একটি প্লাস্টিকের ট্রলিতে গুছানো থাকে তার সব কিছু—এক জোড়া জামা, কয়েকটা পুরোনো চিঠি, আর একটা কোরআন শরীফ। সিঙ্গাপুরের এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে থাকা সেই যুবককে দেখে আপনি বুঝতেই পারবেন না—সে আসলে একটা দেশও বয়ে নিয়ে যাচ্ছে তার পিঠে।
এটা কোনো কল্পকাহিনি নয়—এটা একটি বাস্তবতা, যা প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি প্রবাসী প্রতিদিন বহন করে চলেছে। বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে যারা দেশ ছাড়ে, তারা সত্যিই কি কোনোদিন সেই স্বপ্ন ছুঁতে পারে?
বিশ্বব্যাপী শ্রমিক রপ্তানির বাজারে বাংলাদেশ অন্যতম বড় "সাপ্লায়ার" দেশ। কিন্তু প্রশ্ন হলো—আমরাই কি সবচেয়ে বেশি নিঃস্ব, সবচেয়ে বেশি শোষিত, সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত? কেন একজন বাংলাদেশি শ্রমিক মালয়েশিয়া গিয়ে ফিলিপাইনের শ্রমিকের চেয়ে তিনগুণ খরচ করে, অথচ পায় অর্ধেক সুবিধা?
কেন শুধু বাংলাদেশি শ্রমিকই এজেন্ট, দালাল, ভিসা বাণিজ্য আর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বলি হয়?
এই লেখায় আমরা খোঁজ করবো সেই বাস্তবতার, যেটা কখনও মঞ্চে আসে না, কখনও সরকারি বিজ্ঞাপনে জায়গা পায় না। আমরা জানবো—কেন বাংলাদেশের শ্রমিকেরা পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃস্ব স্বপ্নবাহক হয়ে উঠেছে, আর কে-কে এর জন্য দায়ী।
এই গল্প শুধু একজন প্রবাসীর নয়, এই গল্প আমাদের নীতি, আমাদের অবহেলা, আর আমাদের চেতনার ভাঙনের গল্প। এখন প্রশ্ন—আমরা কি শুনতে প্রস্তুত?
বাংলাদেশি শ্রমিক সমস্যা, জনশক্তি রপ্তানি, মালয়েশিয়া শ্রমিক ভিসা, রেমিট্যান্স হিরো, রিক্রুটিং দুর্নীতি, G2G চুক্তি, শ্রমিকদের দুর্দশা,🎭 “জীবনের সব বাজি ধরে, ফিরল না কিছু”
নাম আলাউদ্দিন। নোয়াখালীর এক মফস্বল গ্রামের যুবক। স্থানীয় টেকনিক্যাল স্কুল থেকে ইলেকট্রিক্যাল ট্রেনিং নেয়। স্বপ্ন—একদিন মালয়েশিয়া যাবে, ভালো কোম্পানিতে চাকরি করবে, মাকে একটা ফ্রিজ কিনে দেবে।
রিক্রুটিং এজেন্সির লোক এসে বলল, “ভিসা নিশ্চিত, ৩.৮ লক্ষ টাকা লাগবে, ৬ মাসে চলে যাবে।”
আলাউদ্দিনের পরিবার তাদের শেষ সম্বল বিক্রি করল—মায়ের বিয়ের সময় পাওয়া সোনার দুল, বাবার একমাত্র বাইসাইকেল, এমনকি বড় ভাইয়ের হালের গরু পর্যন্ত।
ভিসা এল এক বছরের মাথায়। কোম্পানির নাম ঠিকঠাক ছিল না, কাজ পাওয়া গেল একটা কনস্ট্রাকশন সাইটে, দিনে ১২ ঘণ্টা, সপ্তাহে ৭ দিন, মাসে ১ হাজার রিঙ্গিত (প্রায় ২৫,০০০ টাকা)। খাবার কোম্পানি দিত না, থাকার ঘর ছিল প্লাস্টিকের ছাউনি দেওয়া গরম টিনের ঘর।
চার মাসেই তার পায়ে চোট লাগে। কোম্পানি তাকে সরিয়ে দেয়। কোন চিকিৎসা নেই, নতুন কাজ নেই। দালাল ফোন ধরে না, বাংলাদেশ হাইকমিশন “কাগজপত্র দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস” দেয়। হঠাৎই একদিন দেশে ফিরতে হয় নিজ খরচে।
🔚 ফিরে এসে দেখে—
জমি বন্ধক রাখা থাকলেও ঋণ পরিশোধ হয়নি,
মা অসুস্থ হয়ে গেছেন,
এলাকার মানুষ বলে—“বিদেশে গেলি তো, এখন আবার অভাব কীসের?”
আলাউদ্দিন আজ একজন মানসিকভাবে ভেঙে পড়া যুবক, জীবনের মূল্য এখন তার কাছে প্রশ্নবোধক চিহ্ন।
📊 বাস্তব উদাহরণ ও পরিসংখ্যান
১. রিক্রুটিং দুর্নীতির বাস্তব চিত্র:
২০২২ সালে মালয়েশিয়া সরকার ২৭টি বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সিকে একচেটিয়া নিয়োগে যুক্ত করে—যা নিয়ন্ত্রণ করত কয়েকজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী।
💸 ফলাফল: একজন শ্রমিকের ভিসা ফি যেখানে ১–১.৫ লাখ টাকার মধ্যে হওয়া উচিত, সেখানে তা ৪–৫ লক্ষে পৌঁছে যায়।
২. G2G চুক্তি ব্যর্থতা:
বাংলাদেশের G2G প্ল্যাটফর্ম তৈরির পরও নেপাল ও ফিলিপিনো শ্রমিকদের তুলনায় দ্রুত প্রক্রিয়া, কম খরচ এবং আরও নির্ভরযোগ্য চাকরি নিশ্চিত হয়।
📉 বাংলাদেশের অধিকাংশ শ্রমিক অদক্ষ বা ট্রেনিং ছাড়া বিদেশে যায়, যার ফলে ভালো কোম্পানিগুলো বাংলাদেশি শ্রমিক নিতে অনাগ্রহী হয়ে পড়ে।
৩. মানবেতর জীবনযাত্রা ও মৃত্যুর হার:
মালয়েশিয়ায় ২০২3 সালে ৪২ জন বাংলাদেশি শ্রমিক মৃত্যুবরণ করে—অধিকাংশই চিকিৎসাহীনতা, কাজের চাপ বা অবহেলার শিকার।
💔 আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো জানিয়েছে—বাংলাদেশি শ্রমিকেরা সবচেয়ে বেশি “আনরেজিস্টার্ড ও আনপ্রটেক্টেড” অবস্থায় থাকে।
শ্রমিকের রক্তে ভেজা রেমিট্যান্স: মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে বাংলাদেশিদের বঞ্চনার করুণ উপাখ্যান
একবুক স্বপ্ন নিয়ে গ্রামের সহজ-সরল তরুণটি যখন ভিটেমাটি বিক্রি করে মালয়েশিয়ার উড়োজাহাজে পা রাখে, তখন তার চোখে থাকে সোনালি ভবিষ্যতের হাতছানি। সে ভাবে, কয়েকটা বছর কষ্ট করলেই পরিবারের মুখে হাসি ফুটবে, বোনের বিয়ের টাকা জোগাড় হবে, একটা পাকা বাড়ি উঠবে। কিন্তু মালয়েশিয়ার মাটিতে পা রাখার পরেই সেই স্বপ্ন ধীরে ধীরে দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে শুরু করে। যে দেশটাকে সে ভেবেছিল স্বপ্নের স্বর্গ, সেই দেশেই তার জন্য অপেক্ষা করে সীমাহীন বঞ্চনা, শোষণ আর অমানবিকতার এক কঠিন বাস্তবতা।
এটি শুধু একজন শ্রমিকের গল্প নয়, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিকের এক জীবন্ত উপাখ্যান। যে রেমিট্যান্সের টাকায় আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল থাকে, সেই টাকার প্রতিটি কণার পেছনে লুকিয়ে আছে এমন হাজারো না বলা কষ্ট, বঞ্চনা আর প্রতারণার ইতিহাস। আর এই প্রতারণার মূল কারণ আমাদের নিজেদের সিস্টেমের গভীরে প্রোথিত। আমরা সবসময়ই যেন "লেট লতিফ"। যখন অন্য দেশগুলো তাদের শ্রমিক পাঠিয়ে শ্রমবাজারের ভালো অংশটা দখল করে নেয়, আমাদের হুঁশ ফেরে তখন। আর এর নির্মম শিকার হয় আমাদের দেশের সাধারণ মানুষগুলো।
কেন আমরা সবসময় পিছিয়ে? খেলার আগেই হেরে যাওয়ার প্রস্তুতি
আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম, কিন্তু আমাদের নীতি নির্ধারকদের অদূরদর্শিতা এবং একটি স্বার্থান্বেষী চক্রের কারণে আমরা আমাদের সম্ভাবনার সদ্ব্যবহার করতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছি। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
যখন নেপাল, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম বা ফিলিপাইনের মতো দেশগুলো মালয়েশিয়ার সাথে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে অত্যন্ত কম খরচে এবং স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় তাদের শ্রমিকদের পাঠাতে শুরু করে, বাংলাদেশ তখন অভ্যন্তরীণ কোন্দল, রাজনৈতিক দড়ি টানাটানি আর রিক্রুটিং এজেন্সির সিন্ডিকেটের খেলায় মত্ত থাকে। বছরের পর বছর আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণ করা হয়। যখন মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার প্রায় শেষের দিকে, ভালো কোম্পানিগুলোর চাহিদা যখন পূরণ হয়ে গেছে, তখন তাড়াহুড়ো করে একটি অস্বচ্ছ চুক্তি করা হয়।
এর ফলাফল কী দাঁড়ায়?
১. উচ্চ অভিবাসন ব্যয়: যেখানে একজন নেপালি বা ভিয়েতনামি শ্রমিক এক থেকে দেড় লাখ টাকায় মালয়েশিয়া যায়, সেখানে একজন বাংলাদেশি শ্রমিকের খরচ দাঁড়ায় পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা। এই অতিরিক্ত টাকা যায় কোথায়? এর সিংহভাগই চলে যায় দুই দেশের দালাল, এজেন্ট এবং শক্তিশালী রিক্রুটিং এজেন্সির সিন্ডিকেটের পকেটে। শ্রমিকের পরিবারকে জমি বিক্রি করতে হয়, চড়া সুদে ঋণ নিতে হয়, যা শোধ করতে করতেই তার চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়।
২. নিম্নমানের কাজ: যেহেতু আমরা দেরিতে প্রবেশ করি, তাই ভালো এবং নামকরা কোম্পানিগুলোর শ্রমিক কোটা পূরণ হয়ে যায়। আমাদের শ্রমিকদের জন্য পড়ে থাকে নিম্নমানের, ঝুঁকিপূর্ণ এবং কম বেতনের কাজ। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের নির্মাণাধীন সাইট, অনিরাপদ কারখানা বা কৃষি খামারে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়, যেখানে ন্যূনতম নিরাপত্তা বা কাজের পরিবেশের নিশ্চয়তা থাকে না।
৩. প্রতারণার শিকার: অনেক শ্রমিক মালয়েশিয়ায় গিয়ে দেখেন, যে কোম্পানির কথা বলে তাদের আনা হয়েছে, তার কোনো অস্তিত্বই নেই। কিংবা যে বেতন আর সুযোগ-সুবিধার কথা বলা হয়েছিল, তার সাথে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। তখন তারা অবৈধ হয়ে যেতে বাধ্য হয়। বৈধ কাগজপত্র ছাড়া একজন শ্রমিক তখন হয়ে ওঠে আধুনিক যুগের দাস। ন্যূনতম বেতনের জন্য তাকে দিনরাত খাটতে হয়, পুলিশের হাতে ধরা পড়ার ভয় নিয়ে তাকে প্রতি মুহূর্তে বাঁচতে হয়।
স্বার্থপরতার দুষ্টচক্র: কারা এই খলনায়ক?
এই ট্র্যাজেডি বা দুঃখজনক ঘটনার পেছনে রয়েছে একটি শক্তিশালী এবং লোভী চক্র। এই চক্রের সদস্যরা হলেন কিছু অসাধু আমলা, দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক নেতা এবং অর্থলোভী রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক।
আমলাতান্ত্রিক জটিলতা: সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং দপ্তরগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এবং দীর্ঘসূত্রিতা একটি বড় সমস্যা। একটি চুক্তি চূড়ান্ত করতে এবং প্রক্রিয়া শুরু করতে অপ্রয়োজনীয়ভাবে মাসের পর মাস, এমনকি বছর পার করে দেওয়া হয়। এই দেরির সুযোগ নেয় স্বার্থান্বেষী মহল।
রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব: প্রবাসী শ্রমিকদের ভাগ্য উন্নয়ন যেন আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে কখনোই অগ্রাধিকার পায় না। তাদের সস্তা শ্রম এবং পাঠানো রেমিট্যান্স নিয়ে সবাই গর্ব করে, কিন্তু তাদের অধিকার এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। নির্বাচন এলে তাদের পরিবারের কাছে ভোট চাওয়া হয়, কিন্তু তাদের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে কেউ ভাবে না।
রিক্রুটিং এজেন্সির সিন্ডিকেট: এরাই এই খেলার সবচেয়ে বড় খলনায়ক। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বারবার একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক এজেন্সির সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। তারা যোগসাজশ করে অভিবাসন ব্যয় কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে তোলে। তাদের একচেটিয়া আধিপত্যের কারণে সাধারণ শ্রমিকদের আর কোনো উপায় থাকে না। এই সিন্ডিকেট এতটাই শক্তিশালী যে তারা সরকারের নীতি নির্ধারণকেও প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে।
এই চক্রের মূল উদ্দেশ্য একটাই—সাধারণ মানুষের ভাগ্য নিয়ে ব্যবসা করা। তাদের কাছে একজন শ্রমিক মানুষ নয়, কেবলই টাকা বানানোর একটি যন্ত্র। তাদের লোভের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় লক্ষ লক্ষ তরুণের স্বপ্ন আর তাদের পরিবারের আশা।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট: অন্যেরা পারলে আমরা কেন পারি না?
এটি ভাবা ভুল যে, সব দেশেই শ্রমিকরা এমন বঞ্চনার শিকার হয়। ফিলিপাইনের দিকে তাকান। তারা তাদের প্রবাসী শ্রমিকদের "আধুনিক যুগের নায়ক" (modern-day heroes) বলে অভিহিত করে এবং তাদের সুরক্ষার জন্য অত্যন্ত কঠোর আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন করেছে।
ফিলিপাইন মডেল: ফিলিপাইন সরকার তাদের শ্রমিকদের জন্য একটি সর্বনিম্ন অভিবাসন ব্যয় নির্ধারণ করে দিয়েছে। কোনো এজেন্সি এর বেশি টাকা নিতে পারে না। তাদের দূতাবাসগুলো অত্যন্ত সক্রিয় এবং কোনো শ্রমিকের সঙ্গে অন্যায় হলে তারা দ্রুত আইনি পদক্ষেপ নেয়। তাদের শক্তিশালী "Philippine Overseas Employment Administration" (POEA) পুরো প্রক্রিয়াটি কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করে।
নেপালের উদাহরণ: নেপালের মতো একটি ছোট দেশও তাদের শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে অনেক বেশি সোচ্চার। তারা মালয়েশিয়ার সাথে অত্যন্ত কম খরচে শ্রমিক পাঠানোর চুক্তি করেছে এবং দালালদের দৌরাত্ম্য কমাতে পেরেছে।
তাহলে প্রশ্ন জাগে, অর্থনীতিতে এবং আকারে অনেক বড় হয়েও বাংলাদেশ কেন পারে না? উত্তরটা সহজ—আমাদের সদিচ্ছার অভাব। আমাদের নীতি নির্ধারকরা সাধারণ মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের চেয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিকেই বড় করে দেখেন। আমাদের দেশের মানুষের প্রতি তাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই।
আবেগের ঊর্ধ্বে বাস্তবতা: একজন শ্রমিকের জীবন
কল্পনা করুন সেই শ্রমিকের কথা, যে ছয় লাখ টাকা খরচ করে মালয়েশিয়া গিয়ে মাসে মাত্র ১৮০০ রিঙ্গিত (প্রায় ৫০,০০০ টাকা) বেতন পায়। এই টাকা থেকে তার থাকা-খাওয়ার খরচ, ঋণের কিস্তি, আর পরিবারের জন্য টাকা পাঠাতে হয়। দিনরাত হাড়ভাঙা খাটুনির পর তার নিজের জন্য কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।
অনেক সময় মালিক ঠিকমতো বেতন দেয় না, পাসপোর্ট কেড়ে নেয়, অসুস্থ হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে না। তখন তার জীবন হয়ে ওঠে এক দুঃসহ কারাগার। সে না পারে দেশে ফিরে আসতে, না পারে সেখানে শান্তিতে থাকতে। এই মানসিক যন্ত্রণা এবং অর্থনৈতিক চাপ অনেককে আত্মহত্যার পথেও ঠেলে দেয়।
আর যারা অবৈধ হয়ে যায়, তাদের জীবন আরও ভয়াবহ। পুলিশের তাড়া খেয়ে জঙ্গলে বা নির্মাণাধীন ভবনে লুকিয়ে থাকা, দিনের পর দিন না খেয়ে থাকা—এটাই তাদের নিয়তি হয়ে দাঁড়ায়। এই মানুষগুলোর কান্নার শব্দ কি আমাদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে থাকা নীতি নির্ধারকদের কানে পৌঁছায়?
কী হতে পারে সমাধান? প্রতিবাদের ভাষা হোক জোরালো
এই সমস্যার সমাধান রাতারাতি সম্ভব নয়, কিন্তু এখনই যদি পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও একই ভাগ্য বরণ করতে হবে।
সরকারের করণীয়:
১. সিন্ডিকেট ভাঙা: যেকোনো মূল্যে রিক্রুটিং এজেন্সির সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে। লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনতে হবে এবং সব যোগ্য এজেন্সিকে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে।
২. স্বচ্ছ এবং স্বল্প খরচের চুক্তি: অন্য দেশগুলোর মতো জি-টু-জি (সরকার থেকে সরকার) পদ্ধতিতে স্বচ্ছ চুক্তি করতে হবে এবং অভিবাসন ব্যয় ১.৫ লাখ টাকার নিচে নামিয়ে আনতে হবে।
৩. দূতাবাসকে শক্তিশালী করা: বিদেশে বাংলাদেশি দূতাবাসগুলোকে কেবল পাসপোর্ট রিনিউ করার অফিসে পরিণত না করে শ্রমিকদের আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত করতে হবে। তাদের জন্য সার্বক্ষণিক হটলাইন, আইনি সহায়তা এবং জরুরি আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
৪. কঠোর আইন প্রয়োগ: কোনো এজেন্সির বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের লাইসেন্স বাতিলসহ মালিকদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করতে হবে। মানব পাচারকে সর্বোচ্চ অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে।
জনগণের করণীয়:
১. সচেতনতা: না জেনে, না বুঝে দালালের খপ্পরে পড়া যাবে না। সরকারের নির্ধারিত প্রক্রিয়া এবং খরচ সম্পর্কে জানতে হবে।
২. সামাজিক প্রতিরোধ: এই অন্যায় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই বিষয়গুলো নিয়ে আরও বেশি আলোচনা হওয়া দরকার।
আমাদের অর্থনীতির স্তম্ভ যে প্রবাসী শ্রমিকদের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তাদের জীবনের ভিত এত নড়বড়ে হতে পারে না। তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স দিয়ে আমরা পদ্মা সেতু বানাই, মেট্রোরেলে চড়ি, কিন্তু তাদের জীবনের ন্যূনতম নিরাপত্তা দিতে আমরা ব্যর্থ। এই লজ্জা আমাদের সবার।
সময় এসেছে এই স্বার্থপরতার দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসার। শ্রমিকের রক্ত আর ঘামে ভেজা টাকায় বিলাসী জীবনযাপন করা দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে, একজন শ্রমিক যখন বিদেশে প্রতারিত হয়, তখন শুধু সে একা হারে না, হেরে যায় পুরো বাংলাদেশ। তার ভাঙা স্বপ্নগুলোর দায় আমাদের সবাইকে নিতে হবে। নইলে একদিন হয়তো এই রেমিট্যান্সের প্রবাহ থেমে যাবে, আর আমাদের অর্থনীতির প্রাসাদ হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে।
🌸 আপনার মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ!
আপনার মতামত আমাদের অনুপ্রাণিত করে এবং আগামীতে আরও মানসম্পন্ন কনটেন্ট তৈরিতে সহায়তা করে।
আপনি যদি কোনো নির্দিষ্ট বিষয় বা গল্প পছন্দ করে থাকেন, জানালে ভালো লাগবে।
নিয়মিত পাশে থাকুন — আপনার সহযোগিতা ও ভালোবাসাই আমাদের এগিয়ে চলার শক্তি।
শুভ কামনায়,
✍️ কল্পকথা-৩৬০ ব্লগ টিম
https://kalpakatha360.blogspot.com