প্রযুক্তিগত ও ডিজিটাল বৈষম্য: এক অসম প্রতিচ্ছবি

প্রযুক্তিগত ও ডিজিটাল বৈষম্য: এক অসম প্রতিচ্ছবি

ডিজিটাল বৈষম্যের এক নির্মম বাস্তবতা

ডিজিটাল যুগে প্রবেশ বাংলাদেশের জন্য এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। ২০০৯ সালে 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' এর যে স্বপ্নযাত্রা শুরু হয়েছিল, তার লক্ষ্য ছিল ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজে রূপান্তরিত করা এবং একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল অর্থনীতি গড়ে তোলা । এই দূরদর্শী পরিকল্পনায় প্রযুক্তিকে সবার জন্য সহজলভ্য করে দারিদ্র্য বিমোচন এবং সুষম উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি ছিল । সরকার মানবসম্পদ উন্নয়ন, নাগরিকদের সংযোগ স্থাপন, সরকারি পরিষেবা ডিজিটালাইজেশন এবং তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের প্রসারে বহুবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে ।


তবে, বাস্তবতা প্রায়শই স্বপ্নের চেয়ে কঠোর হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপাপটে, 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' এর প্রতিশ্রুতি এবং বর্তমান পরিস্থিতি এক গভীর বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরে। কোভিড-১৯ মহামারী এই ডিজিটাল বিভেদের ভয়াবহতা স্পষ্ট করে দিয়েছে, যা 'জিরো ডিজিটাল ডিভাইড' বা শূন্য ডিজিটাল বৈষম্য অর্জনের প্রয়োজনীয়তাকে সামনে নিয়ে আসে । কিন্তু ২০২৫ সালের চিত্র বলছে, এই লক্ষ্য এখনও বাংলাদেশের জন্য এক 'সুদূর স্বপ্ন' ।

ডিজিটাল বৈষম্য একটি জটিল এবং বহুমাত্রিক সমস্যা, যা মূলত ইন্টারনেট এবং তথ্যপ্রযুক্তির সম্পদ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বৈশ্বিক ও স্থানীয় অসমতাকে বোঝায় । এটি দুটি প্রধান স্তরে বিভক্ত: প্রথম স্তরের ডিজিটাল বৈষম্য ইন্টারনেট অবকাঠামোতে ব্যক্তির প্রবেশাধিকারের ভিন্নতাকে নির্দেশ করে, যেখানে দ্বিতীয় স্তরের ডিজিটাল বৈষম্য অনলাইন দক্ষতা এবং ইন্টারনেটের কার্যকর ব্যবহারের ভিন্নতাকে বোঝায় । এই বৈষম্য আয়, শিক্ষা, ভৌগোলিক অবস্থান (গ্রামীণ বনাম শহুরে), বয়স এবং লিঙ্গসহ বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক ও জনমিতিক বৈশিষ্ট্যের সাথে গভীরভাবে জড়িত । এটি শারীরিক, আর্থিক, জ্ঞানীয়, নকশা, প্রাতিষ্ঠানিক এবং রাজনৈতিক প্রবেশাধিকারের বাধাও অন্তর্ভুক্ত করে । ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তির অভাবের গুরুতর নেতিবাচক পরিণতি রয়েছে, যা বিদ্যমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসমতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে এবং প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রাপ্ত পণ্য ও পরিষেবার অসম প্রবেশাধিকার সৃষ্টি করে ।

এই প্রতিবেদনটি বাংলাদেশের প্রযুক্তিগত ও ডিজিটাল অসমতার একটি বিস্তারিত, গবেষণামূলক এবং সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ উপস্থাপন করতে চায়। আমরা ইন্টারনেটের গতিতে বৈষম্য থেকে শুরু করে সরকারি পরিষেবা প্রাপ্তিতে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর চ্যালেঞ্জ এবং দালালদের মাধ্যমে দুর্নীতির বিস্তার পর্যন্ত নির্দিষ্ট সমস্যাগুলো গভীরভাবে পর্যালোচনা করব। শুধুমাত্র সমস্যাগুলো তুলে ধরা নয়, এই বিশ্লেষণটি পদ্ধতিগত সমস্যাগুলো চিহ্নিত করবে, বিদ্যমান অন্যায়গুলো উন্মোচন করবে এবং নীতিনির্ধারক, সুশীল সমাজ এবং সকল অংশীজনদের প্রতি একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ন্যায়সঙ্গত ডিজিটাল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানাবে।

১. অবকাঠামোগত বিভেদ: শহরে ফাইবার, গ্রামে 2G

বাংলাদেশের শহরাঞ্চল ও গ্রামীণ এলাকার মধ্যে ইন্টারনেট প্রবেশাধিকার ও গতিতে এক বিশাল ফারাক বিদ্যমান। শহুরে কেন্দ্রগুলিতে তুলনামূলকভাবে ভালো ইন্টারনেট ও মোবাইল নেটওয়ার্ক কভারেজ থাকলেও, গ্রামীণ, পাহাড়ি ও উপকূলীয় বাংলাদেশের বিশাল অংশ সীমিত বা কোনো সংযোগ ছাড়াই ধুঁকছে, যেখানে কিছু এলাকায় এখনও কেবল পুরোনো 2G নেটওয়ার্কের উপর নির্ভর করতে হয় । এই আঞ্চলিক বৈষম্যকে ডিজিটাল বিভেদের 'সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) তথ্য এই বিভেদকে বারবার তুলে ধরেছে। জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে, গ্রামীণ এলাকার মাত্র ৩৬.৫% ব্যক্তি ইন্টারনেট ব্যবহার করেছে, যেখানে শহরাঞ্চলে এই হার ৭১.৪% – যা প্রায় দ্বিগুণ । গত অর্থবছরের তুলনায় এই ব্যবধান আরও বেড়েছে, যখন গ্রামীণ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ছিল ৩৬.৪% এবং শহুরে ব্যবহারকারী ছিল ৬৮.৬% । ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত, গ্রামীণ এলাকায় ইন্টারনেট ব্যবহারের হার ছিল ৩৭.৮% বনাম শহরাঞ্চলে ৬৮.৪% । পারিবারিক পর্যায়ে, ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত সারা দেশে ৫২.৪% পরিবারের ইন্টারনেট প্রবেশাধিকার থাকলেও, গ্রামীণ পরিবারগুলিতে এই হার ছিল ৪৮.২% এবং শহুরে পরিবারগুলিতে ৬১.৬% । এই ধারাবাহিক বৈষম্য অর্থনৈতিক অসমতাকে আরও দৃঢ় করছে ।

বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহার: শহর ও গ্রামের তুলনামূলক চিত্র

জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ব্যক্তিগত ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে শহরাঞ্চলে ৭১.৪% এবং গ্রামীণ এলাকায় ৩৬.৫% ব্যবহারকারী ছিল । পূর্ববর্তী অর্থবছরে (FY2023-24) এই হার ছিল শহরাঞ্চলে ৬৮.৬% এবং গ্রামীণ এলাকায় ৩৬.৪% । ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত ব্যক্তিগত ইন্টারনেট ব্যবহারের হার শহরাঞ্চলে ৬৮.৪% এবং গ্রামীণ এলাকায় ৩৭.৮% ছিল । পারিবারিক ইন্টারনেট প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্রে, জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে শহরাঞ্চলে ৬০.৩% এবং গ্রামীণ এলাকায় ৪৬% পরিবারের ইন্টারনেট সংযোগ ছিল । ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত শহরাঞ্চলে ৬১.৬% এবং গ্রামীণ এলাকায় ৪৮.২% পরিবারের ইন্টারনেট প্রবেশাধিকার ছিল ।

ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্কের সীমাবদ্ধতা ও 2G/ধীর গতির মোবাইল ডেটার প্রভাব
ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে সরকারের উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ সত্ত্বেও—যার মোট ফাইবার অপটিক স্থাপন হয়েছে ১৭৩,৮৪৫ কিলোমিটার এবং মোট নেটওয়ার্ক ব্যান্ডউইথ ৬,৬০০ জিবিপিএস —এর সুবিধাগুলি সমানভাবে বিতরণ করা হয়নি। গ্রামীণ এলাকায় ইন্টারনেট ট্রান্সমিশন খরচ এখনও অস্বাভাবিকভাবে বেশি, যা গুরুতর অব্যবস্থাপনা এবং ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্কস (NTTN) দ্বারা চার্জ করা অতিরিক্ত ব্যান্ডউইথ ট্রান্সমিশন ফি-এর কারণে ঘটে । এর অর্থ হলো, যেখানে ফাইবার প্রযুক্তিগতভাবে বিদ্যমান থাকতে পারে, সেখানে উচ্চ ব্যয়ের কারণে এটি ব্যবহার করা কঠিন হয়ে পড়ে অথবা পরিষেবার মান এতটাই খারাপ থাকে যে তা অকার্যকর হয়ে দাঁড়ায়, যেমনটি কিছু এলাকায় দেখা যায় যেখানে স্থানীয় ব্রডব্যান্ড প্রযুক্তিগতভাবে উপলব্ধ হলেও তা এতটাই ধীর যে ব্যবহার করা যায় না ।

গ্রামীণ এলাকায় 2G নেটওয়ার্কের উপর ক্রমাগত নির্ভরতা একটি গুরুতর সমস্যা। বাংলাদেশের প্রায় ৩৪.৩৪% মোবাইল সংযোগ এখনও 2G নেটওয়ার্কের উপর নির্ভরশীল, যা কেবল ভয়েস কল এবং টেক্সট মেসেজিং সমর্থন করে, ফলে ডিজিটাল অংশগ্রহণের সুযোগ মারাত্মকভাবে সীমিত হয় । ভারত (৮.৩৮%) এবং ভুটানের (৮.০২%) তুলনায় এই হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি । এর কারণগুলির মধ্যে রয়েছে 4G পরিষেবার ব্যাপক অভাব এবং ব্যবহারকারীদের 4G-সক্ষম হ্যান্ডসেট কেনার অক্ষমতা । উপরন্তু, বৈশ্বিক প্রবণতা 2G এবং 3G নেটওয়ার্কগুলির 'সানসেট' বা বিলুপ্তির দিকে ইঙ্গিত করে, যা LTE এবং 5G-তে স্থানান্তরের প্রয়োজনীয়তা বাড়াচ্ছে । এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের 2G-এর উপর অব্যাহত নির্ভরতা একটি বড় প্রযুক্তিগত পশ্চাদপদতা নির্দেশ করে।

ভূগোল ও বিনিয়োগের চ্যালেঞ্জ

জনবসতিহীন, পাহাড়ি বা উপকূলীয় অঞ্চলে মোবাইল ফোন টাওয়ার এবং অন্যান্য গ্রাউন্ড-ভিত্তিক অবকাঠামো নির্মাণে উচ্চ ব্যয় এবং জটিলতা কভারেজ উন্নত করা কঠিন করে তোলে । পাহাড়ি অঞ্চলে তার স্থাপন ব্যয়বহুল এবং নির্মাণ সরঞ্জাম পরিবহনে চ্যালেঞ্জের কারণে কঠিন। একইভাবে, বন্যাপ্রবণ উপকূলীয় অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ তারগুলির ঘন ঘন রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের প্রয়োজন হয় ।

গ্রামীণ এলাকায় এই ব্যাপক অবকাঠামোগত অভাব, বিশেষ করে, পরিষেবা প্রদানকারীদের জন্য পরিচালন ব্যয় বাড়িয়ে তোলে, যা শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের উপর চাপানো হয় । এর ফলে ইন্টারনেট প্রবেশাধিকার একটি বিলাসিতায় পরিণত হয়, বিশেষ করে যেখানে আয়ের স্তর কম, সেখানে এটি একটি মৌলিক প্রয়োজনীয়তার পরিবর্তে একটি বিলাসবহুল পণ্য হিসেবে বিবেচিত হয় ।

গভীরতর বিশ্লেষণ: অবকাঠামোগত বৈষম্যের বহুমাত্রিক প্রভাব

গ্রামীণ এলাকায় দুর্বল বা অনুপস্থিত সংযোগের বারবার উল্লেখ করা হয়েছে, যা কিছু স্থানকে 'ডিজিটাল ডেড জোন'-এ আটকা পড়ার মতো করে তোলে । এটি কেবল একটি ছোটখাটো অসুবিধা নয়, বরং এর গভীর অর্থনৈতিক পরিণতি রয়েছে। যদি গ্রামীণ জনগোষ্ঠী নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট অ্যাক্সেস না পায়, তবে তারা ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল অর্থনীতি থেকে মৌলিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এর অর্থ হলো, তারা অনলাইন শিক্ষা, দূরবর্তী কাজ, ই-কমার্স বা গুরুত্বপূর্ণ ডিজিটাল ব্যাংকিং এবং টেলিমেডিসিন পরিষেবাগুলিতে অংশগ্রহণ করতে পারে না । এই অবস্থা সরাসরি অর্থনৈতিক অসমতাকে বাড়িয়ে তোলে এবং সুদৃঢ় করে, যা 'দুই শ্রেণীর নাগরিক' তৈরি করে – একদল 'আইটি-সচেতন এবং ডিজিটাল অগ্রগতির সুফল ভোগ করছে', এবং অন্যদল 'মৌলিক সরকারি পরিষেবা থেকেও বঞ্চিত' । গ্রামীণ এলাকায় ডিজিটাল প্রবেশাধিকারের অভাব কেবল একটি প্রযুক্তিগত ব্যবধান নয়; এটি একটি আর্থ-সামাজিক বাধা যা বাংলাদেশের প্রায় ৬৮% জনসংখ্যার জন্য উদ্ভাবন, দক্ষতা বৃদ্ধি এবং বৃহত্তর বাজারে প্রবেশাধিকারকে বাধাগ্রস্ত করে, যা জাতীয় উন্নয়নকে ব্যাহত করে ।

সরকার ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করেছে , এবং ১০০% ইন্টারনেট সংযোগের একটি ঘোষিত লক্ষ্যও রয়েছে । তবুও, গ্রামীণ এলাকায় ট্রান্সমিশন খরচ 'অসমানুপাতিকভাবে বেশি' থাকে এবং এটি স্পষ্টতই 'গুরুতর অব্যবস্থাপনা' এবং ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্কস (NTTN) দ্বারা চার্জ করা 'অতিরিক্ত ব্যান্ডউইথ ট্রান্সমিশন ফি'-এর সাথে জড়িত । এই পরিস্থিতি একটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বন্দ্ব নির্দেশ করে: সমস্যাটি কেবল অবকাঠামোর

উপস্থিতি নিয়ে নয়, বরং এর ব্যবস্থাপনা, মূল্য নির্ধারণ এবং ন্যায়সঙ্গত বিতরণ নিয়ে। জাতীয় ফাইবার বিনিয়োগের সুবিধাগুলি মধ্যস্বত্বভোগীদের দ্বারা শোষিত হচ্ছে অথবা শেষ ব্যবহারকারীর কাছে কার্যকরভাবে পৌঁছাচ্ছে না, যা সম্প্রসারণের মূল উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করছে। এটি টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা কাঠামোর মধ্যে পদ্ধতিগত সমস্যাগুলির দিকে ইঙ্গিত করে, যা একচেটিয়া অনুশীলন বা অদক্ষতাকে গ্রামীণ ব্যবহারকারীদের জন্য খরচ বাড়াতে দেয় । এর ফলে, শারীরিক অবকাঠামো থাকা সত্ত্বেও, এটি কার্যত প্রবেশাধিকারের একটি কৃত্রিম বাধা তৈরি করে।

বাংলাদেশের 2G নেটওয়ার্কের উপর অস্বাভাবিকভাবে বেশি নির্ভরতা (৩৪.৩৪%) প্রতিবেশী দেশগুলির তুলনায় উল্লেখযোগ্য , যেখানে বিশ্বব্যাপী 2G এবং 3G নেটওয়ার্কগুলি পর্যায়ক্রমে বন্ধ হচ্ছে ('নেটওয়ার্ক সানসেট') । বাংলাদেশে 2G-এর উপর এই অব্যাহত নির্ভরতার কারণগুলির মধ্যে রয়েছে 4G পরিষেবার ব্যাপক অভাব এবং ব্যবহারকারীদের 4G-সক্ষম হ্যান্ডসেট কেনার অক্ষমতা । এর ব্যাপক প্রভাব হলো, এটি একটি উল্লেখযোগ্য প্রযুক্তিগত পশ্চাদপদতা নির্দেশ করে যা কেবল আরও খারাপ হবে, কারণ বৈশ্বিক ডিজিটাল পরিষেবাগুলি ক্রমবর্ধমানভাবে উচ্চ ব্যান্ডউইথের উপর নির্ভরশীল। 2G-এর উপর ক্রমাগত নির্ভরতা মানে গ্রামীণ এলাকাগুলি আধুনিক ডিজিটাল অ্যাপ্লিকেশন, পরিষেবা এবং অর্থনৈতিক সুযোগগুলি থেকে চিরতরে বিচ্ছিন্ন থাকবে যা দ্রুত গতির প্রয়োজন (যেমন, শিক্ষার জন্য ভিডিও কনফারেন্সিং, জটিল ই-কমার্স, উন্নত IoT অ্যাপ্লিকেশন)। যদি পর্যাপ্ত 4G/5G রোলআউট এবং সাশ্রয়ী মূল্যের ডিভাইস অ্যাক্সেস ছাড়াই 2G নেটওয়ার্কগুলি শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী বা দেশীয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায়, তবে এটি লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য আরও বড় ডিজিটাল বঞ্চনা তৈরি করতে পারে, যারা ইতিমধ্যেই ডিজিটাল বিশ্বের প্রান্তিকতায় রয়েছে।

সরকারি সেবায় ডিজিটাল বঞ্চনা: গ্রামীণ মানুষের দুর্ভোগ

বাংলাদেশে ই-গভর্নেন্স উদ্যোগের লক্ষ্য ছিল সরকারি পরিষেবাগুলিকে আরও দক্ষ, স্বচ্ছ এবং সহজলভ্য করা, যার মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পাবে । তবে, বিশেষ করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য, এই পরিষেবাগুলির কার্যকারিতা সীমিত রয়ে গেছে । বর্তমানে, মাত্র ২২% সরকারি পরিষেবা ডিজিটাল মাধ্যমে উপলব্ধ, যেখানে ৭৮% পরিষেবা এখনও অফলাইনে দেওয়া হয়। বিদ্যমান ই-পরিষেবাগুলির বেশিরভাগই প্রাথমিকভাবে তথ্য সংগ্রহ ও বিতরণের উপর কেন্দ্রীভূত, পূর্ণাঙ্গ লেনদেনমূলক ক্ষমতার উপর নয় ।

ই-পাসপোর্ট এবং জন্মসনদের মতো গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবাগুলির জন্য, অনলাইনে আবেদনের প্রক্রিয়া উপলব্ধ থাকা সত্ত্বেও , গ্রামীণ ব্যক্তিরা উল্লেখযোগ্য বাধার সম্মুখীন হন। একটি বড় সমস্যা হলো পাসপোর্টের জন্য অনলাইন-নিবন্ধিত জন্ম নিবন্ধন সনদের (BRC) আবশ্যকতা, এমনকি ২০১০ সালের আগে জন্মগ্রহণকারী ব্যক্তিদের জন্যও, যখন সিস্টেমটি ডিজিটাল ছিল না । অনেক পুরোনো কাগজের রেকর্ড গ্রহণ করা হয় না, যা লক্ষ লক্ষ মানুষকে নতুন কাগজপত্র সহ নতুন করে নিবন্ধন করতে বাধ্য করে, যা একটি কঠিন এবং প্রায়শই বিভ্রান্তিকর কাজ । এই খণ্ডিত ব্যবস্থা, যেখানে জন্ম/মৃত্যু, NID এবং পাসপোর্টের জন্য বিভিন্ন সরকারি সংস্থা পৃথক ডেটাবেস বজায় রাখে, তা একীভূত যাচাইকরণের অভাব তৈরি করে ।

ডিজিটাল সাক্ষরতা ও ডিভাইসের অভাবের ভূমিকা

অনলাইন সরকারি পরিষেবাগুলিতে প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্রে একটি বড়, প্রায়শই উপেক্ষিত, বাধা হলো গ্রামীণ এলাকায় ডিজিটাল সাক্ষরতার গভীর অভাব এবং অপর্যাপ্ত ডিভাইস মালিকানা। ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অফ গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (BIGD) দ্বারা পরিচালিত ২০১৯ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, গ্রামীণ জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি ইন্টারনেটের সাথে পরিচিত নয়, এবং ৭৭% গ্রামীণ পরিবারের ডিজিটাল দক্ষতা 'নেই' বা 'খুব কম' । ৬,৫০০ গ্রামীণ পরিবারের মধ্যে মাত্র দুটি উচ্চ ডিজিটাল সাক্ষরতার স্কোর অর্জন করেছে ।

গ্রামীণ পরিবারগুলিতে কম্পিউটার মালিকানাও উল্লেখযোগ্যভাবে কম (গ্রামীণ ৩.৭% বনাম শহুরে ২১.৩%) । স্মার্টফোন মালিকানা তুলনামূলকভাবে বেশি হলেও, এটি এখনও শহরাঞ্চলের তুলনায় পিছিয়ে (গ্রামীণ ৬৯% বনাম শহুরে ৭৯.২%) । অনেক গ্রামীণ ব্যবহারকারী ভাগ করা ডিভাইসের উপর নির্ভর করেন বা গুরুতর আর্থিক সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হন, যা ডিজিটাল সরঞ্জামগুলিতে ধারাবাহিক প্রবেশাধিকারকে চ্যালেঞ্জিং করে তোলে । এর অর্থ হলো, এমনকি যদি একটি সরকারি পরিষেবা নামমাত্র 'অনলাইন' হয়, তবে লক্ষ্য ব্যবহারকারীদের প্রায়শই স্বাধীনভাবে এটি ব্যবহার করার জন্য মৌলিক সরঞ্জাম (শারীরিক প্রবেশাধিকার) এবং জ্ঞানীয় দক্ষতা (ডিজিটাল সাক্ষরতা) থাকে না, যা ডিজিটাল পরিষেবাটিকে কার্যকরভাবে অপ্রাপ্য করে তোলে ।

সেবা প্রদানে মধ্যস্বত্বভোগী ও দুর্নীতির বিস্তার

অনলাইন প্রক্রিয়াগুলির জটিলতা, কম ডিজিটাল সাক্ষরতা এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব, দালালদের (মধ্যস্বত্বভোগী) বিকাশের জন্য উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে । এই অনানুষ্ঠানিক 'সমস্যা সমাধানকারী'রা পদ্ধতি সম্পর্কে নাগরিকদের অপরিচিতির সুযোগ নেয়, প্রায়শই সমস্যাগুলিকে অতিরঞ্জিত করে এবং আমলাতান্ত্রিক গোলকধাঁধায় নেভিগেট করার জন্য ঘুষের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ধারণা তৈরি করে ।

বাংলাদেশে দুর্নীতি ব্যাপক এবং সমাজের সকল স্তরে বিস্তৃত । একটি উদ্বেগজনক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৭২% নাগরিক গত বছর ঘুষের অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন, প্রায়শই ভূমি প্রশাসন, নিবন্ধন এবং পারমিট পরিষেবার মতো গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবাগুলিতে । ২০১০ সালে প্রতি পরিবারে বার্ষিক গড় ঘুষের পরিমাণ ছিল ৩,১৮৪৬ টাকা (প্রায় ৪০ মার্কিন ডলার), যেখানে সর্বনিম্ন আয়ের বিভাগ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তাদের নিষ্পত্তিযোগ্য আয়ের ৪.১১% ছোটখাটো দুর্নীতিতে ব্যয় হয়েছিল ।

ই-গভর্নেন্স প্রবর্তনের পরেও দুর্নীতি বিদ্যমান থাকে এবং এমনকি 'স্থানান্তরিত' হতে পারে বা নতুন অভিনেতাদের উত্থান ঘটাতে পারে । উদাহরণস্বরূপ, ভূমি প্রশাসনে, কর্মকর্তারা এখনও স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা বজায় রাখেন কারণ নথিগুলির শারীরিক জমা দেওয়া এখনও প্রয়োজন, যা তাদের বাধা তৈরি করতে এবং ঘুষ দাবি করতে দেয় । জন্ম নিবন্ধনের ক্ষেত্রে, স্থানীয় কর্মকর্তারা (যেমন চেয়ারম্যান) জটিল প্রক্রিয়া থেকে লাভবান হতে পারেন, যা গ্রামবাসীদের জন্য দালালদের উপর নির্ভরতা ছাড়া ত্রুটি সংশোধন বা অনলাইন সনদপত্র পাওয়া কঠিন করে তোলে ।

গভীরতর বিশ্লেষণ: সরকারি সেবায় ডিজিটাল বঞ্চনার বহুমাত্রিক প্রভাব

গবেষণায় দেখা যায়, ডিজিটাল সাক্ষরতার অভাব , সীমিত ডিভাইস প্রবেশাধিকার এবং জটিল, প্রায়শই খণ্ডিত অনলাইন সরকারি পরিষেবা একত্রিত হয়ে দুর্বল জনগোষ্ঠীর জন্য একটি দুষ্টচক্র তৈরি করে। তারা স্বাধীনভাবে অনলাইন পরিষেবাগুলিতে প্রবেশ করতে পারে না, যা তাদের ঐতিহ্যবাহী, প্রায়শই অদক্ষ এবং দুর্নীতিগ্রস্ত, চ্যানেলগুলিতে বাধ্য করে । এটি প্রাতিষ্ঠানিক প্রবেশাধিকারের বাধার একটি প্রকাশ । এর বৃহত্তর প্রভাব হলো, ডিজিটাল রূপান্তর, সমতাবিধানের একটি হাতিয়ার এবং 'অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ' গঠনের মাধ্যম হওয়ার পরিবর্তে , অজান্তেই বঞ্চনার আরেকটি স্তর তৈরি করে। এটি বিদ্যমান অসমতাকে আরও গভীর করে তোলে, কারণ এটি ডিজিটালভাবে শিক্ষিত এবং ধনীদের জন্য প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলিকে আরও সহজলভ্য ও সুবিধাজনক করে তোলে, একই সাথে দরিদ্রদের জন্য নতুন বাধা তৈরি করে এবং অতিরিক্ত খরচ (দালালদের মাধ্যমে) চাপিয়ে দেয়, যারা ইতিমধ্যেই সংগ্রাম করছে । এটি 'ডিজিটাল বাংলাদেশ'-এর লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন উন্নত করার এবং পরিষেবাগুলিতে ন্যায়সঙ্গত প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতিকে মৌলিকভাবে দুর্বল করে।

ই-গভর্নেন্সকে প্রায়শই 'গেটকিপার'-দের সাথে সরাসরি মানবিক মিথস্ক্রিয়া সীমিত করে দুর্নীতি কমানোর একটি হাতিয়ার হিসাবে প্রচার করা হয় । তবে, বাংলাদেশের গবেষণা একটি সূক্ষ্ম বাস্তবতা প্রকাশ করে: দুর্নীতি 'স্থানান্তরিত' হতে পারে বা নতুন অভিনেতাদের (দালাল) উত্থান ঘটাতে পারে । ভূমি প্রশাসনের উদাহরণ দেখায় যে, যদি ডিজিটাল ব্যবস্থা পরিষেবা বিতরণ প্রক্রিয়াটিকে সম্পূর্ণরূপে 'ব্যক্তিগতকরণ' না করে (অর্থাৎ, এখনও শারীরিক জমা বা মিথস্ক্রিয়া প্রয়োজন হয়), তবে কর্মকর্তারা বাধা তৈরি করতে এবং ঘুষ আদায় করার জন্য তাদের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা বজায় রাখেন । একইভাবে, রেলওয়ের অনলাইন টিকিট ব্যবস্থা কাউন্টারে সরাসরি সরকারি দুর্নীতি হ্রাস করলেও, এটি বাহ্যিক কালোবাজারি দালালদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করেছে । এটি নির্দেশ করে যে, শুধুমাত্র একটি পরিষেবা ডিজিটালাইজ করা দুর্নীতি নির্মূল করার জন্য যথেষ্ট নয়। প্রক্রিয়াগুলির ব্যাপক সরলীকরণ, শক্তিশালী প্রয়োগ ব্যবস্থা এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের

প্রয়োজনীয়তা দূর করে এমন প্রকৃত স্বচ্ছতা ছাড়া, ই-গভর্নেন্স অজান্তেই দুর্নীতির নতুন পথ তৈরি করতে পারে বা কেবল সেগুলিকে বিভিন্ন রূপ এবং অভিনেতাদের কাছে স্থানান্তরিত করতে পারে। সমস্যাটি কেবল ডিজিটাল প্রবেশাধিকার নয়, বরং ডিজিটাল বিশ্বাস এবং পদ্ধতিগত সততা।

নাগরিকরা সরকারি পরিষেবাগুলিতে বারবার যাচাইকরণের কারণে 'হাজার হাজার হতাশা'র সম্মুখীন হন । উদাহরণস্বরূপ, একটি সরকারি সংস্থা থেকে প্রাপ্ত পাসপোর্ট বা জাতীয় পরিচয়পত্র (NID) যাচাইকরণ প্রায়শই জন্ম নিবন্ধন মন্ত্রণালয়ের মতো অন্য সংস্থা দ্বারা স্বীকৃত হয় না । এটি নাগরিকদের বারবার তাদের পরিচয় এবং আইনি অবস্থা প্রমাণ করতে বাধ্য করে, যার ফলে চরম হয়রানি, সময় নষ্ট এবং এমনকি ভয় তৈরি হয়, বিশেষ করে গ্রামবাসীদের জন্য যারা আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিগুলির সাথে কম পরিচিত । এই খণ্ডিত এবং অদক্ষ ব্যবস্থা, ডিজিটাল আইডি জারি করার সরকারি প্রচেষ্টা এবং একটি জাতীয় ডেটা এক্সচেঞ্জ (NDX) এর পরিকল্পনার পরেও, সরকারি পরিষেবা এবং বৃহত্তর ডিজিটাল রূপান্তরের প্রতি জনগণের বিশ্বাসকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করে। এটি একটি প্রতিক্রিয়াহীন, অতিরিক্ত আমলাতান্ত্রিক এবং সম্ভাব্য শোষণমূলক রাষ্ট্রের ধারণা তৈরি করে, যা নাগরিকদের দালালদের উপর নির্ভর করতে বাধ্য করে যারা এই 'গোলকধাঁধা' নেভিগেট করার প্রতিশ্রুতি দেয় । উচ্চাভিলাষী 'স্মার্ট বাংলাদেশ' ভিশন সফল হতে হলে, কেবল প্রযুক্তিগত অবকাঠামো নয়, বরং জনগণের মৌলিক আস্থা এবং সরকারি লেনদেনে ন্যায্যতা, দক্ষতা ও সততার ধারণাও প্রয়োজন।

মোবাইল ডেটার মূল্য বৈষম্য: অর্থনৈতিক অসমতার প্রতিফলন

বাংলাদেশে, যেখানে ৯০% এরও বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী মোবাইল ডেটার উপর নির্ভরশীল , সেখানে এর সাশ্রয়ী মূল্য ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বাধা । গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য উচ্চ ইন্টারনেট অ্যাক্সেস খরচ একটি বিশাল বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে নিম্ন আয় এবং সীমিত অর্থনৈতিক সুযোগ ডিজিটাল সংযোগকে একটি প্রয়োজনীয়তার পরিবর্তে বিলাসবহুল পণ্যে পরিণত করেছে ।

মাসিক ৮০-১০০ ডলার আয়কারী অনেক গ্রামীণ পরিবারের জন্য, ইন্টারনেট অ্যাক্সেসের জন্য প্রতি মাসে ১২-১৫ ডলার বরাদ্দ করা (অনলাইন শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয়) একটি কঠিন সিদ্ধান্ত, যা তাদের সামান্য আয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ (১০-১৫%) গ্রাস করে । আঞ্চলিকভাবে এই আর্থিক বোঝা বিশেষভাবে স্পষ্ট: বাংলাদেশের মোবাইল ডেটা প্যাকেজের হার বিশ্বের সর্বোচ্চগুলির মধ্যে অন্যতম, যেখানে এক গিগাবাইটের জন্য ০.৯৯ ডলার খরচ হয়, যা ভারতের ০.২৬ ডলারের তুলনায় অনেক বেশি ।

উচ্চ স্পেকট্রাম খরচ, কর, এবং প্রতিযোগিতার অভাবের প্রভাব

বাংলাদেশে ইন্টারনেটের উচ্চ মূল্যের অন্যতম প্রধান কারণ হলো স্পেকট্রাম নিলামের উচ্চ খরচ এবং মোবাইল অপারেটরদের উপর আরোপিত ভারী কর । উদাহরণস্বরূপ, ২০১৮ সালে ১৮০০ মেগাহার্টজ এবং ২১০০ মেগাহার্টজ স্পেকট্রাম ব্যান্ডের নিলাম মূল্য বিশ্বব্যাপী সর্বোচ্চগুলির মধ্যে ছিল । মোবাইল অপারেটর এবং ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারদের (ISP) উপর উচ্চ ভ্যাট এবং অন্যান্য নিয়ন্ত্রক ফি সহ একটি উল্লেখযোগ্য করের বোঝা রয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের উপর চাপানো হয় । টেলিযোগাযোগ পরিষেবাগুলিতে মোট করের বোঝা ৫৪% এর বেশি, যা বিশ্বব্যাপী সর্বোচ্চগুলির মধ্যে অন্যতম ।

এছাড়াও, বাংলাদেশের ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ বাজার কয়েকটি প্রধান মধ্যস্বত্বভোগীর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, যা সীমিত প্রতিযোগিতার জন্ম দেয় । সুস্থ প্রতিযোগিতার এই অভাব দামকে এমন স্তরে রাখে যা আরও প্রতিযোগিতামূলক বাজারে সম্ভব হতো না। ছোট ISP গুলিকে প্রায়শই এই মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত মূল্যে ব্যান্ডউইথ কিনতে বাধ্য করা হয়, যা ভোক্তাদের খরচ আরও বাড়িয়ে তোলে ।

আয় বৈষম্য ও ডিজিটাল সংযোগের বিলাসিতা

জিডিপি প্রতি মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী ১৩৯তম স্থানে রয়েছে । এর অর্থ হলো, বিশ্বব্যাপী প্রেক্ষাপটে ইন্টারনেটের দাম সাশ্রয়ী মনে হলেও, এটি গড় বাংলাদেশি নাগরিকের পারিবারিক আয়ের একটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ বড় অংশ গ্রাস করে।

বাংলাদেশের মধ্যে বিদ্যমান উল্লেখযোগ্য আয় বৈষম্য, যেখানে শীর্ষ ১% জাতীয় আয়ের একটি বড় অংশ ধরে রাখে, এই বিভেদকে আরও বাড়িয়ে তোলে। জনসংখ্যার বিশাল অংশের জন্য, বিশেষ করে গ্রামীণ দরিদ্রদের জন্য, ইন্টারনেট অ্যাক্সেস একটি মৌলিক প্রয়োজনীয়তার পরিবর্তে বিলাসবহুল পণ্যে পরিণত হয়, যা তাদের ডিজিটাল সুযোগ থেকে আরও বিচ্ছিন্ন করে ।

গভীরতর বিশ্লেষণ: মোবাইল ডেটার মূল্য বৈষম্যের বহুমাত্রিক প্রভাব

যদিও শারীরিক অবকাঠামোতে প্রবেশাধিকার (প্রথম স্তরের ডিজিটাল বিভেদ) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তবে সাশ্রয়ী মূল্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বিতীয় স্তরের বাধা (আর্থিক প্রবেশাধিকার) হিসাবে কাজ করে, বিশেষ করে মোবাইল ডেটার ক্ষেত্রে, যা বাংলাদেশের ৯০% এরও বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর জন্য ইন্টারনেটে প্রবেশাধিকারের প্রাথমিক মাধ্যম । এমনকি যদি একটি মোবাইল টাওয়ার বিদ্যমান থাকে বা ফাইবার ইউনিয়ন পর্যায়ে পৌঁছে যায়, যদি ডেটার খরচ কম আয়ের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য prohibitive হয় , তবে এটি কার্যকরভাবে শারীরিক প্রবেশাধিকারকে বাতিল করে দেয়, এটিকে অকার্যকর করে তোলে। মোবাইল অপারেটরদের উপর আরোপিত উচ্চ স্পেকট্রাম খরচ এবং ভারী কর সরাসরি উচ্চ ভোক্তা মূল্যে রূপান্তরিত হয়। এই আর্থিক বাধা, গ্রামীণ এলাকার কম আয়ের সাথে মিলিত হয়ে, গ্রামীণ এলাকায় কম ইন্টারনেট অনুপ্রবেশ এবং ব্যবহারের সরাসরি কারণ, এমনকি যখন শারীরিক অবকাঠামো নামমাত্র উপস্থিত থাকে । এটি এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করে যেখানে সার্বজনীন সংযোগের 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' ভিশন জনসংখ্যার একটি বড় অংশের জন্য আর্থিকভাবে নাগালের বাইরে থাকে, যা একটি মৌলিক সুবিধাকে একটি অসাধ্য বিলাসে পরিণত করে।

সার্ফশার্কের 'গ্লোবাল ইন্টারনেট ভ্যালু ইনডেক্স'-এ বাংলাদেশের খারাপ অবস্থান নির্দেশ করে যে বাংলাদেশিরা 'তারা যে মানের পরিষেবা পান তার তুলনায় ইন্টারনেটের জন্য বেশি অর্থ প্রদান করছেন' । এটি কেবল উচ্চ পরম মূল্য সম্পর্কে নয়, বরং ধীর গতি এবং দুর্বল অবকাঠামোর কারণে অর্থের জন্য দুর্বল মূল্য সম্পর্কে । এটি বোঝায় যে নীতিগত হস্তক্ষেপগুলি কেবল মূল্য কমানোর উপরই নয়, বরং পরিষেবার

গুণমান এবং নির্ভরযোগ্যতা উন্নত করার উপরও জোর দেওয়া উচিত। যদি ব্যবহারকারীরা মনে করেন যে তারা তাদের অর্থের জন্য খারাপ মূল্য পাচ্ছেন, তবে কম মূল্যও উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যবহার বৃদ্ধি বা কার্যকর ব্যবহারকে চালিত করতে পারে না। এটি পরিষেবা মানের উপর শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক তদারকি, অপারেটরদের উচ্চ স্পেকট্রাম নিলাম ফি সংগ্রহের পরিবর্তে উন্নত অবকাঠামো এবং পরিষেবা বিতরণে বিনিয়োগের জন্য উৎসাহিত করার আহ্বান জানায়। বর্তমান ব্যবস্থাটি ভোক্তা সাশ্রয়ী মূল্য, পরিষেবা মান এবং ন্যায়সঙ্গত প্রবেশাধিকারের চেয়ে সরকারি রাজস্বকে (উচ্চ কর/স্পেকট্রাম খরচের মাধ্যমে) অগ্রাধিকার দেয় বলে মনে হয়।

বাংলাদেশের কম ইন্টারনেট অনুপ্রবেশের হার (জনসংখ্যার প্রায় ৩৯% নিয়মিত ইন্টারনেট ব্যবহার করে; যদিও পারিবারিক প্রবেশাধিকার বেশি, তবে ব্যক্তিগত ব্যবহার পিছিয়ে আছে) পরিষেবা প্রদানকারীদের জন্য উচ্চ পরিচালন ব্যয়ের কারণ হয়, কারণ তারা স্কেল অর্থনীতি অর্জন করতে পারে না। এই উচ্চ পরিচালন ব্যয়গুলি তখন ভোক্তাদের উপর চাপানো হয় । এটি একটি স্ব-স্থায়ী প্রতিক্রিয়ার চক্র তৈরি করে: উচ্চ মূল্য কম অনুপ্রবেশের দিকে নিয়ে যায়, যা ফলস্বরূপ পরিচালন ব্যয়কে উচ্চ রাখে, যার ফলে উচ্চ মূল্য বজায় থাকে। এটি একটি বাজার ব্যর্থতা নির্দেশ করে যেখানে স্কেল অর্থনীতির সুবিধাগুলি প্রাথমিক উচ্চ ব্যয়ের বাধার কারণে সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করা হচ্ছে না। এই চক্র ভাঙতে কৌশলগত, সরকার-সমর্থিত হস্তক্ষেপের প্রয়োজন, যেমন ভর্তুকি বা সম্প্রদায়-ভিত্তিক মডেলের প্রচার , প্রাথমিক অনুপ্রবেশ বাড়ানোর জন্য। ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে, প্রতি ব্যবহারকারীর খরচ স্বাভাবিকভাবেই হ্রাস পাবে, যা পরিষেবাগুলিকে দীর্ঘমেয়াদে আরও সাশ্রয়ী করে তুলবে এবং একটি আরও প্রাণবন্ত ডিজিটাল অর্থনীতি গড়ে তুলবে।

ডিজিটাল শিক্ষা ও পরীক্ষার অসমতা: দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পিছিয়ে পড়া

কোভিড-১৯ মহামারীর সময় অনলাইন শিক্ষায় আকস্মিক, অপরিকল্পিত পরিবর্তন বিদ্যমান শিক্ষাগত অসমতাকে মারাত্মকভাবে উন্মোচন ও বাড়িয়ে দিয়েছে, বিশেষ করে গ্রামীণ ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য । শিক্ষার্থী বা শিক্ষাবিদ কেউই এই দ্রুত পরিবর্তনের জন্য পর্যাপ্তভাবে প্রস্তুত ছিল না । ময়মনসিংহের একটি গ্রামীণ গ্রামে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, অর্থনৈতিক কষ্ট এবং অনলাইন শিক্ষায় প্রবেশাধিকারের গভীর অভাব গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাথমিক উদ্বেগ ছিল । এই শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই অত্যন্ত নিম্ন আয়ের পরিবার থেকে এসেছে, যাদের মাসিক আয় সাধারণত ৮০-১০০ ডলারের মধ্যে ।

ডিভাইস, ইন্টারনেট সংযোগ, এবং ডিজিটাল দক্ষতার অভাব

গবেষণায় উদ্বেগজনক পরিসংখ্যান দেখা গেছে: গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের মাত্র ১% এর বাড়িতে কম্পিউটার ছিল এবং কারো কাছেই ওয়েবক্যাম ছিল না। মাত্র ১৬% এর নিজস্ব স্মার্টফোন এবং হেডফোন ছিল । একটি বড় অংশ (৭৩.৩%) জানিয়েছে যে তারা মহামারীর সময় একটি নতুন স্মার্টফোন কেনার সামর্থ্য রাখে না । ফলস্বরূপ, বেশিরভাগ শিক্ষার্থী (৮১%) ভাগ করা পারিবারিক ডিভাইসের উপর নির্ভর করত, সাধারণত তাদের পিতামাতার স্মার্টফোন, যা প্রায়শই সময়সূচীর বিরোধের কারণে ক্লাস মিস করার কারণ হত । পার্বত্য চট্টগ্রামের (CHT) মতো আদিবাসী গ্রামীণ সম্প্রদায়গুলিতে, কোভিড-১৯ দ্বারা সৃষ্ট আর্থিক পরিস্থিতি পরিবারগুলির জন্য অনলাইন শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ডিজিটাল ডিভাইস কেনার সামর্থ্য রাখা অত্যন্ত কঠিন করে তুলেছিল ।

গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের মাত্র ৫% এর বাড়িতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট প্রবেশাধিকার ছিল; বেশিরভাগই ব্যয়বহুল এবং প্রায়শই অসাধ্য স্মার্টফোন ডেটা প্যাকেজের উপর নির্ভরশীল ছিল । দুর্বল নেটওয়ার্ক অবকাঠামো, ধীর বা অপর্যাপ্ত সংকেত এবং ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাট ছিল উল্লেখযোগ্য বাধা । উদাহরণস্বরূপ, CHT অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের কয়েক কিলোমিটার দূরে বাজারে যেতে হত বা এমনকি অনলাইন ক্লাসে যোগদানের জন্য ছাদের উপর যেতে হত একটি সঠিক সংকেত পাওয়ার জন্য, যা তাদের জন্য উল্লেখযোগ্য হয়রানি সৃষ্টি করত । অনেক শিক্ষার্থী অনলাইন লার্নিং প্ল্যাটফর্মগুলির (যেমন জুম, গুগল মিট) সাথে পরিচিত ছিল না এবং সেগুলিতে কার্যকরভাবে নেভিগেট করার জন্য প্রয়োজনীয় ডিজিটাল সাক্ষরতা দক্ষতার অভাব ছিল, যদিও তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় ছিল । শিক্ষকরাও অনলাইন ক্লাস পরিচালনায় প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছিলেন ।

শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া ও সামাজিক প্রভাব

উচ্চ ব্যয় এবং অনলাইন শিক্ষার অসুবিধার ফলস্বরূপ, জরিপকৃত শিক্ষার্থীদের ২১% তাদের পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়েছে। ঝরে পড়ার প্রধান কারণগুলি ছিল অর্থনৈতিক সংকট (৩২%), পারিবারিক চাপ (২৮%) এবং অনলাইন শিক্ষা চালিয়ে যাওয়ার অসুবিধা (২৪%) । একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা দেখা গেছে যেখানে বিপুল সংখ্যক নারী শিক্ষার্থী (৯০%) কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের পরে বিয়ে করার জন্য পারিবারিক চাপের সম্মুখীন হয়েছিল। ঝরে পড়াদের মধ্যে, ১৬% বিয়ে করার চাপের কারণে তাদের পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়েছে । যদিও শহুরে শিক্ষার্থীরা প্রাথমিকভাবে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল, গ্রামীণ শিক্ষার্থীরাও প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় মানসিক চাপ এবং হতাশায় ভুগেছিল (৪৩% শিক্ষার্থী) ।

অনলাইন পরীক্ষার প্রবেশাধিকারের চ্যালেঞ্জ

অনলাইন পরীক্ষা ব্যবস্থা, যা উন্নত দেশগুলিতে ঐতিহ্যবাহী পরীক্ষার একটি কার্যকর উপাদান হয়ে উঠেছে , বাংলাদেশে গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের জন্য প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্রে গুরুতর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। যদিও অনলাইন পরীক্ষার মাধ্যমে বিভিন্ন ভৌগোলিক অবস্থান থেকে বিপুল সংখ্যক অংশগ্রহণকারীকে একই সাথে পরীক্ষায় বসার সুযোগ তৈরি হয়, যা সময় ও অর্থ সাশ্রয় করে এবং ভ্রমণের ঝামেলা কমায় , তবে এই সুবিধাগুলি গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের জন্য প্রায়শই অপ্রাপ্য। দুর্বল নেটওয়ার্ক কভারেজ, ডিভাইসের অভাব এবং ডিজিটাল সাক্ষরতার নিম্ন স্তর অনলাইন পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় স্থিতিশীল সংযোগ এবং প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের সক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করে । এর ফলে, অনলাইন পরীক্ষা ব্যবস্থা, যা স্বচ্ছতা বাড়াতে এবং প্রশ্ন ফাঁসের ঝুঁকি কমাতে পারে , তা গ্রামীণ দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য আরও একটি বঞ্চনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, কারণ তারা এই সুযোগগুলি থেকে বঞ্চিত হয়।

গভীরতর বিশ্লেষণ: ডিজিটাল শিক্ষা ও পরীক্ষার অসমতার বহুমাত্রিক প্রভাব

কোভিড-১৯ মহামারীকালে অনলাইন শিক্ষায় আকস্মিক পরিবর্তন গ্রামীণ ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য এক নতুন ধরনের বঞ্চনা তৈরি করেছে। অর্থনৈতিক কষ্ট, ডিভাইসের অভাব এবং দুর্বল ইন্টারনেট সংযোগের মতো একাধিক কারণের সমন্বয়ে একটি 'ডিজিটাল লার্নিং গ্যাপ' তৈরি হয়েছে । এই পরিস্থিতি শিক্ষাগত অসমতাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে, কারণ যারা ইতিমধ্যেই প্রান্তিক, তারা ডিজিটাল শিক্ষার সুযোগ থেকে আরও বেশি বঞ্চিত হয়েছে। এটি কেবল শিক্ষার ধারাবাহিকতা ব্যাহত করে না, বরং গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং সামগ্রিক সামাজিক গতিশীলতাকেও মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। ডিজিটাল শিক্ষা, যা শিক্ষাগত সমতা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অনুঘটক হতে পারত , তা একটি বিভেদকারী শক্তিতে পরিণত হয়েছে, যা দরিদ্রদের আরও পিছিয়ে ফেলছে এবং বিদ্যমান দারিদ্র্যচক্রকে শক্তিশালী করছে।

শিক্ষকদের অপ্রস্তুততা এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাব অনলাইন শিক্ষার কার্যকারিতাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করেছে । অনেক শিক্ষক অনলাইন প্ল্যাটফর্মের সাথে অপরিচিত ছিলেন, যার ফলে ক্লাস পরিচালনায় সমস্যা, যোগাযোগে ঘাটতি এবং শিক্ষার্থীদের শেখার প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি হয়েছে। এটি কেবল শিক্ষার্থীদের শেখার অভিজ্ঞতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেনি, বরং শিক্ষার মানের উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এই পরিস্থিতি একটি পদ্ধতিগত দুর্বলতা তুলে ধরে: শুধুমাত্র অবকাঠামো বা ডিভাইস সরবরাহ করা যথেষ্ট নয়; শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ এবং সহায়তা ছাড়া ডিজিটাল শিক্ষা সফল হতে পারে না। এই 'শিক্ষক প্রস্তুতি ঘাটতি' ডিজিটাল শিক্ষার সম্পূর্ণ সম্ভাবনাকে উপলব্ধি করতে বাধা দেয় এবং গ্রামীণ এলাকার শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষার মানকে আরও নিম্নগামী করে তোলে।

অনলাইন শিক্ষার উচ্চ ব্যয় এবং প্রবেশাধিকারের চ্যালেঞ্জের কারণে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধি পেয়েছে, যা একটি 'লুকানো ঝরে পড়া সংকট' নির্দেশ করে । অর্থনৈতিক সংকট, পারিবারিক চাপ এবং অনলাইন শিক্ষার অসুবিধাগুলি শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য করেছে। বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহের চাপ একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা হিসেবে দেখা গেছে । এই পরিস্থিতি শিক্ষার অধিকারকে মৌলিকভাবে লঙ্ঘন করে এবং একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের পথে বড় বাধা সৃষ্টি করে। এটি প্রমাণ করে যে, ডিজিটাল রূপান্তর যদি সমাজের সবচেয়ে দুর্বল অংশকে অন্তর্ভুক্ত না করে, তবে এটি বিদ্যমান সামাজিক সমস্যাগুলিকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদে মানবসম্পদ উন্নয়নকে ব্যাহত করতে পারে, যা জাতীয় উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।

উপসংহার ও সুপারিশ
বাংলাদেশের 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' এর স্বপ্নযাত্রা, যা একটি জ্ঞানভিত্তিক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা বাস্তবতার কঠিন পরীক্ষা সম্মুখীন হয়েছে। এই প্রতিবেদনটি দেখিয়েছে যে, অবকাঠামোগত বৈষম্য, সরকারি পরিষেবা প্রাপ্তিতে বঞ্চনা, মোবাইল ডেটার উচ্চ মূল্য এবং ডিজিটাল শিক্ষা ও পরীক্ষার অসমতা কীভাবে দেশের একটি বিশাল অংশকে ডিজিটাল সুযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। শহরাঞ্চলে ফাইবার ইন্টারনেট এবং গ্রামীণ এলাকায় 2G গতির মধ্যেকার পার্থক্য, দালালদের মাধ্যমে সরকারি পরিষেবা প্রাপ্তির জটিলতা এবং ডিজিটাল সাক্ষরতার অভাব—এগুলো সবই একটি গভীর পদ্ধতিগত সমস্যার ইঙ্গিত দেয়। ডিজিটাল রূপান্তর, যা সমতা আনয়নের কথা ছিল, তা প্রায়শই বিদ্যমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসমতাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে আরও প্রান্তিক করে তুলেছে।

এই বৈষম্য কেবল প্রযুক্তিগত ব্যবধান নয়; এটি অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার একটি প্রতিফলন। উচ্চ স্পেকট্রাম খরচ, অতিরিক্ত কর, সীমিত প্রতিযোগিতা এবং অদক্ষ ব্যবস্থাপনা গ্রামীণ এলাকায় ইন্টারনেটের উচ্চ মূল্যের কারণ, যা ডিজিটাল সংযোগকে একটি বিলাসবহুল পণ্যে পরিণত করে। একই সাথে, ডিজিটাল সাক্ষরতার অভাব এবং ডিভাইসের অপ্রাপ্যতা সরকারি পরিষেবাগুলিতে প্রবেশাধিকারকে বাধাগ্রস্ত করে, যা দালালদের জন্য দুর্নীতির সুযোগ তৈরি করে। শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে, অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থার অপরিকল্পিত বাস্তবায়ন এবং প্রয়োজনীয় সংস্থানগুলির অভাব ব্যাপক ঝরে পড়ার কারণ হয়েছে, যা দেশের ভবিষ্যৎ মানবসম্পদকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে।

একটি সত্যিকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক 'স্মার্ট বাংলাদেশ' গড়ে তোলার জন্য, কেবল প্রযুক্তিগত অবকাঠামো সম্প্রসারণই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন একটি সমন্বিত এবং জন-কেন্দ্রিক নীতি, যা সমাজের সকল স্তরের মানুষের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেবে।

নীতি নির্ধারকদের প্রতি আহ্বান:

১. সাশ্রয়ী ও মানসম্মত ইন্টারনেট নিশ্চিতকরণ:
স্পেকট্রাম ও কর নীতি সংস্কার: মোবাইল অপারেটরদের উপর আরোপিত উচ্চ স্পেকট্রাম খরচ এবং করের বোঝা কমাতে হবে । এটি মোবাইল ডেটার মূল্য কমাতে সাহায্য করবে এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য ইন্টারনেটকে আরও সাশ্রয়ী করে তুলবে ।

অবকাঠামো ভাগাভাগি ও প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি: ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্কস (NTTN) এর মতো মধ্যস্বত্বভোগীদের ভূমিকা কমাতে হবে এবং অবকাঠামো ভাগাভাগিকে উৎসাহিত করতে হবে । এটি পরিচালন ব্যয় হ্রাস করবে এবং বাজারে সুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি করবে, যা পরিষেবার মান উন্নত করবে ।

গ্রামীণ এলাকায় ফাইবার অপটিক সম্প্রসারণ: সরকারি বিনিয়োগের সুফল যাতে গ্রামীণ এলাকা পর্যন্ত পৌঁছায়, তা নিশ্চিত করতে হবে এবং উচ্চ ট্রান্সমিশন খরচ কমানোর জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে ।
বিকল্প সংযোগের অন্বেষণ: দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্টারলিংকের মতো স্যাটেলাইট ইন্টারনেট পরিষেবা ব্যবহারের সম্ভাব্যতা যাচাই করতে হবে, এবং এর খরচ কমাতে সরকারি ভর্তুকি বা কমিউনিটি-ভিত্তিক মডেল চালু করতে হবে ।

২. ডিজিটাল সাক্ষরতা ও ডিভাইসের প্রবেশাধিকার বৃদ্ধি:
ব্যাপক ডিজিটাল সাক্ষরতা কর্মসূচি: গ্রামীণ এলাকায় ডিজিটাল সাক্ষরতা বাড়ানোর জন্য স্থানীয়ভাবে অভিযোজিত প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করতে হবে । এই কর্মসূচিগুলিতে ইন্টারনেট ব্যবহার, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম নেভিগেট করা এবং ডিজিটাল পরিষেবাগুলি ব্যবহার করার মৌলিক দক্ষতা শেখানো উচিত।

ডিভাইস ভর্তুকি ও সহজলভ্যতা: দরিদ্র পরিবারগুলির জন্য স্মার্টফোন, কম্পিউটার এবং অন্যান্য ডিজিটাল ডিভাইসের জন্য ভর্তুকি বা সহজ কিস্তির ব্যবস্থা করতে হবে । কমিউনিটি সেন্টার বা স্কুলগুলিতে পাবলিক অ্যাক্সেস পয়েন্ট তৈরি করে ডিভাইসের অভাব দূর করা যেতে পারে ।

৩. সরকারি পরিষেবাগুলির পূর্ণাঙ্গ ডিজিটালাইজেশন ও সরলীকরণ:
একীভূত ডেটাবেস ও যাচাইকরণ ব্যবস্থা: জাতীয় আইডি (NID), জন্ম নিবন্ধন সনদ এবং পাসপোর্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ ডেটাবেসগুলিকে একীভূত করতে হবে এবং একটি জাতীয় ডেটা এক্সচেঞ্জ (NDX) প্রতিষ্ঠা করতে হবে । এটি অপ্রয়োজনীয় যাচাইকরণ প্রক্রিয়া দূর করবে এবং নাগরিকদের হয়রানি কমাবে ।

দালালদের প্রভাব হ্রাস: সরকারি পরিষেবা প্রদানের প্রক্রিয়াগুলিকে আরও স্বচ্ছ, সহজ এবং সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তিগতকরণ করতে হবে, যাতে দালালদের হস্তক্ষেপের সুযোগ না থাকে । দুর্নীতি দমনের জন্য কঠোর প্রয়োগ এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে ।

নাগরিক-কেন্দ্রিক পরিষেবা ডিজাইন: সরকারি পরিষেবাগুলি এমনভাবে ডিজাইন করতে হবে যাতে সেগুলি সকল স্তরের ডিজিটাল সাক্ষরতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য সহজবোধ্য এবং ব্যবহারকারী-বান্ধব হয় ।

৪. ডিজিটাল শিক্ষায় সমতা নিশ্চিতকরণ:
শিক্ষার্থীদের জন্য ডিজিটাল সংস্থান সরবরাহ: দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য ডিভাইস, ইন্টারনেট সংযোগ এবং ডিজিটাল শিক্ষাসামগ্রী নিশ্চিত করতে হবে ।

শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধি: শিক্ষকদের অনলাইন শিক্ষাদান পদ্ধতি এবং ডিজিটাল সরঞ্জাম ব্যবহারে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে ।

মিশ্র শিক্ষা পদ্ধতি: অনলাইন এবং অফলাইন শিক্ষার একটি সমন্বিত মডেল গ্রহণ করতে হবে, যা গ্রামীণ এলাকার বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিয়ে তৈরি হবে।

ডিজিটাল বৈষম্য দূর করা কেবল ন্যায্যতার বিষয় নয়, এটি বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়নে একটি কৌশলগত বিনিয়োগ । একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল সমাজ গড়ে তোলার মাধ্যমে বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে পারে, লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে পারে এবং একটি সত্যিকারের 'স্মার্ট বাংলাদেশ' এর স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পারে। এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে, সরকারকে অবশ্যই দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা, কার্যকর নীতি বাস্তবায়ন এবং সকল অংশীজনদের সাথে নিবিড় সহযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে।
ডিজিটাল বৈষম্য ও স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের চ্যালেঞ্জ | KalpaKatha360

📌 পাঠকদের প্রতি আন্তরিক অনুরোধ

এই লেখা কল্পকথা ৩৬০-এর একটি অনুভবময়, পাঠকবান্ধব উপস্থাপন। বিষয়বস্তু ভিন্ন ভিন্ন হলেও, প্রতিটি লেখায় আমরা পাঠকের সঙ্গে ভাবনার বন্ধন গড়তে চাই। আপনার মতামত, পরামর্শ ও সংশোধন আমাদের কাজকে আরও সমৃদ্ধ করবে। অনিচ্ছাকৃত কোনো ত্রুটি বা অসঙ্গতি থেকে থাকলে, দয়া করে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

✍️ আপনার মতামত আমাদের অনুপ্রেরণা — আপনার সংক্ষেপণ, পরামর্শ বা মতামত কমেন্টে জানালে আমরা কৃতজ্ঞ থাকব। এতে আমাদের কাজ আরও নির্ভুল, মানবিক ও পাঠকবান্ধব হবে।

🤝 আপনার সহযোগিতা আমাদের চলার পথ — পাঠকই লেখার প্রাণ। ভালো লেগে থাকলে জানাতে ভুলবেন না, ত্রুটি থাকলে তা ধরিয়ে দিন। আমরা সবসময় শেখার চেষ্টা করি।

❤️ কল্পকথা ৩৬০ – পাঠকের ভালোবাসায় পথ চলে

Post a Comment

🌸 আপনার মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ!
আপনার মতামত আমাদের অনুপ্রাণিত করে এবং আগামীতে আরও মানসম্পন্ন কনটেন্ট তৈরিতে সহায়তা করে।
আপনি যদি কোনো নির্দিষ্ট বিষয় বা গল্প পছন্দ করে থাকেন, জানালে ভালো লাগবে।
নিয়মিত পাশে থাকুন — আপনার সহযোগিতা ও ভালোবাসাই আমাদের এগিয়ে চলার শক্তি।

শুভ কামনায়,
✍️ কল্পকথা-৩৬০ ব্লগ টিম
https://kalpakatha360.blogspot.com

Previous Post Next Post