রাতের গভীরে যখন চারপাশ শান্ত হয়ে আসে, তখন কি আপনার মনে হয় যেন জ্যোৎস্স্না চুপিচুপি পাতায় পাতায় গান লিখছে? ঠিক যেন স্বপ্ন-ভরা কোনো নদী তার সব অভিমান ভাসিয়ে দিয়ে নীরবে বয়ে চলেছে। সেই মুহূর্তে আপনি কি কখনো তার পাশে ছিলেন, সেই গোপন ডাক শুনতে পেয়েছিলেন? নাকি শুধু নির্ঘুম নিশিরাতে পথ হারিয়েছেন কোনো এক অচেনা মোড়ে?
আসলে আমাদের সবার জীবনে এমন কিছু মুহূর্ত আসে, যখন মনে হয় দূর নক্ষত্র থেকে যেন কেউ চিঠি লিখছে, আর আকাশ তার গভীর চোখে সেই চিঠি পড়ছে। স্মৃতির গলিপথ দিয়ে তখন বয়ে যায় এক শীতল হাওয়া, যা হয়তো পুরনো কোনো শোককে নতুন করে মনে করিয়ে দেয়। আমরা প্রত্যেকেই যেন এক একটি গানের বৃক্ষ, যার ফুল ফোটে নিরালায়, লোকচক্ষুর আড়ালে। হয়তো কেউ তার সৌন্দর্য দেখে না, তবু তার সুগন্ধে আমাদের প্রাণ ভরে ওঠে এক অদ্ভুত ভালো লাগায়।
এই পৃথিবীর বুকে আমরা হয়তো নামহীন এক পাখির মতো, নদীর ধারে আমাদের ক্ষণিকের বসত। প্রতিনিয়ত আমরা উড়ে যাই নিরুদ্দেশে, কিন্তু পেছনে রেখে যাই এক বুক বিশ্বাস, একটি ছোট্ট পালকের মতো। এই পালকটিই হয়তো আমাদের স্মৃতি, আমাদের রেখে যাওয়া চিহ্ন। মনে রাখবেন সেই পালকটিকে, কারণ তার গভীরে লুকিয়ে থাকে এই জগতের অনুল্লেখিত ভাষা, আমাদের অকথিত গল্পেরা। এটিই সেই স্পর্শ যা আমাদের অস্তিত্বের জানান দেয়, আমাদের ভেতরের মানুষটিকে চিনিয়ে দেয়।

চুপিচুপি জ্যোৎস্না নামে, পাতায় লেখে গান,
স্বপ্ন-ভরা নদীর মতো, হারায় অভিমান।
তুমি কি তার পাশে ছিলে, শুনেছিলে ডাক?
নাকি শুধু নিশিরাতে হারিয়েছো পথের রাখ?
নক্ষত্রে কেউ চিঠি লেখে, আকাশ পড়ে চোখ,
স্মৃতির ভিতর হাওয়া বয়ে— কে যেন করে শোক।
আমি যে এক গানের বৃক্ষ, ফুল ফোটে নিরালায়,
দেখে না কেউ, তবু তার ঘ্রাণে প্রাণ উথলায়।
নামহীন এক পাখি আমি, নদীর ধারে বাস,
উড়ে যাই নিরুদ্দেশে— রেখে যাই বিশ্বাস।
একটি পালক ফেলে যাই, মনে রেখো তা,
যেখানে লুকায়ে থাকে— জগতের ভাষা।
রাত তখন প্রায় তিনটা। শহর নিস্তব্ধ। কেবল ঘড়ির টিকটিক শব্দ, দূর থেকে ভেসে আসা কুকুরের একঘেয়ে কান্না আর জানালার ফাঁক গলে আসা জ্যোৎস্নার ম্লান আলো।
তন্ময় বসে আছে নিজের ডেস্কের সামনে, জানালার পাশে। সামনে খোলা একটি পুরনো খাতা— হলদে হয়ে যাওয়া পাতায় আঁকা কিছু কবিতা, কিছু টুকরো অনুভব। প্রতিটি লাইনের নিচে তারিখ, সময়, আর একটি অদ্ভুত চিহ্ন— একটা উল্টানো পালকের মতো।
সে জানে, এগুলো কোনো সাধারণ কবিতা নয়। এগুলো ছিলো তার নিঃসঙ্গ জীবনের নিঃশব্দ চিৎকার। নিজের কাছে লেখা চিঠি।
তন্ময়ের বয়স এখন চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। একসময় সে ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রতিশ্রুতিশীল কবি। আড্ডা, প্রকাশনা, সাহিত্যচক্র— সব কিছুতেই ছিল তার dynamic উপস্থিতি।
কিন্তু সময়, সম্পর্ক, ব্যর্থতা আর আত্মবিশ্বাসের ধস— একে একে তাকে নিঃস্ব করে দেয়।
আজকের এই রাতে, হঠাৎ একটি লাইনের দিকে তার চোখ আটকে যায়:
"নামহীন এক পাখি আমি, নদীর ধারে বাস..."
এটি সে লিখেছিলো তখন, যখন তার প্রেয়সী ঈশিতা হঠাৎ করে চলে গিয়েছিলো বিদেশে— কোনো চিঠি বা উত্তর ছাড়া।
তখন সে নিজেকে মনে করেছিলো একটি পাখি— যার নেই কোনো পরিচয়, নেই কোনো দিশা।
জ্যোৎস্নার আলোয় নিজেকে দেখতে পাওয়া অনেকটা আয়নাবিহীন আত্মদর্শনের মতো। তন্ময় ভাবে—
"আমি কি সেই মানুষ, যে কবিতায় নিজের অনুভব হারিয়ে ফেলেছিল? নাকি সেই পাখি, যে পালক ফেলে রেখে চলে গেছে নিরুদ্দেশে?"
তার মনে পড়ে যায় সেই দিনগুলোর কথা, যেখানে আড্ডার ভেতরেও ছিলো নিঃসঙ্গতা। সবাই হাসত, কিন্তু সে যেন এক অদৃশ্য দেয়ালের ওপারে বসে থাকতো।
এখানেই কবিতা ও বাস্তব মিশে যায়।
একটি গানের বৃক্ষ হয়েও তার গানে কেউ করত না কান পাত।
তন্ময় ভাবে— "আমার লেখা কি সত্যিই কারো মনে রেখাপাত করেছিলো?"
তার কবিতার প্রতিটি পংক্তিতে ছিল জ্যোৎস্নার আলো, হারানোর ব্যথা, একটি অনিশ্চিত প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষা।
সে জানে না কে সেই পাঠক ছিল—
তবে জানে, কেউ কেউ এখনো মাঝরাতে তার লেখার পুরনো ব্লগ পড়ে। কেউ কেউ হয়তো কাঁদে।
একজন নামহীন পাখি প্রতিদিন সকালে এসে নদীর ধারে বসে, একটি করে পালক ফেলে যায়।
একদিন সেই নদীর ধারে একজন ভাঙা মন নিয়ে হাঁটতে আসে এবং সেই পালক পায়।
সেই পালক তাকে বলে— "তুমি একা নও।"
তন্ময় ভাবে, সে-ও হয়তো এমন কারো জন্য একটি পালক ফেলে গিয়েছিলো— ঈশিতা? না অন্য কেউ?
কিন্তু আসল প্রশ্ন হলো—
তিনটি পালক পড়ে থাকে যেখানে কেউ বুঝতে চায় না তার ভাষা। তখন সেই ভাষা হয়ে ওঠে জগতের সত্য।
গল্পটি এখানেই শেষ নয়। কারণ এটি একটি গল্প নয়, একটি আত্মজিজ্ঞাসা।
যে গল্প পাঠককে মনে করিয়ে দেয় নিজের পুরনো ডায়েরির কথা।
যে গল্প বলে—
"তুমি কি তার পাশে ছিলে? শুনেছিলে সেই ডাক?"
নাকি আজো তুমি রাত তিনটার দিকে চোখ মেলে বসে থাকো, একটি অদৃশ্য পালকের জন্য?
তন্ময়ের মতো আমরাও হয়তো কোনো এক নিশিরাতে নিজের জন্যই কবিতা লিখি।
কারো জন্য রেখে যাই একটি শব্দ, একটি চিঠি, একটি ছায়াময় গান।
হয়তো সেটি কেউ পড়ে না...
তবু সেই ঘ্রাণে প্রাণ উথলায়।
👉 "তোমার জীবনে কি এমন কোনো লেখা, চিঠি, কবিতা আছে যা তুমি রেখেছিলে শুধু নিজের জন্য?"
👇 নিচে কমেন্ট করে জানাও।
হয়তো তোমার কথাতেই কারো “নামহীন পাখি” ফিরে আসবে। 🕊️
📌 #Kalpakatha360 | #BengaliStory | #EmotionalLiterature | #EvergreenContent | #AudienceCentric
📎 পড়ো আরও: https://www.kalpakatha360.org
✍️ গল্পটি ভালো লাগলে শেয়ার করো, যাতে অন্যরাও খুঁজে পায় তাদের নিজের পালক।
এক কথায় অসাধারণ।
ReplyDelete