রাস্তার ধারে দুটো মানুষের মধ্যে তুমুল ঝগড়া চলছে, হয়তো সামান্য হাতাহাতিও। জটলা করে দাঁড়িয়ে থাকা উৎসুক জনতার মধ্যে থেকে কেউ একজন পকেট থেকে স্মার্টফোনটা বের করলেন। সাহায্য করতে বা ঝগড়া থামাতে নয়, ভিডিও করতে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সেই ভিডিও ফেসবুকের ওয়ালে, ইউটিউবের শর্টসে বা টিকটকের ফিডে ঘুরতে শুরু করলো। হাজার হাজার লাইক, শত শত শেয়ার আর অজস্র কমেন্টের বন্যায় ভেসে যাচ্ছে সেই ভিডিও। কেউ হাসির ইমোজি দিচ্ছে, কেউবা জানাচ্ছে ধিক্কার। কিন্তু একবার কি আমরা ভেবে দেখেছি, এই যে অন্যের অপমান, অসহায়ত্ব বা বিপদকে আমরা অবলীলায় ক্যামেরাবন্দী করে ‘কন্টেন্ট’ বানিয়ে ফেলছি, এর শেষ কোথায়?
একসময় অন্যায় দেখলে মানুষ প্রতিবাদ করত, অন্তত, সবচেয়ে কম হলেও, অন্যায়কারীদের ঘৃণা করতো, অন্যায়কারীদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিত। আর এখন? অন্যায় আমাদের বিনোদনের নতুন খোরাক। কারো ব্যক্তিগত মুহূর্তের কান্না, কারো দূর্বলতার প্রকাশ—সবই এখন আমাদের ডিজিটাল ক্ষুধা মেটানোর উপকরণ। এই ‘ভিউ’ আর ‘ভাইরাল’ হওয়ার দৌড়ে আমরা কি আমাদের ভেতরের মানুষটাকে হারিয়ে ফেলছি? সংবেদনশীলতা কি কেবলই একটি শব্দ যা বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ থাকছে?
এই লেখায় আমরা কোনো চূড়ান্ত রায় দিতে আসিনি। বরং একবিংশ শতাব্দীর এই ডিজিটাল সভ্যতার আয়নায় নিজেদের মুখটা একবার খোলা চোখে দেখতে এসেছি। চলুন, সেই অস্বস্তিকর প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হই, যা হয়তো আপনার মনেও উঁকি দিয়েছে বহুবার। আসুন, একসাথে ভাবি—অন্যায় যখন স্রেফ কন্টেন্ট, তখন আমাদের সমাজ আসলে কোন পথে হাঁটছে?
একটা রাস্তা। একটা ভাঙা চশমা। একটু রক্ত। একটা শিশুর কান্না—পেছনে কেউ নেই, সামনে কেউ দাঁড়ায় না।
খবরের কাগজে হয়তো এটা "আরেকটা খুন" নামে ছাপা হবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় হয়তো কেউ বলবে, “জানো? আজ সকালে আবার একটা খুন!” তারপর চা, খবর, রিল—জীবন চলতে থাকবে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই চলা কি মানুষ হিসেবে বাঁচা, নাকি কেবল নিঃশ্বাস টানা? আমরা কি এমন সমাজে বাস করছি, যেখানে আর কারও মৃত্যু আমাদের মনে রেখাপাত করে না? নাকি আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি, রক্ত দেখে স্ক্রল করে যাওয়ার?
গতকাল এক যুবকের নির্মম খুন, এক নারীর ওপর নৃশংস ধর্ষণ, বাবা-মেয়ে, মা-ছেলে, বন্ধু-বন্ধুর ওপর হত্যাকাণ্ড। তুমি সে সমস্ত ঘটনা লাইভে দেখলে। হয়তো লাইকও দিলে, কেউ কেউ শেয়ারও করল। কিন্তু তুমি কি একবারও ভাবলে—এই মৃত্যুটা কারো পৃথিবী ভেঙে দেওয়ার সমান ছিল?
আমরা এখন এমন এক সময়ে বাস করছি, যেখানে একটা নিঃশেষ জীবন, একটা "breaking" ব্যানারে, বা ৩০ সেকেন্ডের রিলের ভেতরে আটকে যায়।
মৃত্যু এখন আর থেমে দাঁড়ানো, প্রার্থনা করা, কষ্ট পাওয়ার কারণ নয়। মৃত্যু এখন engagement বাড়ানোর কৌশল। একটা কন্টেন্ট পিস। একটা স্টোরি আইডিয়া। টাকা ইনকামের কৌশল।
একটা সময় ছিল, কারো মৃত্যু মানেই ছিল—চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে যেত, বাড়ির বাতি কমিয়ে দেওয়া হতো। সেসব পরিবারের প্রতি ছিল গভীর সমবেদনা। এখন কেউ মরলে—সবার ক্যামেরা অন হয়ে যায়।
তুমি কি এই সমাজে মানুষ হয়ে বেঁচে আছো, নাকি শুধু ভিউস-এর ভিড়ে বেঁচে থাকছো?
এই লেখা কোনো অভিযোগ নয়। এটা একটা আয়না। যেখানে তুমি নিজেকে দেখে নিতে পারো—তোমার মানবতা আজ কোথায় দাঁড়িয়ে?
এই লেখা কোনো খবর নয়। এটা একটা প্রশ্ন— আমাদের সকলের হৃদয়ের কাছে। আর একটা আহ্বান—যদি এখনও আমাদের সবার ভেতরের মনুষ্যত্বটা বেঁচে থাকে।
মানবিকতা, সামাজিক অবক্ষয়, খুনের খবর, ভাইরাল কনটেন্ট, সমাজ সচেতনতা, সোশ্যাল মিডিয়া, empathy, humanity lost, বাংলাদেশএকসময় সন্ধে মানেই ঘরে ফেরার তাড়া ছিল। রাস্তায় ছেলেমেয়েরা খেলতো, বুড়ো মানুষ গল্প করতো, দোকানদার মুচকি হাসতো। আজ সেই রাস্তায় রক্ত, ক্যামেরা, আর খবরের শিরোনাম।
আমরা কত দ্রুত ভুলতে শিখে গেছি! শিখে যাচ্ছি! গতকালের খুনের খবর, আজকের চায়ের আড্ডায় হাসির ফাঁকে হারিয়ে যায়।
মানবিকতা এখন কন্টেন্টের বিষয়!
খুনের দৃশ্য, ধর্ষণের দৃশ্য, মারামারি-হাতাহাতি সহ কতশত ভিডিও ফেসবুক লাইভে। মায়ের কান্না; বাবার আর্তনাদ; আত্নীয় স্বজনের আহাজারি ভাইরাল করার প্রাণবন্ত চেষ্টা। শিশুর অনাথ হওয়া নিয়ে ট্রেন্ডিং হ্যাশট্যাগ। মানুষ মরছে, আর আমরা সেটা নিয়ে রিল বানাচ্ছি।
এক শ্রেণীর লোক অপেক্ষায় থাকে কখন এ-ধরনের ঘটনা ঘটবে আর সে ভিডিও করে টাকা কামাবে! হায়রে মানবতা! না, দোষটা সোশ্যাল মিডিয়ার নয়। দোষটা সেই সমাজের, যেখানে সহানুভূতি এখন "রিচ" বাড়ানোর উপায়।
"কারও গল্প আজ আমাদের শিক্ষা নয়, কন্টেন্ট মাত্র।"
খুনিদের চেহারায় ভয় নেই।
অভিনন্দন পোস্টে শত শত লাইক।
কারও জীবনের শেষ চিৎকার আমাদের মনোরঞ্জনের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হয়ে গেছে।
কেউ আর বলে না, “ওর জায়গায় আমি হলে?”
আমরা এখন বলি, “ভিডিওটা শেয়ার করেছো?”
এই কি ছিল আমাদের ভবিষ্যৎ?
একটা প্রশ্ন—তোমার মা-বাবা, ভাই-বোন, সন্তান, যদি হেডলাইন হয়ে যায়?
তখন কি তুমি বলবে, "জীবন তো চলবেই"?
নাকি তখন তুমি বলবে, "মানুষ হই আগে"?
তখন হয়তো তোমার চোখ বুঝবে, খুন শুধু একটা ঘটনা নয়, কারও জগতের ভেঙে যাওয়া।
"আমরা হারিয়েছি — অথচ বুঝতেই পারছি না।"
মানবতা মরছে কিন্তু মৃত্যু সনদ কেউ দিচ্ছে না।
আমরা এখন নিজের ঘরের দরজায় লক দিয়ে অন্যের কষ্টে নির্লিপ্ত।
কিন্তু প্রশ্ন হল, এই লক কি আমাদের বিবেকেও লাগানো হয়ে গেছে?
কখনো কি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেছেন, "আমি কি বদলে গেছি?" হয়তো করেননি। আমরা কেউই করি না। কিন্তু প্রতিদিন নিজেদের অজান্তে একটু একটু করে আমরা বদলে যাচ্ছি। আমাদের চারপাশের পৃথিবীটা বদলে যাচ্ছে, আর সেই বদলের স্রোতে গা ভাসাতে ভাসাতে আমরাও হারিয়ে ফেলছি নিজেদের।
একটু চোখ বন্ধ করে ভাবুন তো সেই সন্ধ্যার কথা, যখন মায়ের বকুনির ভয়ে খেলার মাঠ ছেড়ে বাড়ির দিকে দৌড় দিতেন। যখন রাস্তার মোড়ের চায়ের দোকানে বয়স্কদের গল্পের আসর বসতো আর বাতাসে ভেসে বেড়াতো পরিচিত হাসির শব্দ। সেই সন্ধ্যাগুলো কি হারিয়ে গেছে, নাকি আমরাই হারিয়ে ফেলেছি সেই সন্ধ্যাকে অনুভব করার ক্ষমতা?
আজ সেই একই রাস্তায় যখন রক্তের দাগ দেখি, যখন কোনো মায়ের আর্তনাদ ক্যামেরার ফ্ল্যাশে চাপা পড়ে যায়, তখন কি আমাদের ভেতরটা আগের মতো কেঁপে ওঠে? নাকি আমরা স্মার্টফোনের স্ক্রিনে আঙুল সোয়াইপ করে পরের ‘ভাইরাল’ ভিডিওর দিকে এগিয়ে যাই?
এই লেখাটি কোনো খবর নয়, কোনো পরিসংখ্যানের কচকচানিও নয়। এই লেখাটি আপনার আমার ভেতরের সেই মানুষটিকে একটি প্রশ্ন করার চেষ্টা, যে মানুষটি হয়তো এখনো পুরোপুরি মরে যায়নি। যে প্রশ্নটি হলো—সহানুভূতি আর সংবাদের ভিড়ে আমরা কি আমাদের বিবেককে ‘লাইক’, ‘শেয়ার’ আর ‘কমেন্ট’ এর নিচে কবর দিয়ে দিচ্ছি? চলুন, আজ একবার সেই কবরের মাটি সরিয়ে দেখি, ভেতরে প্রাণের কোনো স্পন্দন অবশিষ্ট আছে কি না।
সকালের চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে খবরের কাগজে চোখ রাখতেই বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে। আরও একটা নৃশংস খুন। আরও একটা পরিবারের কান্না। স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি কিছুক্ষণ। ভাবি, দেশটা কোথায় যাচ্ছে? মানুষ কীভাবে এতটা অমানুষ হতে পারে?
কিন্তু অদ্ভুত এক জাদুর বাস্তবতায় বেঁচে আছি আমরা, বেলা বাড়ার সাথে সাথে সেই তীব্র অনুভূতিটা কেমন ফিকে হতে শুরু করে। অফিসের কাজের চাপ, বন্ধুদের সাথে দুটো হাসির কথা, কিংবা ফেসবুকের মজার ভিডিওর নিচে চাপা পড়ে যায় একটা জলজ্যান্ত মানুষের শেষ আর্তনাদ। সন্ধ্যায় যখন বাড়ি ফিরি, তখন সকালের সেই শিউরে ওঠা খবরটা শুধুই একটা আবছা স্মৃতি। এই যে ভুলে যাওয়া, এই যে সয়ে নেওয়া—এটাই কি আমাদের নতুন স্বাভাবিকতা?
ব্যাপারটা এমন নয় যে আমরা হৃদয়হীন হয়ে গেছি। আসলে, প্রতিদিন এত এত খারাপ না শুধু জঘন্য অপরাধের খবর দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে আমাদের মনটা অসুস্থ হয়ে গেছে, মরে গেছে । মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, এটা নাকি এক ধরনের আত্মরক্ষা। মন যখন ক্রমাগত আঘাত পেতে থাকে, তখন সে নিজের চারপাশে একটা অদৃশ্য দেয়াল তুলে নেয়, অনুভূতিগুলোকে ভোঁতা করে দেয়। নাহলে যে টিকে থাকাই মুশকিল!
একবার ভাবুন তো, কেন এমন হচ্ছে?
খবরের বন্যা: এখন খবর শুধু কাগজে নেই, হাতে হাতে ঘুরছে। টেলিভিশন, ফেসবুক, ইউটিউব খুললেই রক্ত, খুন আর কান্নার ছবি। এত বেশি পরিমাণে খারাপ খবর আমাদের মস্তিষ্ক আর নিতে পারছে না। যা একসময় ছিল ভয়ংকর, তা এখন নিত্যদিনের ঘটনা।
অসহায়ত্বের অনুভূতি: সবচেয়ে বড় কারণ সম্ভবত আমাদের অসহায়ত্ব। আমরা জানি, এসব নিয়ে কথা বলা বা ফেসবুকে দুটো স্ট্যাটাস দেওয়া ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার নেই। বিচার হবে কিনা, অপরাধী শাস্তি পাবে কিনা—তা নিয়ে মনে গভীর সংশয়। এই "কিছু করতে না পারার" কষ্ট থেকেই একসময় জন্মায় নির্লিপ্ততা। মনকে আমরা বুঝিয়ে নিই, "এসব ভেবে কী লাভ?"
"আমার তো কিছু হয়নি": যতক্ষণ না বিপদটা নিজের বা কাছের কারও ওপর আসছে, ততক্ষণ আমরা হয়তো এর ভয়াবহতা পুরোপুরি অনুভব করতে পারি না। অন্যের কষ্টটা খবরের কাগজের একটা কলাম হয়েই থেকে যায়, আমাদের জীবনের অংশ হয় না।
কিন্তু এই নির্লিপ্ততা এক ভয়ংকর অসুখ। এই অসুখটা সমাজের শরীর থেকে একটু একটু করে কেড়ে নিচ্ছে সহমর্মিতা, কেড়ে নিচ্ছে প্রতিবাদের ভাষা। যখন আমরা অন্যের ব্যথায় ব্যথিত হওয়া ছেড়ে দিই, তখন অন্যায় করা লোকগুলো আরও বেশি আস্কারা পেয়ে যায়।
তবে সবকিছুর পরেও, ছাইচাপা আগুনের মতো মনুষ্যত্বটা আমাদের ভেতরে ঠিকই বেঁচে থাকে। হাজারটা খবরের ভিড়েও কোনো একটা ঘটনা হয়তো আমাদের ভেতরের সেই ঘুমন্ত মানুষটাকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। কোনো অসহায় শিশুর মুখ বা কোনো মায়ের কান্না দেখে আমাদের দেয়ালটা হয়তো ক্ষণিকের জন্য ভেঙে পড়ে।
সেই মুহূর্তটুকুই আমাদের ভরসা। আমাদের চেষ্টা করতে হবে এই অনুভূতিটাকে বাঁচিয়ে রাখার। আসুন, এই বিস্মৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করি। অন্তত নিজের কাছের মানুষগুলোর সাথে কথা বলি, আলোচনা করি। একটা নৃশংস ঘটনাকে শুধুই একটা খবর হিসেবে না দেখে, এর পেছনের মানুষটার কষ্টটা বোঝার চেষ্টা করি।
নাহলে একদিন হয়তো দেখব, চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আমরা শুধু একটা খুনের খবরই নয়, নিজেদের বিবেককেও অবলীলায় হজম করে ফেলছি।
যখন মানবিকতা কেবলই ‘কনটেন্ট’
সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো, মানবিকতা এখন কেনাবেচার পণ্য। আমাদের সহানুভূতি, আমাদের আবেগ এখন ‘রিচ’ আর ‘এনগেজমেন্ট’ এর সংখ্যা দিয়ে মাপা হয়। একটা খুনের দৃশ্য যখন ফেসবুক লাইভে সম্প্রচারিত হয়, তখন আমরা ভুলে যাই পর্দার ওপারে একটা মানুষের জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়ি সেই ভিডিও শেয়ার করতে, রিল বানাতে, আর ট্রেন্ডিং হ্যাশট্যাগে গা ভাসাতে।
মায়ের কান্না, বাবার আর্তনাদ, কিংবা কোনো স্বজনের আহাজারি এখন আর আমাদের হৃদয়কে ততটা নাড়া দেয় না, যতটা প্রলুব্ধ করে একটা ‘ভাইরাল’ কনটেন্ট তৈরির জন্য। একটি শিশুর অনাথ হয়ে যাওয়ার করুণ দৃশ্য ব্যবহার করে আমরা হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ড করি। মানুষ মরছে, আর একদল মানুষ সেই মৃত্যুকে পুঁজি করে নিজের ভিউ আর সাবস্ক্রাইবার বাড়াচ্ছে। অর্থ উপার্জনের এই নির্মম নেশায় মনুষ্যত্ব (ইনসানিয়াত) বা মানবতা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে?
অনেকে হয়তো বলবেন, দোষটা সোশ্যাল মিডিয়ার। কিন্তু আসলেই কি তাই? প্রযুক্তি তো কেবল একটি মাধ্যম। আসল দোষটা আমাদের সমাজের গভীরে বাসা বেঁধেছে। সেই সমাজের, যেখানে সহানুভূতির প্রকাশ এখন নিজের প্রোফাইলের ‘রিচ’ বাড়ানোর একটা কৌশল মাত্র। আমাদের সম্মিলিত বিবেক যেন এক গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
শিক্ষা নয়, কেবলই কনটেন্ট: খুনির মুখে ভয়ের বদলে ঔদ্ধত্য
গাজীপুরে সম্প্রতি একজন সাংবাদিককে দিনের আলোয় পিটিয়ে হত্যা করা হলো। সেই ঘটনার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ঘুরছে। কিন্তু সেই ভিডিও দেখে কয়জন মানুষ খুনিদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেছে? আর কয়জন সেই ভিডিওর নিচে ‘হা হা’ রিয়্যাক্ট দিয়েছে বা নিজেদের টাইমলাইনে শেয়ার করে ‘ব্রেকিং নিউজ’ এর অংশীদার হয়েছে? খুনিদের চেহারায় আজ আর কোনো ভয়ডর নেই। তারা জানে, তাদের এই ‘বীরত্ব’র কাহিনী কেউ না কেউ ভিডিও করবে, আর সেই ভিডিও দেখে অনেকেই তাদের বাহবা দেবে। অভিনন্দনের পোস্টে শত শত লাইক পড়বে।
এই সমাজে এখন আর কেউ বলে না, “ওর জায়গায় আমি হলে কী হতো?” বরং সবার আগে প্রশ্ন আসে, “ভিডিওটা দেখেছিস? শেয়ার করেছিস?” কারও জীবনের শেষ মুহূর্তের চিৎকার আজ আমাদের বিনোদনের আবহসংগীত। এই বিকৃত মানসিকতার ভবিষ্যৎ কী? আমরা কি এমনই এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছিলাম?
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের আইন-শৃঙ্খলার যে ভয়াবহ অবনতি ঘটেছে, তা আমাদের চোখ খুলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। প্রায় প্রতিদিনই খবরের কাগজে থাকছে খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই আর প্রকাশ্য খুনের ঘটনা। তুচ্ছ কারণে মানুষ মানুষকে হত্যা করতে দ্বিধা করছে না। পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনগুলো এতটাই ঠুনকো হয়ে গেছে যে, সামান্য স্বার্থের সংঘাতেও রক্ত ঝরছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অবক্ষয়ের পেছনে বহুবিধ কারণ জড়িত। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সামাজিক পুঁজির অবক্ষয়—সবকিছুই এর জন্য দায়ী। যখন রাষ্ট্র নাগরিকের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়, তখন সমাজে এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতার বোধ তৈরি হয়। এই বোধ থেকেই জন্ম নেয় অবিশ্বাস, ঘৃণা এবং সহিংসতা।
যে প্রশ্নটি নিজেকে করার সময় এসেছে
এক মুহূর্তের জন্য ভাবুন তো, আপনার সবচেয়ে কাছের মানুষটি—আপনার মা, বাবা, ভাই, বোন বা সন্তান—যদি কোনোদিন পত্রিকার শিরোনাম হয়ে যায়? যদি তাদের নিথর দেহের ছবি সামাজিক মাধ্যমে ঘুরতে থাকে? তখনো কি আপনি বলতে পারবেন, “যা হওয়ার হয়ে গেছে, জীবন তো আর থেমে থাকবে না”?
নাকি সেই মুহূর্তে আপনার মনে হবে, সবার আগে ‘মানুষ’ হওয়াটা জরুরি ছিল? সেদিন হয়তো আপনি উপলব্ধি করবেন, একটা খুন কেবল একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটা একটা পরিবারের স্বপ্ন ভেঙে যাওয়া, একটা জগতের সমাপ্তি।
আমরা প্রতিনিয়ত কিছু একটা হারাচ্ছি, কিন্তু সেই হারানোর যন্ত্রণাটুকুও অনুভব করতে পারছি না। আমাদের অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে গেছে। মানবতা নীরবে মারা যাচ্ছে, কিন্তু তার কোনো মৃত্যুসনদ তৈরি হচ্ছে না। আমরা নিজেদের ঘরের দরজায় তালা ঝুলিয়ে অন্যের কষ্টে নির্লিপ্ত থাকতে শিখে গেছি।
কিন্তু শেষ প্রশ্ন হলো, এই তালা কি শুধু আমাদের ঘরের দরজায় পড়েছে, নাকি আমাদের বিবেকের দরজাতেও? যদি বিবেকের দরজায় তালা পড়ে যায়, তবে সেই তালা খোলার চাবি কি আমাদের কাছে আছে? নাকি আমরা সেই চাবিটাও হারিয়ে ফেলেছি? সময় থাকতে এই প্রশ্নের উত্তর না খুঁজলে, একদিন হয়তো আমাদের নিজেদেরই অস্তিত্ব এই ভাইরাল কনটেন্টের ভিড়ে হারিয়ে যাবে। তখন আর আফসোস করারও সুযোগ থাকবে না।
🕯️ শেষ কথা: একটুখানি মানুষ হই, কিছু করতে না পারলে অন্তত প্রতিবাদ করি!
আমরা হয়তো পুরো সমাজ একা বদলে ফেলতে পারি না,
কিন্তু আমরা নিজের ভেতরের মানুষটাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারি।
আগামীবার যখন অন্যায় দেখবো—
স্ক্রিনে তুলবার আগে একবার ভাবো,
"এই মুহূর্তে যদি আমি থাকতাম ওর জায়গায়?"
সবাই ক্যামেরা ধরে,
কিন্তু কেউ হাত বাড়িয়ে দেয় না—
তুমি সেই একজন হও, যে মানুষ হিসেবে এগিয়ে যায়।
ভিউসের এই দুনিয়ায় যদি কেউ নিঃশব্দে সহানুভূতির বাতি জ্বালায়,
সেটাই আজকের সবচেয়ে বড় বিপ্লব।
নিজের চোখ, কান আর বিবেককে সজাগ রাখো।
অন্যায়কে কন্টেন্ট বানিয়ে না ছড়িয়ে,
প্রতিবাদের আগুনে বদলে দাও সমাজকে।
অন্ততপক্ষে, যদি কিছু না-ই পারো—
একবার "মানুষ" হয়ে দেখো।
দেখবে, এখনও সবকিছু শেষ হয়নি।
🤍 আপনার মন ছুঁয়ে গেলে—একটা শেয়ার দিন, একটা মতামত লিখুন
এই লেখাটি কেবল শব্দ নয়,
এটা আমাদের সমাজের আয়না,
আর আপনার অনুভব—এই আয়নাটিকে আরও স্বচ্ছ করতে পারে।
আপনি যদি মনে করেন,
"হ্যাঁ, অন্যায়কে কেবলমাত্র কন্টেন্ট হিসেবে বানানো বন্ধ করা উচিত"
তাহলে দয়া করে এই লেখা শেয়ার করুন।
হয়তো আপনার শেয়ারেই কারও চোখ খুলে যাবে।
আর কমেন্টে আপনার মতামত জানালে,
এই আলোচনাটা শুধু একতরফা থাকবে না—
মানুষে মানুষে সংযোগ তৈরি হবে।
একটা শেয়ার, একটা মন্তব্য—
“সমাজের মননযাত্রার বদলের প্রথম কদম আপনার হাত ধরে শুরু হবে; আপনার স্পর্শই হবে সেই আলো, যা অন্ধকার ভেদ করে নতুন আশা জাগাবে।”

🌸 আপনার মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ!
আপনার মতামত আমাদের অনুপ্রাণিত করে এবং আগামীতে আরও মানসম্পন্ন কনটেন্ট তৈরিতে সহায়তা করে।
আপনি যদি কোনো নির্দিষ্ট বিষয় বা গল্প পছন্দ করে থাকেন, জানালে ভালো লাগবে।
নিয়মিত পাশে থাকুন — আপনার সহযোগিতা ও ভালোবাসাই আমাদের এগিয়ে চলার শক্তি।
শুভ কামনায়,
✍️ কল্পকথা-৩৬০ ব্লগ টিম
https://kalpakatha360.blogspot.com