহরণ।
আমরা চাই, এই কথাগুলো আপনার অন্তরে গিয়ে ঠেকে। আপনি যদি জীবনের কোনো কঠিন সময় পার করে থাকেন বা এখনো সেই আঁধারে দাঁড়িয়ে থাকেন, তাহলে আমরা বলতে চাই আপনি একা নন।
আপনার সঙ্গে রয়েছে সেইসব মানুষ, যারা চোখের জলে নয়, হৃদয়ের দীপ্তিতে বেঁচে থাকার মানে খুঁজে নিয়েছে।
পরিশেষে বলি, আমাদের এই অস্থির সময়ে এ রকম লেখা শুধু পাঠের নয়, বরং চিন্তা, চর্চা ও আত্মোপলব্ধির অনুপ্রেরণা হয়ে উঠুক। আপনি যদি এ আলো নিজের মাঝে খুঁজে পান, তবে তা অন্যদের মাঝেও ছড়িয়ে দিন। কারণ, কিছু কিছু আলো নিজে জ্বলে না জ্বলে ওঠে এক হৃদয় থেকে আরেক হৃদয়ে ছড়িয়ে পড়ে।
আশা বাঁচিয়ে রাখুন। কারণ রাত যতই অন্ধকার হোক, তার পরেই ভোর হয়।
প্রিয় পাঠক, কখনো কি নিজেকে এমন এক মোহভঙ্গ মুহূর্তে আবিষ্কার করেছেন, যখন মনে হয়েছে সবকিছু শেষ?
আপনার কষ্টগুলো কি কখনো এতটাই ভারী হয়ে উঠেছে, যে কোনো শব্দই হালকা মনে হয়েছে?
কখনো কি মনে হয়েছে আপনার দুঃখের গল্প হয়তো কেউই বুঝবে না?
কিন্তু প্রশ্ন হলো আপনি কি এখনও ধৈর্যের শক্তিকে অবলম্বন করতে পারছেন?
আপনি কি এখনও বিশ্বাস রাখতে পারছেন, যে আপনার চেষ্টা বৃথা যাবে না?
আপনি কি এখনও বিশ্বাস করেন, আল্লাহর করুণা আপনার জন্য অপেক্ষা করছে, হয়তো এক ভিন্ন রূপে?
জীবনের প্রতিটি সংকট আমাদের সামনে এমন কিছু প্রশ্ন তোলে, যেগুলোর উত্তর সহজ নয় কিন্তু প্রয়োজনীয়।
এটি বলে না যে আপনি কষ্টে নেই, বরং বলে আপনার কষ্টটাই আপনাকে গড়ে তুলতে পারে, যদি আপনি ধৈর্য ধরেন, ভরসা রাখেন, এবং আল্লাহর করুণার পথটা খোলা রাখেন।
তাই আজ, আপনি নিজেকে জিজ্ঞেস করুন
আমি কি শুধু বেঁচে আছি, নাকি বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে আছি?
আমি কি কেবল অপেক্ষা করছি, নাকি সচেষ্ট সবরের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছি?
আমি কি এখনো আল্লাহর রহমতের আশায় বুক বাঁধতে পারি?
প্রিয় পাঠক, মনে রাখবেন এই প্রশ্নগুলো আপনার আজকের রাতটাকে হয়তো আলোকিত করে তুলবে।
আর যদি আলোর কোনো রেখাও না দেখেন, তাহলে অন্তত এটুকু ভরসা রাখুন আলো আছে। আপনি শুধু এখনও তা দেখতে পাননি।
আমরা সবাই জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে হেরে যাই। কিন্তু সেই হেরে যাওয়ার মুহূর্তগুলোতেও যদি আমরা নিজেকে প্রশ্ন করতে পারি, যদি ভেতরের বিশ্বাসটাকে হারিয়ে না ফেলি তবে বিজয়ের গল্প খুব বেশি দূরে থাকে না।
আসুন, আমরা প্রত্যেকে নিজের জীবনে সেই তিনটি বাতি জ্বালিয়ে রাখি
ধৈর্য, ভরসা, আর আল্লাহর অশেষ রহমতের প্রতি অটুট আশাবাদ।
আপনি প্রস্তুত তো, নিজেকে নতুন করে চিনে নেওয়ার জন্য?
ধৈর্য, সবর, ভরসা, তাওয়াক্কুল, আল্লাহর রহমত, ইসলামিক অনুপ্রেরণা, জীবন, বিশ্বাস।
🌸 আপনার মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ!
আপনার মতামত আমাদের অনুপ্রাণিত করে এবং আগামীতে আরও মানসম্পন্ন কনটেন্ট তৈরিতে সহায়তা করে।
আপনি যদি কোনো নির্দিষ্ট বিষয় বা গল্প পছন্দ করে থাকেন, জানালে ভালো লাগবে।
নিয়মিত পাশে থাকুন — আপনার সহযোগিতা ও ভালোবাসাই আমাদের এগিয়ে চলার শক্তি।
শুভ কামনায়,
✍️ কল্পকথা-৩৬০ ব্লগ টিম
https://kalpakatha360.blogspot.com