একটা দেশকে মূল্যায়ন করার অনেক উপায় আছে জিডিপি, মাথাপিছু আয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা উঁচু ভবনের সারি। কিন্তু আঙুলের ডগায় ধরা পরিসংখ্যানের বাইরে আরও কিছু সূক্ষ্ম স্পন্দন আছেরাত তিনটার নিস্তব্ধতায় গ্রামবাংলার একটি উঠোনে বেজে ওঠা ফোন, অথবা বিমানবন্দরের গেট পার হওয়ার সময় যে কাঁধটা হঠাৎ ভারী হয়ে যায়। আমরা কি এই স্পন্দনগুলোকে দেশের পরিমাপে ধরি? যে ছেলেটি বা মেয়েটি আজ প্রবাসে রওনা দিল, তার অনুপস্থিতির ভিতরে যে উপস্থিতির কাজ করেশিশুর টিফিনের পয়সা, মায়ের ওষুধ, মেরামত হওয়া টিনের চাল, কিংবা গ্রামের বাজারে নতুন করে ওঠা ছোট্ট দোকানএসব কি আমাদের মূল্যায়নের অংশ?
ভোলার কোনো গ্রামে, টিনের চালের নিচে বৃষ্টির শব্দ ফাঁক ফাঁক ঘুমে ঢোকে। একটি পুরনো ফিচারফোনের আলো জ্বলে ওঠেওপাশে জর্দানের আম্মানে থাকা শিরিন। মা, আমি ভালো আছি, তুমি ওষুধটা নিয়মিত খাও। এই কয়েকটি কথাই একটি পরিবারের আজকের দিনটাকে স্থির রাখে। ঢাকার মিরপুরের এক গলিতে একই সময়ে রাকিব নামের এক তরুণ চোখ নিচু করে ইমিগ্রেশনের কাগজে সই দিচ্ছেতার সইয়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে তার নিজের জীবনের বর্ণমালা, একই সঙ্গে বদলে যাচ্ছে বাড়ির ভাড়াটে পরিচয়ের মানে, পাড়ার মুদি দোকানের বাকির খাতায় বিশ্বাসের দাগ। সংখ্যার টেবিলে এসব লেখা থাকে না; তবু এদের ছাড়া সংখ্যার মানে অস্পূর্ণ।
প্রবাস মানে কেবল বিদেশে থাকা নয়, প্রবাস মানে এক অদৃশ্য করঈদের দিন খালি চেয়ার, স্কুলের রিপোর্টকার্ডে বাবার সই না থাকা, মায়ের জ্বরে কপালে হাত না রাখতে পারার দীর্ঘশ্বাস। এই ‘অনুপস্থিতির কর’ পরিশোধ করেই যে টাকা দেশে পৌঁছায়, সেটি আবার হাজারটা শিরায় ছড়িয়ে পড়েটিউবওয়েল বসে, মসজিদের টিন পাল্টায়, শিশুরা ইউনিফর্ম পরে স্কুলে যায়, শহরে ভাড়া বাড়ি থেকে ছোট্ট ফ্ল্যাটে ওঠা হয়। প্রশ্ন থেকে যায়আমরা কি এই মানবিক খরচটাকে স্বীকার করি? নাকি ডলার গোনার তাড়াহুড়োয় মানুষটাকেই গুনে ফেলি?
আরেকটু গভীরে গেলে দেখা যায়, প্রবাসের পথে যাত্রার আগমুহূর্তেই ফাঁদ পেতে থাকে নানা ‘সহযোগী’। ভিসা রেডি, বেতন বেশি, কাজ হালকামিষ্টি কথায় কাগজ দেখার আগেই টাকা নিতে চায় কেউ কেউ। এই প্রতারকদের জন্য একটা ভুল সই, একটা অজ্ঞান সম্মতিজীবনকে বছরের পর বছর পিছিয়ে দিতে পারে। অথচ সুরক্ষার পথটাই কঠিন নয়: লাইসেন্সধারী এজেন্সি, লিখিত চুক্তি, স্বীকৃত মেডিকেল, ওরিয়েন্টেশন, আর নিজের পাসপোর্ট নিজের কাছে রাখাএই কয়েকটি নিয়মই হতে পারে ভবিষ্যতের ঢাল। আমরা কি এই নিয়মগুলোকে পারিবারিক আলোচনার কেন্দ্রে আনি? বিদেশে যাওয়ার টিকিট কাটার মাতামাতির পাশে কি একবার হলেও ‘চুক্তিটা পড়ে দেখেছ?’ প্রশ্নটি করি?
আরেক দিক আছেপ্রবাস ফেরত মানুষের হাতে থাকে দক্ষতার নতুন শব্দভাণ্ডার: শৃঙ্খলা, সময় ব্যবস্থাপনা, মান নিয়ন্ত্রণ। যদি এই অভ্যাসগুলোকে আমরা দেশে ফিরে কাজে লাগাতে পারিছোট্ট ওয়ার্কশপ, সোলার ইনস্টলেশন, ওয়েল্ডিং-ফ্যাব্রিকেশন, সার্ভিস সেন্টারতাহলে রেমিট্যান্স কেবল খরচ নয়, হয়ে উঠতে পারে বিনিয়োগের বীজ। রাষ্ট্র কি পারে না ‘রিটার্নি থেকে উদ্যোক্তা’এমন একটা সেতু গড়তে, যেখানে সাশ্রয়ী ঋণ, বাজারসংযোগ আর টেকনিক্যাল সার্টিফিকেশন একসঙ্গে মেলে? পরিবার, কমিউনিটি, স্থানীয় সরকারসবাই মিলে কি পারে না প্রবাসীকে বাইরের মানুষ নয়, নিজের মানুষ হিসেবে পুনর্বার প্রতিষ্ঠা করতে?
এই লেখার শুরু তাই প্রশস্তি বা বিলাপের সহজ রাস্তা ধরে হাঁটবে না। আমরা প্রশ্ন করবদেশকে মূল্যায়ন করতে গেলে কোন চোখটা ব্যবহার করা জরুরি? কেবল উঁচু ভবনের কাচে পড়া সূর্যের ঝিকিমিকি, নাকি রাত তিনটার ফোনের ওপাশে কেঁপে ওঠা কণ্ঠের নরমতা? কেবল রিজার্ভের সংখ্যা, নাকি মায়ের ওষুধের কৌটায় পড়ে থাকা চুলের রেখা? কেবল বৈদেশিক আয়ের গ্রাফ, নাকি লুকিয়ে থাকা মানবিক খরচের হিশাব?
আপনি প্রস্তুত তোসংখ্যার ঠাণ্ডা শরীরের ওপর মানুষের উষ্ণ গল্পের ওড়না চাপাতে? যদি প্রস্তুত হন, তাহলে চলুনএকটি খালি চেয়ার, একটি ফোনের আলো, এবং একটি পরিবারের নিশ্বাস থেকে আমরা নতুন করে শিখে নিইদেশকে মূল্যায়ন মানে শেষ পর্যন্ত মানুষকে বোঝা। আর মানুষকে বোঝা মানে, তার অনুপস্থিতির ভিতরে লুকিয়ে থাকা উপস্থিতির মর্যাদা দেওয়া। এখান থেকেই শুরু হোক আমাদের দেখার নতুন ভঙ্গি।
আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শাহজালাল বিমানবন্দরের রাতের ব্যস্ততা এক অচেনা কোলাহলে ভরে থাকে। হাজারো মানুষের পদচারণা, বিদায়ের হাহাকার আর আগমনের আনন্দ মিলেমিশে একাকার। কিন্তু সেই কোলাহল থেকে একটু দূরে, টার্মিনালের এক কোণে, দাঁড়িয়ে আছে সদ্য যুবক করিম। তার চোখে নেই কোনো আনন্দ, নেই কোনো উচ্ছ্বাস। বরং এক ধরনের চাপা ভয় আর অনাগত ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা। বুকভরা স্বপ্ন আর মা-বাবার চোখে নতুন বাড়ির ছবি নিয়ে সে পাড়ি জমাচ্ছে অচেনা এক দেশে। বিমানবন্দরের প্রতিটি ইট, প্রতিটি কোণ যেন তাকে নীরবে প্রশ্ন করছেকোথায় যাচ্ছো? এই যে দেশের বুকে একটি ইট গেঁথে দেওয়ার স্বপ্ন নিয়ে যাচ্ছো, তার বিনিময়ে তুমি কী পাচ্ছো?
করিম কেবল একটি নাম নয়, সে লক্ষ লক্ষ প্রবাসীর প্রতিচ্ছবি, যাদের জীবনকে আমরা কেবল একটি সংখ্যায় পরিণত করে ফেলেছি। যাদেরকে আমরা স্রেফ 'রেমিট্যান্স যোদ্ধা' বলে সম্মান করি, কিন্তু যাদের বুকের গভীরে এক সাগর কষ্ট, এক বিশাল শূন্যতা। তাদের গল্পগুলো আমাদের পত্রিকার হেডলাইন বা টেলিভিশনের ব্রেকিং নিউজ হয় না। তাদের জীবন কেবলই এক নিরন্তর সংগ্রামের নাম। এই প্রতিবেদনটি সেই সব মানুষের জন্য, যারা দিনের পর দিন নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বিসর্জন দিয়ে মরুভূমির বালুতে বা ভিনদেশের কঠিন পরিবেশে জীবন কাটায়। এই প্রতিবেদন শুধু অর্থনীতির চাকা ঘোরানো ডলারের হিসাব নয়, বরং সেই মানুষগুলোর গল্প, যারা এক নতুন বাংলাদেশের ভিত্তি গড়ে তুলছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের গুরুত্ব নতুন করে বলার কিছু নেই। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যখন তলানিতে, ঠিক তখন প্রবাসীদের পাঠানো অর্থই যেন সঞ্জীবনী সুধার মতো কাজ করেছে। সদ্য শেষ হওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন মাইলফলক রচিত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এই অর্থবছরে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ প্রায় ২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ১০.৬৬ শতাংশ বেশি । এই ঊর্ধ্বমুখী ধারা অব্যাহত ছিল ২০২৪-২৫ অর্থবছরেও, যখন দেশে প্রথমবারের মতো ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছে, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২৭ শতাংশ বেশি ।
এই বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স প্রবাহের পেছনে রয়েছে বেশ কিছু কারণ। অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর প্রধান কারণগুলোর একটি হলো হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাঠানোর প্রবণতা কমে যাওয়া। যখন বৈধ ও অবৈধ উভয় মাধ্যমে ডলারের বিনিময় হারের ব্যবধান কম থাকে, তখন প্রবাসীরা স্বাভাবিকভাবেই ব্যাংকিং চ্যানেল বা অন্যান্য বৈধ মাধ্যম ব্যবহার করেন, কারণ এতে তাদের অর্থ সুরক্ষিত থাকে । এটি প্রমাণ করে, প্রবাসীরা দেশের অর্থনৈতিক সংকটের সময় পাশে দাঁড়িয়েছেন এবং সঠিক নীতি ও ব্যবস্থাপনা পেলে তারা আনুষ্ঠানিক পথেই অর্থ পাঠাতে আগ্রহী।
রেমিট্যান্সের এই চমকপ্রদ সংখ্যার আড়ালে এক বিস্ময়কর গরমিল রয়ে গেছে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) বলছে, বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশির সংখ্যা ১ কোটি ৪৮ লাখের বেশি । অন্যদিকে, জনশুমারি ও গৃহগণনার চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রবাসে থাকা বাংলাদেশির সংখ্যা মাত্র ৫০ লাখ ৫৩ হাজার ৩৫৮ জন । বাংলাদেশ ব্যাংকও বলছে, বিদেশে কর্মরত আছেন সোয়া কোটি বাংলাদেশি ।
এই বিশাল পার্থক্য কেবল একটি সাধারণ পরিসংখ্যানের ভুল নয়; এটি রাষ্ট্র এবং তার প্রবাসী নাগরিকদের সম্পর্কের একটি গভীর ফাটলের ইঙ্গিত। জনশুমারির সময় যারা ছয় মাসের বেশি সময় ধরে বিদেশে অবস্থান করছিলেন, কেবল তাদেরকেই প্রবাসী হিসেবে গণ্য করা হয়েছে । অন্যদিকে বিএমইটি তাদের তথ্য সংগ্রহ করে কেবল বৈধ চ্যানেলে বিদেশে যাওয়া কর্মীদের। এই বিশাল গরমিল থেকে বোঝা যায়, প্রায় ৯০ লাখেরও বেশি বাংলাদেশি নাগরিক রাষ্ট্রযন্ত্রের কোনো আনুষ্ঠানিক হিসাবের মধ্যে নেই। তারা কারা, কোথায় থাকেন, কী করেন, তারা কোনো সংকটে পড়লে কীভাবে তাদের পাশে দাঁড়ানো হবেএমন কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্যই রাষ্ট্রের কাছে নেই। এর ফলে, প্রবাসীদের কল্যাণে কার্যকর ও সুদূরপ্রসারী নীতি গ্রহণ করা সরকারের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। এটি আসলে একটি ব্যর্থতার চিত্র, যেখানে রাষ্ট্রের একটি বিশাল অংশ তার নাগরিকদের সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রয়ে গেছে।
লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলার কেরোয়া ইউনিয়নের মোল্লার হাট গ্রামটি এখন যেন এক রূপকথার গল্পের চরিত্র। এক সময় যে গ্রামটির আনাচে-কানাচে ছিল টিনের চালা ও বেড়ার ঘর, এখন সেখানে চোখে পড়ে প্রবাসীদের পাঠানো টাকায় তৈরি হওয়া দৃষ্টিনন্দন সব পাকা ভবন। প্রতিটি ইট যেন এক প্রবাসীর হাড়ভাঙা পরিশ্রমের সাক্ষ্য বহন করছে । এ গ্রামেরই বাসিন্দা হাফিজউদ্দিন ভূঁইয়া, যিনি ১৯৯৮ সালে কুয়েতে পাড়ি জমিয়েছিলেন। তার ভিসা খরচ তার ভাই বহন করেছিলেন এবং তাকে শুধু বিমান ভাড়া দিতে হয়েছিল। এরপর একে একে তার সাত ভাই বিদেশে যান এবং প্রত্যেকেই গ্রামে পাকা বাড়ি গড়েছেন। একসময় যে গ্রামের মানুষ প্রিয়জনের চিঠির জন্য ডাকঘরের সামনে প্রহর গুনতো, এখন তাদের যোগাযোগ চলে মোবাইলের ডিজিটাল মাধ্যমেই । প্রবাসের টাকা কেবল তাদের ঘরবাড়িই পাল্টে দেয়নি, বদলে দিয়েছে তাদের পুরো জীবনযাত্রা।
গ্রামের আরেক প্রান্তিক অঞ্চলের অগস্টিন মরমু, যার পরিবারে বিদেশ যাওয়ার কথা ছিল এক অবাস্তব স্বপ্ন। গরিব পরিবারের ছেলে অগস্টিন তার স্বপ্নের পাখা মেলেছিলেন মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে। তার বিদেশ যাওয়ার টাকা জোগাড় করতে পরিবারকে একমাত্র অবলম্বনএকটি গরু বিক্রি করতে হয়েছিল । পাড়া-প্রতিবেশী ও গ্রামের সবাইকে অবাক করে দিয়ে একদিন অগস্টিন বিমানে উঠে বসেছিল। তার এই গল্প প্রমাণ করে, প্রবাসী যাত্রা কেবল দেশের একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের ঘটনা নয়; এটি দেশের প্রতিটি প্রান্তকে ছুঁয়ে যাওয়া এক গণ-আন্দোলন।
সফলতা এক রাতের গল্প নয়, এর পেছনে থাকে ব্যর্থতা, ত্যাগ আর সংগ্রামের এক দীর্ঘ ইতিহাস। খোরশেদ আলম বাবুর গল্প তেমনই এক জীবন্ত উদাহরণ । ১৯৮৬ সালে মাত্র ২০ ডলার পকেটে নিয়ে তিনি জাহাজ থেকে পালিয়ে নিউইয়র্কের বন্দরে নামেন । জীবনের প্রথম সত্যিকারের সংগ্রাম শুরু হয় সেখানেই। নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন, কঠোর পরিশ্রম করে কাজের খুঁটিনাটি শিখে নেন । তার সততা আর পরিশ্রমের প্রতি মুগ্ধ হয়ে তার এক আমেরিকান বন্ধু তার স্ত্রীর সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেন, যিনি পরে তার জীবনসঙ্গিনী হন। এরপর ১৯৮৮ সালে তারা দুজনে মিলে প্রতিষ্ঠা করেন ডেফোডিল কনস্ট্রাকশন ফার্ম । প্রথম দিকে পুঁজি ও কাজ পেতে অনেক প্রতিকূলতা ছিল, কিন্তু বাবুর দৃঢ় মনোবল তাকে পিছু হটতে দেয়নি। তার গল্প প্রমাণ করে, প্রবাসে শুধু স্বপ্ন দেখলেই হয় না, সেই স্বপ্নকে ছুঁতে হলে কঠোর পরিশ্রম আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে লেগে থাকতে হয়।
তবে প্রবাসজীবন শুধু গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষেরই নয়, শহরের শিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের স্বপ্নও এখন বিদেশে পাড়ি জমানো। কিন্তু তাদের সংগ্রাম ভিন্ন ধরনের। তাদের জীবনে মরুভূমির বালু বা ৫০ ডিগ্রি তাপমাত্রার কষ্ট না থাকলেও আছে এক গভীর একাকীত্ব । একটি ব্লগ পোস্টে এক শিক্ষিত প্রবাসী তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, দেশের এক লক্ষ সাতচল্লিশ হাজার বর্গকিলোমিটারের গণ্ডির মধ্যে তিনি যেখানেই থাকুন না কেন, চারপাশে পরিচিত মানুষ খুঁজে পেতেন। কিন্তু বিদেশে এই বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানে চাইলেই দেশে ফিরে আসা সম্ভব হয় না, কারণ বিমানের টিকিটের টাকা জোগাড় করতেই রক্ত পানি হয়ে যায় ।
শহরের প্রবাসীদের জন্য দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ কাজগুলোও কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। যেমন, অপরিচিত পরিবেশে ভাষা ও সংস্কৃতিগত বাধা। এক প্রবাসী গল্প শোনালেন, কীভাবে তিনি দোকানে গিয়ে কর্মচারীর কাছে মসলা বোঝানোর চেষ্টা করতে গিয়ে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি করেছিলেন, অথবা গাড়ি ছাড়া বাজারে গিয়ে পরিচিত খাবার খুঁজে না পাওয়াএগুলো ছোট ছোট ঘটনা হলেও মানসিক চাপ সৃষ্টি করে । এই গল্পগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রবাসীদের জীবন একটি একরৈখিক সংগ্রাম নয়। প্রতিটি মানুষ তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা, প্রেক্ষাপট এবং সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যায়।
প্রবাসীদের জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃখ হলো প্রিয়জনদের থেকে দূরে থাকা । বছর বছর কেটে যায়, কিন্তু পরিবারের সঙ্গে দেখা হয় না। সন্তানের প্রথম হাঁটা, বাবার শেষ কালের সঙ্গএসব থেকে তারা বিচ্ছিন্ন থাকেন। প্রবাসীরা তাদের কষ্টগুলো সাধারণত প্রকাশ করেন না, বরং বুকে চেপে রাখেন। কিন্তু কখনো কখনো সেই কষ্ট আগ্নেয়গিরির মতো ফেটে পড়ে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওর গল্প সেই কষ্টের এক জ্বলন্ত উদাহরণ ।
ভিডিওটিতে দেখা যায়, মধ্যপ্রাচ্যের এক প্রবাসী শ্রমিক সারাদিনের হাড়ভাঙা পরিশ্রম শেষে রাতে গভীর ঘুমে। হঠাৎ তার ঘুম ভাঙে স্ত্রীর ফোনে। তিনি ক্লান্ত কণ্ঠে বলেন, 'হ্যালো, কি হইছে?' কিন্তু ফোনের ওপার থেকে একটাই কথা'ট্যাহা তোমারে দুই মাস আগেই পাঠাইছি না? খালি ট্যাহা ট্যাহা করো?' দিনের পর দিন একই কথা শুনতে শুনতে একসময় তার ভেতরের চাপা কষ্ট ফেটে পড়ে। তিনি চিৎকার করে বলেন, 'ট্যাহা কি বলদের পুন্দা দিয়া আহে? তোমার লাইগা মান সম্মান সব শেষ অইয়া গেলো গা।' এই বলে তিনি তার স্মার্টফোনটি মেঝেতে আছাড় মেরে হামানদিস্তা দিয়ে থেঁতলে ফেলেন । এই ঘটনাটি কেবল একজন ব্যক্তির মানসিক ভাঙন নয়, বরং লক্ষ লক্ষ প্রবাসীর 'দেয়ালবিহীন কারাগার'-এর ভেতরের এক নির্মম সত্য ।
যে প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি, তাদের প্রাপ্য সম্মান ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার দায়িত্ব কার? দুঃখজনক হলেও সত্যি, দেশ ও দেশের বাইরে প্রবাসীরা প্রায়ই অসম্মান ও হয়রানির শিকার হন। বিমানবন্দরে তাদের অযথা হয়রানি করা হয়, অপমান করা হয় । তাদের কাগজপত্র বৈধ থাকলেও কৃত্রিম জটিলতা তৈরি করে সময় নষ্ট করা হয়, যার ফলে অনেকে ফ্লাইট পর্যন্ত মিস করেন । একজন শ্রমিকের গল্প শোনা যাক। গ্রামের ছেলেটি দিনমজুরের কাজ করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে জমানো টাকায় টিকেট কিনেছিল। বিমানবন্দরে নেমেছিল হাজারো স্বপ্ন নিয়ে, কিন্তু ইমিগ্রেশনের এক কর্মকর্তা তাকে আটকে দিলেন, অহেতুক প্রশ্ন করতে লাগলেন। "কী টাকা পাঠাইছোস? কোন টাকা? টাকা তো তোর বাপের না!" - এই ধরনের কথার আঘাতে ছেলেটি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ল। তার মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার উপায় ছিল না যে সে কতটা অপমানিত বোধ করছে। এই সামান্য একটা ঘটনা হাজারো প্রবাসীকে দিনের পর দিন সইতে হয় ।
অন্যদিকে, বিদেশে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে টাকা পাঠিয়েও তাদের জমি-জমা, বাড়ি-ঘর দখল করে নেওয়া হয় । এই অপকর্মের পেছনে থাকে দেশের অসাধু রাজনীতি আর তার সহযোগী মাস্তানরা। এমনকি ব্যাংকে রাখা তাদের সঞ্চয়ের টাকাও আজকাল আত্মসাৎ হয়ে যাচ্ছে । এসব দেখে মনে হয়, প্রবাসীদের জন্য যে আলাদা মন্ত্রণালয় আছে, তা যেন কেবল নামেই।
প্রবাসী মানেই শুধু অদক্ষ শ্রমিক নয়। বিশ্বের প্রতিটি কোণে এখন বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষিত ও দক্ষ পেশাজীবীরা নীরবে এক বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছেন। তারা কেবল নিজেদের ভাগ্যই পরিবর্তন করছেন না, বরং দেশের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে আবু বকর হানিফের গল্পটি তেমনই এক অনুপ্রেরণার উৎস। বাংলাদেশের চুয়েট থেকে পড়াশোনা শেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে তিনি দেখলেন, দেশের মেধাবী তরুণরা সেখানে ট্যাক্সি চালানো বা গ্যারেজে গাড়ি সারানোর মতো 'অড জব' করছেন । তার এক সহপাঠী নিউইয়র্ক থেকে ফোন করে হতাশার কথা জানালেন, ট্যাক্সি চালিয়েও জীবন চলছে না। সেই হতাশা থেকে আবু বকর তার করপোরেট চাকরি ছেড়ে পিপলএনটেক নামের একটি আইটি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন । তার লক্ষ্য ছিল প্রবাসের তরুণদের অড জব থেকে বের করে এনে মূলধারার আইটি পেশাজীবী হিসেবে গড়ে তোলা। তার এই উদ্যোগ প্রমাণ করে, প্রবাসীরা কেবল অর্থ দিয়েই দেশকে সহায়তা করেন না, বরং জ্ঞান ও দক্ষতা দিয়েও দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারেন । এছাড়া, নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগে চার বাংলাদেশি কর্মকর্তার পদোন্নতিও দেশের জন্য সম্মান বয়ে এনেছে ।
অন্যদিকে, যুক্তরাজ্যে ডা. জুহুরা রহমান ও ডা. সম্পা দেওয়ানের মতো চিকিৎসকরাও তাদের পেশায় দারুণ সাফল্য লাভ করেছেন । ডা. সম্পা দেওয়ানের রয়্যাল মাউন্ট অ্যাস্থেটিক ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা প্রমাণ করে, দেশের বাইরেও বাংলাদেশি পেশাজীবীরা কেবল নিজেদের জন্য নয়, বরং গোটা প্রবাসী কমিউনিটির স্বাস্থ্যসেবা এবং মানসিক স্বস্তি নিশ্চিত করতে কাজ করছেন ।
এখনকার প্রবাসীরা আর শুধু চিঠি বা ফোনের ওপর নির্ভর করেন না। তারা তাদের জীবনের গল্প, দৈনন্দিন রুটিন এবং আনন্দ-বেদনা নিজেরাই প্রকাশ করছেন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। ইউটিউব ও টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো প্রবাসীদেরকে এক নতুন কণ্ঠস্বর দিয়েছে। ভাইরাল হওয়া টিকটকার মানিক মিয়া বা ফয়সাল আহমেদ রনির মতো প্রবাসীরা তাদের কষ্টের জীবনকে ভিডিওতে তুলে ধরছেন এবং লক্ষ লক্ষ ভিউ পাচ্ছেন । এই ভিডিওগুলোর জনপ্রিয়তা থেকে বোঝা যায়, সাধারণ মানুষের কাছে এই বাস্তব গল্পগুলোর চাহিদা অনেক বেশি। এটি কেবল বিনোদন নয়, বরং প্রবাসীদের নিজেদের মধ্যে এক ধরনের সংহতি ও সংযোগ তৈরি করছে।
প্রবাসে বেড়ে ওঠা দ্বিতীয় প্রজন্মের জীবন এক নীরব সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তারা না পারছে বাবা-মায়ের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পূর্ণভাবে মেনে নিতে, না পারছে বিদেশের মূলধারার সংস্কৃতিতে পুরোপুরি মিশে যেতে। এই সাংস্কৃতিক সংঘাত থেকে সৃষ্ট মানসিক চাপ কখনো কখনো চরম রূপ ধারণ করে। যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে একটি বাংলাদেশি পরিবারের ছয় সদস্যের মর্মান্তিক মৃত্যু এই সংঘাতের এক চরম উদাহরণ । পুলিশের তদন্তে জানা যায়, পরিবারের দুই ছেলে বিষণ্নতায় ভুগছিল এবং তাদের সুইসাইড নোটে লেখা ছিল, তারা পরিবারকে 'লজ্জা ও কষ্ট থেকে মুক্তি' দিতে এই পথ বেছে নিয়েছে । এই ঘটনাটি প্রমাণ করে, প্রবাস জীবনের সাংস্কৃতিক ব্যবধান এবং মানসিক চাপ কত গভীর হতে পারে।
এই সংঘাতের বিপরীতে, আরেকটি গল্প আছেফ্রান্সে বেড়ে ওঠা দ্বিতীয় প্রজন্মের। তাদের বাবা-মায়েরা বহু বছর আগে জীবিকার সন্ধানে ফ্রান্সে গিয়েছিলেন। সেখানে জন্ম নেওয়া এবং বেড়ে ওঠা এই তরুণ-তরুণীরা নিজেদের ঐতিহ্যকে সম্পূর্ণ ভুলে যায়নি। তারা ফরাসি ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গেলেও, নিজেদের পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে বাংলা সংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে। যখন কোনো প্রবাসীর ছেলের বিয়ে হয়, তখন তা কেবল একটি পারিবারিক অনুষ্ঠান থাকে না, বরং গোটা প্রবাসী কমিউনিটির উৎসবে পরিণত হয় । সেখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ একত্রিত হয়ে দেশীয় ভাবধারায় বিয়ের আয়োজন করে । প্রবীণরা বর-কনেকে দোয়া করেন, আর ছোটরা শিখতে থাকে তাদের শেকড়ের গল্প। এই গল্পগুলো প্রমাণ করে, কঠিন পরিবেশেও প্রবাসীরা নিজেদের সংস্কৃতিকে নতুন প্রজন্মের মধ্যে বাঁচিয়ে রেখেছেন।
একজন প্রবাসী হিসেবে আপনার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও সরকারি সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে জানা জরুরি:
সর্বজনীন পেনশন স্কিম: সরকার প্রবাসীদের জন্য 'প্রবাস' নামক একটি পেনশন স্কিম চালু করেছে। ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী যেকোনো বাংলাদেশি নাগরিক এই স্কিমে অংশ নিতে পারবেন । এমনকি পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তিরাও ১০ বছর নিরবচ্ছিন্ন চাঁদা দিয়ে পেনশন সুবিধা পেতে পারেন । এই স্কিমের আওতায় মাসিক জমার অর্থ বৈদেশিক মুদ্রায় দেওয়া যাবে, এবং পেনশনের টাকা দেশীয় মুদ্রায় প্রদান করা হবে ।
প্রণোদনা সুবিধা: বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠালে সরকার ২.৫ শতাংশ প্রণোদনা/নগদ সহায়তা প্রদান করে । প্রবাসী স্কিমে এই প্রণোদনার অর্থ আপনার হিসাবে জমা হবে ।
ডিজিটাল সেবা: অভিবাসন প্রক্রিয়া সহজ করতে সরকার ‘আমি প্রবাসী’ অ্যাপ চালু করেছে । এই অ্যাপের মাধ্যমে প্রবাসী কর্মীরা প্রি-ডিপার্চার ওরিয়েন্টেশন (পিডিও) সেশনের বুকিং দিতে পারেন এবং কিউআর কোডসহ সার্টিফিকেট ডাউনলোড করতে পারেন । এর পাশাপাশি, বিএমইটি (জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো) ভিসা যাচাই এবং অনলাইন ছাড়পত্রের মতো ডিজিটাল সেবাও প্রদান করে থাকে ।
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক ও অন্যান্য সহায়তা: বিদেশ ফেরত কর্মীদের জন্য প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে রিইন্ট্রিগ্রেশন ঋণ সুবিধা দেওয়া হয়। এছাড়া, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড প্রবাসী কর্মীর সন্তানদের শিক্ষাবৃত্তি প্রদানসহ বিভিন্ন কল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে ।
বাংলাদেশের প্রবাসীরা একটি একক সত্তা নয়। তারা অসংখ্য গল্প, অসংখ্য সংগ্রামের সমষ্টি। তারা গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ, যারা নতুন পাকা বাড়ি বানাতে চান। তারা শহরের শিক্ষিত যুবক, যারা জীবনের অর্থ খুঁজতে বিদেশে পাড়ি জমান। তারা দক্ষ পেশাজীবী, যারা ভিনদেশে বসে দেশের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করেন। এবং তারা একটি নতুন প্রজন্ম, যারা নিজেদের পরিচয় ও সংস্কৃতির সংঘাতের মধ্য দিয়ে পথ খুঁজে বেড়ায়।
তাদের অবদান কেবল অর্থনীতিতে পাঠানো ডলারের হিসাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তাদের অবদান হলো ত্যাগ, কঠোর পরিশ্রম এবং দেশের বাইরে এক নতুন বাংলাদেশি পরিচয়ের নীরব নির্মাণ।
তাই, প্রবাসীদের যথাযথ সম্মান দিতে হলে আমাদের শুধু অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে চলবে না। আমাদের দেখতে হবে তাদের মানবিক দিক, তাদের ব্যক্তিগত কষ্ট, তাদের মানসিক যন্ত্রণা। সরকার এবং সমাজউভয়কেই এগিয়ে আসতে হবে। বিমানবন্দরে হয়রানি বন্ধ করা, বিদেশে তাদের অধিকার নিশ্চিত করা, এবং দেশে তাদের সম্পত্তি ও সম্মান সুরক্ষিত রাখাএগুলো এখন সময়ের দাবি। একই সাথে, প্রফেশনাল প্রবাসীদের মেধা ও অভিজ্ঞতাকে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগানোর একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি ।
প্রবাসীদেরকে কেবল আয়ের উৎস হিসেবে না দেখে, তাদের মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করতে হবে। তাদের স্বপ্নগুলোকে সম্মান জানাতে হবে। তবেই হয়তো এক সাগর কষ্ট পাড়ি দিয়ে আসা করিমের মতো লক্ষ লক্ষ প্রবাসীর স্বপ্ন সার্থক হবে এবং তারা সত্যিকার অর্থেই দেশের গর্বিত অংশীদার হতে পারবে।
শেষে, চলুন একটু থেমে দেখিআমাদের ঘরের ডাইনিং টেবিলে যে খালি চেয়ারটা প্রতি ঈদে এদিক-ওদিক টেনে রাখা হয়, সেটা কি শুধু অনুপস্থিত একজন মানুষকে বোঝায়, নাকি পুরো একটি অর্থনীতির নীরব স্তম্ভকে? রেমিট্যান্সের সংখ্যাটা বার্ষিক প্রতিবেদনকে চকচকে করে, কিন্তু যে হাতগুলো সে সংখ্যা বানায়ঝাঁঝালো মরু-হাওয়ায় ফেটে যাওয়া তালু, রাতজাগা শিফটে নুয়ে পড়া পিঠ, নতুন ভাষায় ঠিক আছি বলতে-বলতে গিলে ফেলা কণ্ঠতাদের নাম কি আমরা কোথাও লিখে রাখি?
একবার কল্পনা করুন, রাত তিনটা। গ্রামের উঠোনে বাতাসে ধানের গন্ধ। পুরনো ফোনটা টুং করে ওঠেওপাশে পরিচিত কণ্ঠ, মা, টাকাটা কাল পৌঁছাবে। মা জানালার ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখে বলেতুই শুধু সুস্থ থাক। এই ছোট্ট কথোপকথনের ভেতরেই কি লুকিয়ে নেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটা বড় পাঠসামাজিক নিরাপত্তা, তথ্যের স্বচ্ছতা, আইনি সুরক্ষা আর সম্মানের সংজ্ঞা? যদি থাকে, তাহলে আমরাপাড়া, প্রশাসন, নীতি–সবাইকেন সেই পাঠ মুখস্থ করি না?
আমরা কি সত্যিই দেশে থাকা মানুষ হিসেবে প্রবাসীদের ‘বাইরের লোক’ ভাবি? নাকি ইচ্ছে করলেই পারিতাদের ফেরাকে নতুন শুরুর নামে স্বাগত জানাতে? একটা সাশ্রয়ী ঋণ, একটা টেকনিক্যাল সার্টিফিকেট, একটা ছোট বাজারসংযোগএগুলো কি খুবই অসম্ভব, যখন প্রতিদিনই তাদের টাকা দিয়ে শহরের আলো জ্বলে, গ্রামের টিউবওয়েল ঘুরে, শিশুরা নতুন জুতো পরে স্কুলে যায়?
এখানেই আমাদের প্রজন্মের নৈতিক প্রশ্নটা দাঁড়িয়ে থাকে: আমরা কি কেবল ডলার গুনি, নাকি মানুষটাকেও গুনি? আমরা কি একবারও জিজ্ঞেস করিবিদেশে যাওয়ার আগের সপ্তাহে সে সঠিক নিয়ম জানত কি না; সমস্যায় পড়লে দূতাবাসের দরজা কোনদিকে, সেটাই বা জানে কি? আমরা কি সামাজিক আড়ম্বরের বদলে একটি কার্যকর চেকলিস্ট হাতে দিই, বলিএই চুক্তিটা পড়ে নাও, পাসপোর্টটি নিজের কাছে রাখো, হুন্ডির ফাঁদে পড়ো না?
সবশেষে, নিজের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করি: আগামী ঈদে খালি চেয়ারটার গল্প বদলাতে আমি কী করছি? আমি কি সেই কণ্ঠের পাশে দাঁড়াচ্ছি, যে কণ্ঠ দূরদেশে দাঁড়িয়ে বলছেআমি আছি, তোমরা ভালো থেকো? যদি না দাঁড়াই, তাহলে এই দেশকে মূল্যায়নের যে বড় বড় মাপকাঠি আমরা মুখে বলিসেগুলোর ভিত আসলে কোথায়?
ধরা যাক, আজ থেকেই আমরা সিদ্ধান্ত নিলামপ্রবাসী মানে শুধু টাকা নয়; প্রবাসী মানে একটি ঘরের, একটি গ্রামের, একটি দেশের সম্মান। তাহলে কি আগামী বছরের কোনো এক ভোরে, ফিরে আসা বিমানের দরজায় আমরা দেখবখালি চেয়ারটা আর খালি নেই? আর যদি সত্যিই তা দেখি, ইতিহাস কি সেদিন লিখবে নাএ দেশ সংখ্যায় নয়, মানুষে বড় হয়েছে? এখন সিদ্ধান্ত আমাদেরআমরা সংখ্যার গল্প লিখব, নাকি মানুষের।
প্রবাসী, রেমিট্যান্স, বিদেশগমন, বাংলাদেশি প্রবাসী, নিরাপত্তা, দালাল প্রতারণা, BMET, বৈধ রেমিট্যান্স, প্রবাসী অধিকার, উদ্যোক্তা, রিটার্নি, পরিবার, গ্রাম-শহর।
🌸 আপনার মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ!
আপনার মতামত আমাদের অনুপ্রাণিত করে এবং আগামীতে আরও মানসম্পন্ন কনটেন্ট তৈরিতে সহায়তা করে।
আপনি যদি কোনো নির্দিষ্ট বিষয় বা গল্প পছন্দ করে থাকেন, জানালে ভালো লাগবে।
নিয়মিত পাশে থাকুন — আপনার সহযোগিতা ও ভালোবাসাই আমাদের এগিয়ে চলার শক্তি।
শুভ কামনায়,
✍️ কল্পকথা-৩৬০ ব্লগ টিম
https://kalpakatha360.blogspot.com