শহরের রাতকে কেবল অন্ধকার দিয়ে মাপা যায় না। নিয়ন আলোয় ভেসে থাকা সোনালি-রূপালি ঝলক, রাস্তায় ছুটে চলা হেডলাইট, ফুটপাথে নিঃশব্দে পা ফেলা ছায়ারা সব মিলিয়ে রাত যেন এক বিশাল ক্যানভাস, যেখানে আঁকা আছে অগণিত মানুষের না-বলা গল্প। দিনের কোলাহল যখন থেমে যায়, সেই নীরবতার ভেতরে শুরু হয় এক ভিন্ন খেলা যুদ্ধ, যা অস্ত্রের নয়, বরং টিকে থাকার, শ্বাস নেওয়ার, আর স্বপ্ন আঁকড়ে রাখার লড়াই।
এই শহরের রাত যেন গোপন নাট্যমঞ্চ, যেখানে প্রত্যেকেই নিজের চরিত্রে অভিনয় করছে কেউ একাকীত্বের বিরুদ্ধে, কেউ দারিদ্র্যের, কেউ ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার বিরুদ্ধে, আবার কেউ শুধু আরেকটা দিনের ভোর দেখার জন্য। জানালার আড়ালে, ফাঁকা রাস্তায়, হাসপাতালের ওয়ার্ডে, কিংবা ফুটপাথের ঠাণ্ডা বাতাসে প্রতিটি কোণে লুকিয়ে আছে এক অদৃশ্য যুদ্ধক্ষেত্র। আর আমরা, দিনের আলোয় যারা এই লড়াই দেখি না, রাতের গভীরে কান পাতলেই হয়তো শুনতে পাব সেই নীরব যুদ্ধের প্রতিধ্বনি যা আসলে মানুষের বেঁচে থাকার অদম্য গল্প।
শহরের রাতের রঙ কী? কেউ বলবে কালো, কেউ ধূসর, আবার কেউ হয়তো বলবে নিয়নের আলোয় মাখা সোনালি-রূপালি। কিন্তু যারা শহরের রাতকে কাছ থেকে দেখেছে, তারা জানে শহরের রাতের রঙ আসলে অসংখ্য মানুষের না বলা গল্পের প্রতিচ্ছবি। নীরবতার এক অদ্ভুত ক্যানভাস, যেখানে প্রতিটি মুহূর্ত যেন এক নতুন অধ্যায়, এক নতুন যুদ্ধক্ষেত্রের প্রস্তুতি। দিনের আলোর ঝলকানি আর কোলাহল যখন থমকে যায়, ঠিক তখনই শুরু হয় এক ভিন্ন খেলা, এক নীরব যুদ্ধ।
রাতের শহর এক অন্যরকম সত্তা নিয়ে জেগে ওঠে। দিনের ব্যস্ততা, যানজট, মানুষের ছোটাছুটি সবকিছু মিলিয়ে যায় এক রহস্যময় আবরণে। কিন্তু এই আপাত শান্ত, নিস্তব্ধতার গভীরে লুকিয়ে থাকে অসংখ্য সংগ্রাম, অজস্র না বলা কাহিনি। প্রতিটি জানালায় জ্বলে থাকা আলো, প্রতিটি গাড়ির হেডলাইট, প্রতিটি ফুটপাতে হেঁটে চলা ছায়া প্রত্যেকের পেছনে আছে এক লুকানো যুদ্ধ, যা আমরা দিনের আলোয় হয়তো দেখতে পাই না।
এ যুদ্ধ শুধু অস্ত্র বা বোমার নয়, এ যুদ্ধ টিকে থাকার, স্বপ্ন দেখার, আর কখনো কখনো শুধু নিঃশ্বাস নেওয়ার। এ যুদ্ধ মনের সাথে মনের, ইচ্ছার সাথে পরিস্থিতির, আলোর সাথে অন্ধকারের। রাতের শহর যেন এক বিশাল মঞ্চ, যেখানে হাজারো অভিনেতা নীরবে তাদের নিজস্ব নাটকের মহড়া দেয়। কেউ লড়ছে একাকীত্বের বিরুদ্ধে, কেউ দারিদ্র্যের, কেউ অসুস্থতার, আবার কেউ শুধু একটি ভালো ঘুমের জন্য।
রাতের নীরবতা যেন একাকীত্বের সবচেয়ে বড় বন্ধু। দিনের ব্যস্ততায় আমরা চারপাশে মানুষ দিয়ে নিজেদের ঘিরে রাখি, ভুলে থাকার চেষ্টা করি ভেতরের শূন্যতা। কিন্তু রাত নামলেই সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে অচেনা সব মুখ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভেসে আসে আনন্দময় জীবনের ছবি, আর নিজের ঘরের কোণটা হঠাৎ বড্ড খালি মনে হয়।
মিজান সাহেব, বছর ষাটের এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। দিনের বেলা তাঁর ঘরে ছাত্রছাত্রীদের আনাগোনা থাকে, সকালের খবরের কাগজ আর টিভির সিরিয়ালে সময় কাটে। কিন্তু রাত বাড়লেই ঘরের দেয়ালগুলো যেন আরও কাছাকাছি চলে আসে। স্ত্রী নেই, ছেলেমেয়েরা বিদেশে। এক গ্লাস জল নিয়ে জানালার পাশে বসে আকাশ দেখেন। তার মনে পড়ে যায় পুরনো দিনের কথা, হাসি-ঠাট্টার দিনগুলো। এই শহরে তাঁর হাজারো ছাত্র আছে, অনেক পরিচিত মানুষ আছে, কিন্তু রাতের এই প্রহরটা তাঁকে একাকীত্বের শীতল চাদরে মুড়ে রাখে। তার যুদ্ধ শুধু একাকীত্বের বিরুদ্ধে নয়, সময়ের বিরুদ্ধেও। মনে হয় যেন প্রতিটি সেকেন্ডই এক একটি বুলেট হয়ে তার দিকে ছুটে আসছে।
অন্যদিকে, রূপা, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। দূর শহরে মা-বাবাকে ছেড়ে এসেছে এক নতুন স্বপ্ন নিয়ে। দিনের বেলা ক্লাসের বন্ধুদের সাথে আড্ডা, নতুন আইডিয়া নিয়ে আলোচনা, ক্যাফেতে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা খুনসুটি সবকিছু মিলিয়ে দারুণ কাটছে। কিন্তু হোস্টেলের রুমে, গভীর রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, তখন মোবাইল ফোনের স্ক্রিনটাই হয়ে ওঠে তার একমাত্র সঙ্গী। মা-বাবার সাথে ভিডিও কলে কথা শেষ হওয়ার পর বুকটা কেমন জানি খালি খালি লাগে। শহরে আসার পর থেকেই সে এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে। পড়াশোনার চাপ, নতুন বন্ধুত্বের টানাপোড়েন, আর এক অজানা ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা সবকিছু মিলেমিশে তাকে রাতের বেলায় নির্ঘুম করে তোলে। এই একাকীত্ব, এই শূন্যতা, এটাই তার নীরব যুদ্ধ।
রাতের শহর আরও এক ধরনের যোদ্ধাদের আশ্রয় দেয় যারা দিনের বেলায়ও লড়ে, কিন্তু রাতের অন্ধকার তাদের সংগ্রামকে আরও কঠিন করে তোলে। তারা দিনমজুর, রিকশাচালক, নাইট শিফটের প্রহরী, হকার। তাদের কাছে রাত মানে শুধু অন্ধকার নয়, রাত মানে আরও কিছু অতিরিক্ত টাকা উপার্জনের সুযোগ।
ফকির মিয়া, একজন রিকশাচালক। দিনের বেলা যাত্রী পাওয়া কঠিন, কারণ অনেকেই এখন পাঠাও বা উবারে চড়ে। তাই তাঁর ভরসা রাত। গভীর রাতে যখন শহরের অভিজাত এলাকাগুলো ঘুমিয়ে থাকে, তখন ফকির মিয়া ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে থাকেন, একটা যাত্রী পাওয়ার আশায়। জীর্ণ শরীর, ছেঁড়া পাঞ্জাবি, আর চোখে ঘুম। কিন্তু গ্রামের বাড়িতে অসুস্থ স্ত্রী আর ছোট ছেলেমেয়ের মুখগুলো মনে পড়লেই তাঁর ঘুম উধাও হয়ে যায়। এই কনকনে শীতেও তিনি হ্যান্ডেলে হাত রেখে অপেক্ষা করেন। প্রতিটা ট্রিপ যেন এক একটা ছোট যুদ্ধ কখনো যাত্রী না পাওয়ার যুদ্ধ, কখনো যাত্রীর সাথে ভাড়ার যুদ্ধ, কখনো পুলিশের তাড়া খাওয়ার যুদ্ধ। এই রিকশার প্যাডেল ঘোরানোই তার জীবন, তার পরিবারের রুটি-রুজির উৎস। তার এই নীরব যুদ্ধ, এক নির্মম বাস্তবতার বিরুদ্ধে।
আবার ধরুন, মফিজ সাহেব। তিনি এক পোশাক কারখানার নাইট শিফটের সুপারভাইজার। সারাদিন পরিবারের সাথে কাটানোর পর রাত এগারোটা বাজতেই তিনি কারখানার দিকে পা বাড়ান। শত শত শ্রমিকের কাজ তদারকি করা, মেশিনের আওয়াজে কান পাতা, ছোটখাটো সমস্যা সমাধান করা এগুলো তার নিত্যদিনের কাজ। তিনি জানেন, তার সামান্য ভুল বা অসতর্কতা হাজারো শ্রমিকের ঘাম আর কারখানার উৎপাদন দুটোকেই প্রভাবিত করতে পারে। পরিবারকে সুখি রাখতে, ছেলেমেয়েদের ভালো স্কুলে পড়াতে এই রাতের পরিশ্রম তার কাছে খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু শরীর তো আর যন্ত্র নয়। রাত যত বাড়ে, ক্লান্তির বোঝা তত ভারী হয়। চোখের পাতা বুজে আসে, কিন্তু দায়িত্ববোধ তাকে সজাগ রাখে। মফিজ সাহেবের এই নীরব যুদ্ধ, ক্লান্তি আর দায়িত্বের ভারসাম্যের মধ্যে।
রাতের শহর কেবল সংগ্রাম আর একাকীত্বের গল্পই বলে না, এটি স্বপ্নভঙ্গের বেদনা এবং নতুন আশার আলো জ্বেলেও রাখে। অনেক তরুণ-তরুণী, দিনের বেলায় যারা নিজেদের স্বপ্ন পূরণের পেছনে ছোটে, রাতের বেলায় তারাই নিজেদের ব্যর্থতার হিসেব কষে। আবার এই রাতেই অনেকে নতুন করে স্বপ্ন বুনতে শুরু করে।
তিশা, নবীন এক ফ্রিল্যান্সার। দিনের বেলা তার ল্যাপটপ আর ইন্টারনেটই তার জগৎ। কিন্তু ক্লায়েন্টের ডেডলাইন, পেমেন্টের অনিশ্চয়তা, আর নতুন কাজের সন্ধানে সে প্রায়শই নির্ঘুম রাত কাটায়। মাঝেমধ্যে হতাশ হয়ে ল্যাপটপ বন্ধ করে দেয়। মনে হয়, এই শহরে তার জন্য কোনো জায়গা নেই। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে যায় বাবা-মায়ের মুখ, যারা তার এই সিদ্ধান্তের ওপর ভরসা করে আছে। রাত যত গভীর হয়, তার ভেতরের জেদ যেন তত বাড়ে। নতুন করে কাজের প্ল্যান করে, নতুন করে মেইল লেখে। তিশার যুদ্ধ শুধু অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য নয়, নিজের যোগ্যতাকে প্রমাণ করার জন্যও। এই রাতের নীরবতা তাকে হতাশ করে, আবার তাকেই নতুন করে শক্তি যোগায়।
অন্যদিকে, শাহেদ, একজন উঠতি ব্যান্ডশিল্পী। দিনের বেলায় টিউশনি করে যা উপার্জন করে, তা দিয়ে তার গিটার আর খাবারের খরচ কোনোমতে চলে যায়। কিন্তু তার আসল প্যাশন সংগীত। রাতের বেলায়, শহরের কোনো এক ছাদের ওপর বসে সে গিটার বাজায়, গান লেখে। তার গানের সুর রাতের বাতাসে ভেসে যায়, কিন্তু কেউ শোনে না। অনেকবার চেষ্টা করেও কোনো বড় প্ল্যাটফর্মে সুযোগ পায়নি। বন্ধুরা অনেকেই অন্য পেশায় চলে গেছে, কিন্তু শাহেদ এখনো তার স্বপ্ন আঁকড়ে ধরে আছে। তার চোখে ঘুম নেই, কারণ তার স্বপ্ন তাকে ঘুমাতে দেয় না। সে জানে, একদিন তার গান শহরের বুকে ঝড় তুলবে। এই বিশ্বাস, এই প্যাশনই তার নীরব যুদ্ধের জ্বালানি।
শহরের রাতের নীরবতার সবচেয়ে করুণ চিত্র দেখা যায় ফুটপাতে শুয়ে থাকা মানুষগুলোর জীবনে। তাদের কাছে রাত মানে শুধু অন্ধকার নয়, রাত মানে ঠাণ্ডা, ক্ষুধা আর অনিরাপত্তার এক দীর্ঘ প্রহর। তারা সমাজের এক কোণে পড়ে থাকা সেইসব মানুষ, যাদের জন্য শহরের কোনো ঘর নেই।
আনোয়ার চাচা, সারাদিন কাগজ কুড়িয়ে যা পান, তা দিয়েই তার রাতের খাবার জোটে। শহরের বিভিন্ন ডাস্টবিন আর ময়লার স্তূপ তার রুটি-রুজির উৎস। দিনের বেলা মানুষ তাকে এড়িয়ে চলে, তার গন্ধ আর ছেঁড়া পোশাক দেখে মুখ ফিরিয়ে নেয়। কিন্তু রাতে যখন সবাই ঘরে ফেরে, তখন আনোয়ার চাচা কোনো এক দোকানের শার্টারের পাশে, বা কোনো পার্কের বেঞ্চে নিজের ঠাঁই করে নেন। আকাশটা তার ছাদ, আর শহরের ঠান্ডা বাতাস তার কম্বল। মশার কামড়, কুকুরের ঘেউ ঘেউ, আর নির্দয় মানুষের অবহেলা এসবই তার রাতের সঙ্গী। তার যুদ্ধ কোনো স্বপ্ন বা উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য নয়, তার যুদ্ধ শুধু পরের দিনের সূর্য দেখার জন্য, আরেকটা দিন বেঁচে থাকার জন্য। এই নীরব যুদ্ধ, বেঁচে থাকার আদিমতম এক সংগ্রাম।
এরকমই, এক সদ্যজাত শিশু তার মায়ের কোলের উষ্ণতা খুঁজছে শহরের এক ফুটপাতে। এই শহরের নিয়ন আলোর নিচে, লক্ষ কোটি মানুষের ভিড়ে, এই নবজাতকের জীবনের শুরুটাই এক কঠিন নীরব যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। মা, অনামিকা, ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত। দিনের বেলা কাজ খুঁজতে বের হয়, কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই খালি হাতে ফেরে। রাতে যখন তার শিশুটি ক্ষুধার্ত হয়ে কাঁদে, তখন তার বুক ফেটে যায়। এই শহরের ঔদাসীন্য, এই সমাজের নিষ্ঠুরতা এসবের বিরুদ্ধে তার প্রতিটি মুহূর্তই এক অবিরাম যুদ্ধ।
দিনের আলোর চাকা থেমে গেলেও, রাতের শহরেও ব্যস্ততার অন্তহীন ঘূর্ণিপাক চলতে থাকে। বিশেষ করে সার্ভিস সেক্টরে কাজ করা মানুষগুলোর জন্য রাত মানে কেবল নতুন এক শিফটের শুরু। কল সেন্টারের কর্মীরা, হাসপাতালের নার্স ও ডাক্তাররা, জরুরি সেবার কর্মীরা তারা তাদের নিজেদের আরাম বিসর্জন দিয়ে শহরের এই নীরবতাকে প্রাণবন্ত রাখেন।
রাফি, একটি বিদেশি কল সেন্টারে কাজ করে। রাতের বেলা যখন সবাই ঘুমিয়ে থাকে, তখন তাকে বিদেশের মাটিতে থাকা গ্রাহকদের সমস্যার সমাধান করতে হয়। ঘুমের সাথে তার নিত্যদিনের যুদ্ধ। চোখে ক্লান্তি থাকলেও মুখে হাসি ধরে রাখতে হয়, কারণ গ্রাহকদের কাছে তার কণ্ঠস্বরই একমাত্র পরিচিতি। নিজের পারিবারিক সুখ-দুঃখ, ব্যক্তিগত সমস্যা সবকিছু ভুলে তাকে অন্যের সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়। মাসের শেষে বেতনের অঙ্কটা ভালো হলেও, সামাজিক জীবনের সাথে তার দূরত্ব তৈরি হয়েছে। বন্ধুদের সাথে আড্ডা বা পারিবারিক অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতি কমে গেছে। রাফির নীরব যুদ্ধ, কর্মজীবন আর ব্যক্তিগত জীবনের ভারসাম্যের।
হাসপাতালের ইমারজেন্সি ওয়ার্ড। রাত যত গভীর হয়, রোগীর চাপ তত বাড়ে। নার্স ফারহানা, রাত জাগা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। পরিবারের সদস্যরা যখন ঘুমিয়ে থাকে, তখন তিনি জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা রোগীদের সেবা দেন। এক হাতে স্যালাইন, অন্য হাতে ইনজেকশন। রোগীর আর্তনাদ, স্বজনদের কান্না এসব তার নিত্যদিনের সঙ্গী। মাঝেমধ্যে ক্লান্তি এত জেঁকে বসে যে মনে হয় আর এক মুহূর্তও দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু একজন রোগীর সেরে ওঠার হাসি দেখলে তার সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। ফারহানার নীরব যুদ্ধ, রোগের সাথে, মৃত্যুর সাথে, আর নিজের ক্লান্তির সাথে। তার প্রতিটি কাজ, প্রতিটি স্পর্শ মানুষের প্রতি তার গভীর ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ।
রাতের শহরের এই নীরব যুদ্ধ কেবল সংগ্রাম আর দুঃখের নয়। এই নীরবতা মানুষকে নিজের সাথে কথা বলার সুযোগ করে দেয়। দিনের কোলাহলে যা হারিয়ে যায়, রাতের গভীরে সেটাই আবার ফিরে আসে। নিজের ভেতরের সত্তার সাথে সংযোগ স্থাপন, নিজের ভুলগুলো শোধরানোর চেষ্টা, বা নতুন করে কিছু শুরু করার সংকল্প এসবই রাতের নীরবতার ফসল।
রাত আমাদের শেখায় ধৈর্য ধরতে, শিখায় প্রতিটি ছোট জয়কে মূল্য দিতে। একটি নতুন ভোরের জন্য অপেক্ষা করা, একটি নতুন দিনের স্বপ্ন দেখা এগুলোও এই নীরব যুদ্ধেরই অংশ। ভোরের আলো ফুটলেই এই যোদ্ধারা আবার দিনের আলোয় মিশে যায়, তাদের নীরব যুদ্ধের চিহ্নগুলো অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু রাতের গভীরে যারা শহরের স্পন্দনকে উপলব্ধি করে, তারা জানে এই নীরব যুদ্ধ আসলে মানুষের টিকে থাকার এক অদম্য স্পৃহা।
শহরের রাতের প্রতিটি নীরব মুহূর্তে যেন এই বার্তা ভেসে আসে আমরা একা নই। আমাদের চারপাশে অসংখ্য মানুষ নীরবে নিজেদের যুদ্ধ লড়ে যাচ্ছে। তাদের সংগ্রাম হয়তো ভিন্ন, তাদের গল্প হয়তো আলাদা, কিন্তু তাদের সবার লক্ষ্য একটাই বেঁচে থাকা, টিকে থাকা, আর একটি সুন্দর ভোরের স্বপ্ন দেখা। তাই, পরেরবার যখন রাত নামবে, আর শহরের বুকে নেমে আসবে নীরবতা, তখন হয়তো আপনিও শুনতে পাবেন এই নীরব যুদ্ধের প্রতিধ্বনি। আর অনুভব করবেন, প্রতিটি মানুষের ভেতরের সেই অদম্য শক্তিকে, যা আমাদের বাঁচিয়ে রাখে।
রাতের শহরের এই নীরব যুদ্ধ আমাদের শেখায় জীবনের প্রতিটি মানুষই কোনো না কোনোভাবে সংগ্রামী। আমরা হয়তো তাদের যুদ্ধক্ষেত্র দেখি না, তাদের বেদনা শুনি না, কিন্তু সেই লড়াই প্রতিদিনই চলছে, আমাদের চারপাশেই। কেউ লড়ছে ক্ষুধার বিরুদ্ধে, কেউ একাকীত্বের, কেউ স্বপ্নভঙ্গের দগদগে ক্ষতের, আবার কেউ কেবল বেঁচে থাকার সহজ অধিকারটুকুর জন্য।
এই নীরব যুদ্ধের প্রতিটি অধ্যায় আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সহমর্মিতা শুধু একটি সুন্দর শব্দ নয় এটি বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য এক মানবিক হাতিয়ার। হয়তো আপনার একটুখানি মনোযোগ, একটুখানি সাহায্য, কিংবা কেবল একটুখানি হাসিই কারো রাতের দীর্ঘ অন্ধকারে ছোট্ট একটি আলো হয়ে উঠতে পারে।
তাহলে প্রশ্ন থেকে যায় আমরা কি প্রস্তুত সেই আলো হয়ে উঠতে? আমরা কি প্রস্তুত শহরের রাতের এই নীরব যোদ্ধাদের পাশে দাঁড়াতে? ভোরের আলো ফুটলে যেন তারা শুধু দিনের শুরু না দেখে, দেখে আশা, দেখে মানবতার পুনর্জন্ম। ভাবুন তো, আপনার একটি ছোট পদক্ষেপ কি আজই কারো যুদ্ধকে একটু সহজ করে দিতে পারে না?
আপনার মন কি এই গল্পগুলো স্পর্শ করেছে? রাতের শহরের এই নীরব যোদ্ধাদের জীবন নিয়ে আপনার কী অনুভূতি, কী ভাবনা?
আপনার মতামত ও অনুভূতি শেয়ার করুন আপনার শব্দই হয়তো জাগিয়ে তুলবে আরও কারো সহমর্মিতা।
এই লেখা আপনার কাছে অর্থবহ মনে হলে, অনুগ্রহ করে শেয়ার করুন, যাতে আরও মানুষ জানতে পারে রাতের এই অদৃশ্য যুদ্ধের কথা।
রাতের শহর, নীরব যুদ্ধ, মানবিক গল্প, একাকীত্ব, সংগ্রাম, রুটি-রুজি, স্বপ্ন, ফুটপাত জীবন, বাংলাদেশের শহর, জীবনযুদ্ধ।
🌸 আপনার মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ!
আপনার মতামত আমাদের অনুপ্রাণিত করে এবং আগামীতে আরও মানসম্পন্ন কনটেন্ট তৈরিতে সহায়তা করে।
আপনি যদি কোনো নির্দিষ্ট বিষয় বা গল্প পছন্দ করে থাকেন, জানালে ভালো লাগবে।
নিয়মিত পাশে থাকুন — আপনার সহযোগিতা ও ভালোবাসাই আমাদের এগিয়ে চলার শক্তি।
শুভ কামনায়,
✍️ কল্পকথা-৩৬০ ব্লগ টিম
https://kalpakatha360.blogspot.com