বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামগুলোয় জন্ম নেওয়া প্রতিটি শিশুই যেন জীবনের প্রথম দিন থেকেই এক অদৃশ্য যুদ্ধে নামে। একদিকে দারিদ্র্যের কঠিন শেকল অন্যদিকে কুসংস্কার আর সামাজিক গোঁড়ামির দুর্ভেদ্য প্রাচীরএই দুইয়ের মাঝে তাদের স্বপ্নগুলো প্রায়শই শিশিরবিন্দুর মতো অকালেই ঝরে পড়ে। তবু কি সত্যিই সব স্বপ্ন থেমে যায়? ইতিহাস সাক্ষী সবচেয়ে অন্ধকার রাতের পরেই আসে ভোরের আলো। সেই রাতের আঁধার ভেদ করে যে কজন মানুষ আলোর মশাল হাতে এগিয়ে আসতে পারে তারাই সমাজের মুখচ্ছবি বদলে দেয়। নাসরিন সুলতানার গল্পটি ঠিক তেমনই এক প্রত্যয়ের আখ্যানযেখানে এক হতদরিদ্র কৃষকের মেয়ে নিজের অদম্য ইচ্ছা আর মানুষের ভালোবাসাকে পাথেয় করে অশিক্ষা অভাব আর কুসংস্কারের হিমালয় ডিঙিয়ে দাঁড়িয়েছে হাজারো মেয়ের জন্য প্রেরণার বাতিঘর হয়ে।
বাংলাদেশের বিশাল মানচিত্রের বুকে শিমুলতলী গ্রামটি যেন সযত্নে লুকিয়ে রাখা এক বিন্দু। বর্ষায় কাদামাখা পিচ্ছিল পথ আর হেমন্তে দিগন্তজোড়া সোনালি ধানের শীষে দুলতে থাকা এই গ্রামের জীবন ছিল নদীর স্রোতের মতোই শান্ত অথচ পাথরের মতো কঠিন। এখানেই এক জীর্ণ মাটির ঘরের স্যাঁতসেঁতে উঠোনে ভোরের প্রথম আলোর মতো স্নিগ্ধ হয়ে জন্ম নিয়েছিল নাসরিন সুলতানা। তার বাবা হাশেম মিয়া ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই মাটির মানুষ। তার পেশির শক্তি আর গায়ের নোনা ঘাম যখন ফসলের মাঠে সোনায় রূপান্তরিত হতো তখনই পাঁচ সদস্যের পরিবারের মুখে জুটত দু'মুঠো অন্ন। মা আমেনা বেগম ছিলেন এক নীরব ছায়াবৃক্ষ। তার পৃথিবী সীমাবদ্ধ ছিল মাটির চুলা ঢেঁকির পাড় আর তুলসীতলার মধ্যেই। কিন্তু সেই সীমাবদ্ধ পৃথিবীর গভীরে তিনি সযত্নে পুষে রেখেছিলেন এক আকাশ স্বপ্নযে স্বপ্ন ডানা মেলার আগেই বাস্তবতার কঠিন খাঁচায় বন্দি হয়ে গিয়েছিল।
নাসরিনের শৈশব ছিল দুরন্ত কিন্তু অদ্ভুতভাবে নিঃসঙ্গ। তার খেলার সাথী ছিল উঠোনের কোণে থাকা বুড়ো পেয়ারা গাছটা পুকুরের জলে গলা ডুবিয়ে সাঁতরে বেড়ানো হাঁসের দল আর দূর থেকে বাতাসে ভেসে আসা আজানের সুর। তবে তার চোখের মণিতে ছিল এক অদ্ভুত তৃষ্ণা যা তাকে সমবয়সীদের থেকে আলাদা করে দিত। যখন অন্য শিশুরা গোল্লাছুট আর কানামাছিতে মেতে থাকত নাসরিনের দৃষ্টি আটকে যেত গ্রামের একমাত্র কাঁচা রাস্তাটি ধরে স্কুলে যাওয়া ছেলেমেয়েদের দিকে। সে অবাক হয়ে ভাবত ওই বইয়ের সাদাকালো অক্ষরগুলোর মধ্যে কী এমন অমৃত লুকিয়ে আছে যা পাওয়ার জন্য এত আয়োজন? তার ছোট্ট হৃদয়ে এক অব্যক্ত ইচ্ছে চারা গাছের মতো ডালপালা মেলতসেও একদিন ওই পথের যাত্রী হবে।
কিন্তু হাশেম মিয়ার নুন আনতে পান্তা ফুরানো সংসারে মেয়ের জন্য শিক্ষার আলো কেনার স্বপ্ন দেখা ছিল এক দুঃসাহসিক বিলাসিতা। গ্রামের মোড়ল থেকে শুরু করে চায়ের দোকানের আড্ডাবাজসকলেই একবাক্যে রায় দিত মিয়া ভাই মাইয়া মানুষ হইল পরের বাড়ির আমানত। হেরে দিয়া লেখাপড়া শিখাইয়া কী লাভ? এর চেয়ে বরং রান্ধনবাড়ন সুইসুতার কাম শিখাও। শ্বশুরবাড়িতে গিয়া নামডাক হইবো। এই কথাগুলো ধারালো ছুরির ফলার মতো হাশেম মিয়ার মনে বিঁধত। একদিকে দারিদ্র্যের নির্মম বাস্তবতা অন্যদিকে মেয়ের ডাগর চোখের নীরব আকুতিএই দুইয়ের যাঁতাকলে তিনি ছিলেন অসহায়।
এই দ্বিধার আঁধারেই প্রদীপ হয়ে জ্বলে উঠেছিলেন আমেনা বেগম। এক রাতে স্বামীকে তিনি বলেছিলেন পোলাটারে যেমন দশ মাস গর্ভে ধরছি মাইয়াটারেও তো তাই। আসমান থাইকা আল্লাহ যারে জ্ঞান দিছে সেই জ্ঞান কাইড়া নেওয়ার আমরা কে? মাইয়া আমার পড়ব। যত কষ্টই হউক আমি ওর পথ বন্ধ হইতে দিমু না। মায়ের এই ইস্পাতকঠিন মনোবলের কাছে হার মানতে হয়েছিল বাবাকে। পরদিন সকালে হাশেম মিয়া মেয়ের নরম হাতটি ধরে ভর্তি করে দিয়েছিলেন শিমুলতলী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
স্কুলের নড়বড়ে দেয়াল উইপোকায় খাওয়া বেঞ্চি আর প্রায় মুছে যাওয়া ব্ল্যাকবোর্ডএই ভাঙাচোরা পৃথিবীটাই ছিল নাসরিনের কাছে এক অমরাবতী। প্রতিটি অক্ষর তার কাছে ছিল এক একটি গুপ্তধনের চাবি। স্কুলের প্রধান শিক্ষক হারুন স্যার ছিলেন একজন জহুরী। তিনি প্রথম দিনেই নাসরিনের চোখের দ্যুতি দেখে চিনে নিয়েছিলেন এই অমূল্য রত্নটিকে। তিনি বুঝেছিলেন এই মেয়ে শুধু পরীক্ষায় পাসের জন্য আসেনি সে এসেছে জ্ঞানের অতল সমুদ্রে অবগাহন করতে।
জ্ঞানার্জনের পথ কখনোই মসৃণ হয় না। দারিদ্র্যের করাল ছায়া তাকে বারবার গ্রাস করতে চেয়েছে। কতদিন পান্তা ভাতে নুন মেখে খেয়ে স্কুলে যেতে হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। সহপাঠীদের রঙিন জামা আর নতুন জুতো দেখে তার শিশু মনে মেঘ জমলেও বইয়ের পাতার জাদুকরী জগৎ তাকে নিমেষেই সেই মেঘ সরিয়ে দিত। পঞ্চম শ্রেণিতে সে যখন এলাকায় প্রথম বৃত্তি পেল সেদিনই প্রথম হাশেম মিয়া উপলব্ধি করলেন তার মেয়ের স্বপ্নটা নিছক কল্পনা নয় এ এক জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি যার মধ্যে লুকিয়ে আছে অসীম সম্ভাবনা। মেয়ের সাফল্যের সেই খবর শুনে বাবার ঘর্মাক্ত ক্লান্ত মুখে যে অনাবিল হাসির ঝিলিক ফুটে উঠেছিল সেই দৃশ্যটি নাসরিনের কচি মনে এক অমূল্য স্মৃতি হয়ে রইল।
মাধ্যমিকের গণ্ডিতে পা রাখার পর সংগ্রামটা যেন আরও তীব্র হলো। পড়ার খরচ বাড়ল সেই সাথে বাড়ল গ্রামের মানুষের বাঁকা কথাও। দেখছ নি হাশেমের মাইয়ার তেজ! শরমের মাথা খাইয়া এত বড় মাইয়া ইস্কুলে যায়!এইসব বিষাক্ত কথা যখন আমেনা বেগমের কানে আসত তিনি নীরবে আঁচলে চোখ মুছতেন আর দ্বিগুণ উদ্যমে কাঁথা সেলাইয়ে মন দিতেন। তার প্রতিটি ফোঁড় যেন ছিল মেয়ের স্বপ্ন বোনার এক একটি ধাপ।
এই কঠিন সময়ে নাসরিনের জীবনে আশীর্বাদের ছায়া নিয়ে এলেন গ্রামের মসজিদের ইমাম ফজলুর রহমান সাহেব। তিনি ছিলেন একজন প্রাজ্ঞ ও আলোকিত মানুষ। জুমার খুতবায় তিনি প্রায়শই নারী শিক্ষার গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে বলতেন রাসূল (সাঃ) বলেছেন জ্ঞানার্জন প্রত্যেক নরনারীর উপর ফরজ। একজন শিক্ষিত মা পারেন একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দিতে। তিনি নিজে নাসরিনদের বাড়ি এসে হাশেম মিয়াকে সাহস দিতেন আপনার মেয়ে এই গ্রামের ভবিষ্যৎ। ও একাই এই গ্রামের চেহারা বদলে দেবে। ওকে থামতে দেবেন না। ইমাম সাহেবের এই কথাগুলো ধীরে ধীরে গ্রামের মানুষের বদ্ধ চিন্তার দরজায় নাড়া দিতে শুরু করল।
হারুন স্যারও তার প্রিয় ছাত্রীর জন্য ছায়ার মতো পাশে ছিলেন। তিনি শুধু বিনা বেতনেই পড়াতেন না বরং নিজের সামান্য সঞ্চয় থেকে নাসরিনের জন্য বইখাতা কিনে আনতেন। তার দেখানো পথেই হেঁটে নাসরিন এস.এস.সি. পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পুরো জেলায় প্রথম স্থান অধিকার করল।
এই অবিশ্বাস্য ফলাফলে শিমুলতলী গ্রামে যেন উৎসবের আমেজ নেমে এলো। যারা একদিন নাসরিনের পড়াশোনা নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করত তারাই আজ মিষ্টি হাতে তাদের বাড়িতে ভিড় জমাচ্ছে। কিন্তু নাসরিনের দৃষ্টি ছিল আরও দূরে আকাশের তারাদের পানে। সে ডাক্তার হতে চেয়েছিল। তার চোখের সামনে এখনও ভাসে সেই ভয়াল দৃশ্যছোট ভাইটা টাইফয়েডের জ্বরে ছটফট করতে করতে বিনা চিকিৎসায় তার কোলেই নিস্তেজ হয়ে গিয়েছিল। গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তার কেবল অসহায়ভাবে তাকিয়ে ছিলেন। সেইদিনই সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল জ্ঞানের অভাবে আর কোনো প্রাণ সে ঝরতে দেবে না।
কিন্তু ডাক্তারি পড়ার খরচ ছিল আকাশছোঁয়া। হাশেম মিয়ার পক্ষে যা ছিল এক অলীক কল্পনা। এবার সত্যিই নাসরিন প্রায় ভেঙে পড়েছিল। কিন্তু তার মা হারুন স্যার এবং ইমাম সাহেব আবারও তার পাশে এসে দাঁড়ালেন। তারা মিলে একটি তহবিল গঠন করলেন। ইমাম সাহেব মসজিদে সাহায্যের আবেদন জানালেন। গ্রামের সেই হতদরিদ্র মানুষগুলো যারা নিজেরা একবেলা খেয়ে অন্যবেলা উপোস থাকে তারাও তাদের নাসরিন আপার জন্য দশবিশ টাকা করে তহবিলে জমা দিল। এ ছিল এক অভূতপূর্ব দৃশ্যপুরো গ্রাম যেন একাত্ম হয়ে গিয়েছিল একটি স্বপ্নকে সত্যি করার জন্য।
সবার সম্মিলিত ভালোবাসা আর ত্যাগের শক্তিতে নাসরিন ঢাকার এক নামকরা মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেল। কিন্তু শহরের যান্ত্রিক জীবন কোলাহল আর কৃত্রিমতা তাকে গ্রাস করতে চাইল। গ্রামের সেই সহজসরল মেয়েটি শহরের আধুনিকতার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিল না। হলের চার দেয়ালের মধ্যে নিজেকে খুব একা মনে হতো। অনেক রাতে সে গ্রামের কথা ভেবে মায়ের কথা ভেবে নীরবে কেঁদেছে। কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে পড়ত সেই মানুষগুলোর কথা যারা তাদের মুখের গ্রাস তুলে দিয়ে তাকে এখানে পাঠিয়েছে। তাদের বিশ্বাস আর ভালোবাসার মর্যাদা তাকে রাখতেই হবে। এই প্রত্যয়ই তাকে সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করার শক্তি জুগিয়েছে।
পাঁচ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম নির্ঘুম রাত আর কঠিন সংগ্রামের পর অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এলো। নাসরিনের নামের আগে ডাক্তার শব্দটি স্বর্ণাক্ষরে খচিত হলো। যে মেয়ে একদিন ধুলোমাখা পায়ে হেঁটে স্কুলে যেত আজ তার গলায় ঝুলছে স্টেথোস্কোপ। যে মেয়ে একদিন কেরোসিনের কুপির মিটমিটে আলোয় পড়েছে আজ সে নিজেই জ্ঞানের এক জ্বলন্ত মশাল।
পাস করার পর শহরের নামীদামী হাসপাতাল থেকে মোটা অঙ্কের বেতনের চাকরির প্রস্তাব এসেছিল। কিন্তু নাসরিন তার শেকড়কে ভোলেনি। সে ফিরে এলো তার ভালোবাসার গ্রাম শিমুলতলীতে। গ্রামের প্রান্তে বাবার দেওয়া এক টুকরো জমিতে সে গড়ে তুলল শিমুলতলী মা ও শিশু স্বাস্থ্যকেন্দ্র।
আজ ডাক্তার নাসরিন সুলতানা শুধু একজন চিকিৎসক নন; তিনি শিমুলতলী এবং তার আশেপাশের গ্রামের মানুষের কাছে এক জীবন্ত কিংবদন্তী তাদের আশার আলো। তার ক্লিনিকে তিনি শুধু রোগের চিকিৎসাই করেন না তিনি মানুষের মনেরও চিকিৎসা করেন। তিনি গ্রামের নারীদের শিখিয়েছেন স্বাস্থ্য সচেতনতা শিশুদের দিয়েছেন টিকার সুরক্ষা আর কিশোরীদের দিয়েছেন স্বপ্ন দেখার সাহস।
এখন আর শিমুলতলীতে কোনো শিশুকে অপুষ্টি বা বিনা চিকিৎসায় মরতে হয় না। গ্রামের মেয়েরা এখন বুক ফুলিয়ে স্কুলে যায় কারণ তাদের সামনে রয়েছে নাসরিনের মতো এক আকাশছোঁয়া উদাহরণ। যে সমাজ একদিন বলেছিল মেয়েদের পড়াশোনার কী দরকার? সেই সমাজই আজ গর্ব করে বলে আমাদের গ্রামের মেয়ে ডাক্তার নাসরিন।
নাসরিনের বাবা হাশেম মিয়া এখন বার্ধক্যের ভারে ন্যুব্জ কিন্তু তার মুখে লেগে আছে এক অনাবিল প্রশান্তি। মা আমেনা বেগম মেয়ের দিকে তাকিয়ে যখন নীরবে হাসেন তখন তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে আনন্দাশ্রু। হারুন স্যার এবং ইমাম সাহেব তাদের ছোট মাএর কীর্তি দেখে পরম করুণাময়ের কাছে কৃতজ্ঞতায় মাথা নত করেন।
নাসরিনের সাফল্যের আড়ালে যে দুটি মানুষ ছায়ার মতো মিশে ছিলেন, তারা হলেন তার বাবা হাশেম মিয়া আর মা আমেনা বেগম। তাদের গল্পটি কোনো বিজয়গাঁথা নয়, বরং তিলে তিলে নিজেদের ক্ষয় করে একটি স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার এক নীরব মহাকাব্য।
হাশেম মিয়া ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই মাটির মানুষ। তার জীবন বাঁধা ছিল ঋতুর আবর্তে আর অন্যের জমির ফসলের হাসিতে। গ্রীষ্মের গনগনে সূর্য যখন মাথার ওপর আগুন ঝরাতো, তখন তার গায়ের ঘাম নোনা জল হয়ে মিশে যেত কর্ষিত জমির সাথে। বর্ষার অঝোর ধারায় ভিজে যখন তার শরীর জ্বরে কাঁপত, তখনও তিনি পরের জমিতে নিড়ানি দিতেন, কারণ তিনি জানতেন, একদিন কাজ না করলে পরের দিন চুলোয় হাঁড়ি চড়বে না। তার পেশিগুলো ছিল পাথরের মতো শক্ত, কিন্তু মেয়ের ভবিষ্যতের চিন্তায় তার ভেতরটা ছিল নদীর পাড়ের মতো নরম, যা প্রতিনিয়ত ভাঙনের শিকার হতো।
নাসরিনকে স্কুলে পাঠানোর সিদ্ধান্তটি তার জন্য ছিল একাধারে আশা এবং আতঙ্ক। একদিকে মেয়ের চোখে জ্ঞানের যে অদম্য তৃষ্ণা তিনি দেখতেন, তা তাকে মুগ্ধ করত। অন্যদিকে গ্রামের মানুষের কটু কথা আর নিজের আর্থিক অক্ষমতা তাকে কুরে কুরে খেত। চায়ের দোকানে যখন গ্রামের মুরুব্বিরা তাকে ঘিরে ধরে বলত, "হাশেম, আখেরের চিন্তা করো। মাইয়ার পিছনে টাকা খরচ করা আর ফুটো কলসিতে পানি ভরা একই কথা।"তখন তিনি কোনো উত্তর দিতে পারতেন না। মাথা নিচু করে নীরবে চা খেতেন, কিন্তু সেই অপমানের তেতো স্বাদ তার গলা দিয়ে নামতে চাইত না।
রাতের আঁধারে, যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ত, হাশেম মিয়া দাওয়ায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। তার মনে চলত এক নিরন্তর যুদ্ধ। তিনি ভাবতেন, "আমি কি ভুল করছি? আমার মতো গরিবের কি এত বড় স্বপ্ন দেখা সাজে?" মেয়ের একটি নতুন খাতা বা কলমের জন্য তিনি হয়তো সেদিন দুপুরে কিছুই খাননি, সেই ক্ষুধার যন্ত্রণা তার কাছে তুচ্ছ মনে হতো যখন তিনি দেখতেন, নাসরিন কুপির আলোয় তন্ময় হয়ে পড়ছে। মেয়ের বইয়ের পাতার প্রতিটি অক্ষর যেন তার বাবার বুকের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক একটি স্বপ্নের পদচিহ্ন।
নাসরিনের বৃত্তির টাকা হাতে পেয়ে তিনি সেদিন কাঁদেননি, কিন্তু তার চোখ দুটি চিকচিক করে উঠেছিল। সেই সামান্য কটা টাকা তার কাছে ছিল এক সমুদ্রের সমান। এটি শুধু টাকা ছিল না, ছিল তার এতদিনের নীরব সংগ্রামের প্রথম স্বীকৃতি। তিনি সেদিন প্রথমবার সমাজের চোখে চোখ রেখে বলতে পেরেছিলেন, তার মেয়ে শুধু মেয়ে নয়, সে তার গর্ব। মেয়ের জন্য তিনি নিজের ছেঁড়া জামাটা আরও কয়েক বছর সেলাই করে পরেছেন, পায়ের স্যান্ডেল ছিঁড়ে গেলে খালি পায়ে হেঁটেছেন, কিন্তু মেয়ের পড়ার খরচে এক মুহূর্তের জন্যও আঁচড় লাগতে দেননি। তার এই নীরব ত্যাগই ছিল নাসরিনের স্বপ্নের মূল ভিত্তি।
আমেনা বেগমের পৃথিবীটা ছিল ছোটরান্নাঘর, উঠোন আর পুকুরঘাট। কিন্তু তার স্বপ্নের পরিধি ছিল আকাশের চেয়েও বিশাল। তার নিজের জীবনে পড়াশোনার সুযোগ আসেনি, সেই অতৃপ্তি তিনি তার মেয়ের মাধ্যমে পূরণ করতে চেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন নাসরিনের স্বপ্নের নীরব কারিগর।
তার সংগ্রাম ছিল ভিন্ন মাত্রার। হাশেম মিয়া যখন বাইরের পৃথিবীর সাথে লড়তেন, আমেনা বেগম তখন সামলাতেন ঘরের ভেতরকার ঝড়। প্রতিবেশীরা যখন এসে বলত, "ভাবী, মাইয়া তো ডাগর হইছে, বিয়া-শাদির চিন্তা করেন। বেশি পড়ালেখা করলে পোলাপান নষ্ট হইয়া যায়।"তিনি মুখে এক চিলতে হাসি ঝুলিয়ে রাখতেন, কিন্তু তাদের চলে যাওয়ার পর আঁচলে চোখ মুছতেন। এই সামাজিক চাপ, এই প্রতিনিয়ত সন্দেহসবকিছু তিনি একাই হজম করতেন।
তার দিন শুরু হতো মোরগের ডাকের আগে। হাঁস-মুরগির ডিম বিক্রি করা, কাঁথা সেলাই করা, অন্যের বাড়ির ধান ভেনে দেওয়াকোনো কাজকেই তিনি ছোট মনে করেননি। রাতের নিস্তব্ধতায়, যখন পুরো গ্রাম ঘুমিয়ে পড়ত, আমেনা বেগম কুপির আলোয় বসে কাঁথায় ফুল তুলতেন। তার প্রতিটি সুচের ফোঁড় ছিল মেয়ের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য বোনা এক একটি প্রার্থনা। সেই কাঁথা বিক্রির সামান্য কটা টাকা তিনি সযত্নে জমিয়ে রাখতেন মাটির কলসিতে, যা ছিল নাসরিনের শিক্ষা ব্যাংক।
মেয়ে যখন শহরের হোস্টেলে থেকে পড়ত, আমেনা বেগম তার জন্য চাল, ডাল আর বাড়িতে বানানো নাড়ু-মোয়া গুছিয়ে দিতেন। তিনি জানতেন, এই সামান্য খাবারটুকু হয়তো মেয়ের কয়েকদিনের খরচ বাঁচাবে। মেয়ের কাছ থেকে চিঠি এলে তিনি নিজে পড়তে পারতেন না, হারুন স্যারের কাছে গিয়ে পড়িয়ে নিতেন। মেয়ের সাফল্যের প্রতিটি শব্দ তার কানে অমৃতের মতো শোনাত। তিনি হয়তো কোনোদিন বড় বড় বই পড়েননি, কিন্তু তিনি জানতেন, জ্ঞানের আলোই পারে তার মেয়ের জীবন থেকে সব অন্ধকার দূর করে দিতে।
আমেনা বেগম ছিলেন এক নীরব স্রোতের মতো, যার কোনো গর্জন ছিল না, কিন্তু যার প্রবাহে ছিল পাহাড় সরিয়ে দেওয়ার শক্তি। তার আঁচলের ছায়াই ছিল নাসরিনের সবচেয়ে বড় আশ্রয়, আর তার অদম্য ইচ্ছাই ছিল নাসরিনের এগিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। এই মাটির মানুষ দুটি তাদের নিজেদের সবটুকু দিয়ে একটি স্বপ্নের চারাগাছকে মহীরুহে পরিণত করেছিলেন, যার ছায়ায় আজ আশ্রয় নিয়েছে পুরো একটি গ্রাম।
হাশেম মিয়া ও আমেনা বেগমের এই একক যুদ্ধটা হয়তো সফল হতো না, যদি না এর সাথে কিছু মানুষের নিঃস্বার্থ সমর্থন যুক্ত হতো। সমাজের কটু কথার ভিড়েই কিছু প্রতিবেশী আশার আলো হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। নাসরিনের মেধা আর তার মায়ের আকুতি দেখে কেউ হয়তো নিজেদের বাচ্চার পুরোনো বইটা দিয়ে যেতেন, কেউবা এক বাটি দুধ পাঠিয়ে বলতেন, ভাবী, মাইয়াটারে দিয়েন। রাইত জাইগা পড়ে, শরীলে বল পাইবো। এই ছোট ছোট সমর্থনগুলোই আমেনা বেগমকে সামাজিকভাবে একঘরে হয়ে যাওয়ার ভয় থেকে মুক্তি দিত। বিশেষ করে নাসরিনের এস.এস.সি. ফলাফলের পর, যে প্রতিবেশীরা একদিন সমালোচনা করত, তারাই অর্থ সংগ্রহে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে এসেছিলেন। তাদের এই পরিবর্তন প্রমাণ করে, একটি ভালো কাজ পুরো সমাজের চিন্তাধারা বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
এই সামাজিক সমর্থনের পাশাপাশি সবচেয়ে বড় শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল শিক্ষকদের অবদান। স্কুলের প্রধান শিক্ষক, হারুন স্যার, ছিলেন নাসরিনের জীবনে একজন পথপ্রদর্শক। তিনি শুধু নাসরিনের মেধা চিনেছিলেন তাই নয়, তিনি হাশেম মিয়ার ভেতরের ভয়টাকেও পড়তে পেরেছিলেন। তিনি প্রায়ই বিকেলে নাসরিনদের বাড়িতে এসে দাওয়ায় বসে হাশেম মিয়ার সাথে গল্প করতেন। পড়াশোনার গুরুত্ব বোঝানোর পাশাপাশি তিনি বলতেন, "হাশেম ভাই, আপনার মাইয়া শুধু আপনার না, ও এই ইস্কুলের, এই গ্রামের সম্পদ। ওর দায়িত্ব আমাদের সবার।" তিনি নাসরিনকে বিনা বেতনে পড়াতেন, নিজের সামান্য বেতন থেকে পরীক্ষার ফি দিয়ে দিতেন এবং বিভিন্ন সরকারি বৃত্তির খোঁজখবর রাখতেন।
একইভাবে গ্রামের মসজিদের ইমাম, ফজলুর রহমান সাহেব, ছিলেন আরেকজন আলোকবর্তিকা। তিনি জুমার খুতবায় নারী শিক্ষার গুরুত্ব নিয়ে কথা বলে গ্রামের মানুষের মানসিকতা পরিবর্তনে বিশাল ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামির বিপরীতে দাঁড়িয়ে জ্ঞানের আলোকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তিনিই প্রথম নাসরিনের মেডিকেল কলেজে পড়ার জন্য তহবিল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
এই শিক্ষকেরা ছিলেন নাসরিনের বাবা-মায়ের মানসিক শক্তির উৎস। যখনই হাশেম মিয়া বা আমেনা বেগম সমাজের চাপে ভেঙে পড়তেন, হারুন স্যার বা ইমাম সাহেবের মতো মানুষেরা তাদের কাঁধে হাত রেখে বলতেন, আপনারা একা নন, আমরা সাথে আছি।
আমেনা বেগম ছিলেন এক নীরব স্রোতের মতো, যার কোনো গর্জন ছিল না, কিন্তু যার প্রবাহে ছিল পাহাড় সরিয়ে দেওয়ার শক্তি। তার আঁচলের ছায়াই ছিল নাসরিনের সবচেয়ে বড় আশ্রয়, আর তার অদম্য ইচ্ছাই ছিল নাসরিনের এগিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। এই মাটির মানুষ দুটি তাদের নিজেদের সবটুকু দিয়ে একটি স্বপ্নের চারাগাছকে মহীরুহে পরিণত করেছিলেন, যার ছায়ায় আজ আশ্রয় নিয়েছে পুরো একটি গ্রাম।
নাসরিনের এই আখ্যান কোনো রূপকথা নয়। এটি বাংলাদেশের লক্ষকোটি নাসরিনের জীবন সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। এটি আমাদের শেখায় অদম্য ইচ্ছা কঠোর পরিশ্রম এবং মানুষের সম্মিলিত ভালোবাসা থাকলে কোনো বাধাই অপ্রতিরোধ্য নয়। একটি প্রদীপ থেকে যেমন হাজারো প্রদীপ জ্বালানো যায় তেমনি একজন নাসরিন আজ শিমুলতলীর প্রতিটি ঘরে শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে। অন্ধকারের গভীরতম উৎস থেকেই জন্ম নিয়েছে এক নতুন সকালের সূর্য যে সূর্যের আলোয় আলোকিত হবে আগামীর বাংলাদেশ।
নাসরিন সুলতানার জীবনকথা কোনো কল্পকাহিনি নয়এটি বাংলাদেশের প্রতিটি নাসরিনের গল্প যারা প্রতিদিন অন্ধকারের সাথে লড়ে আলোর পথ খুঁজছে। প্রশ্ন হলো আমরা কি তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছি? নাকি এখনো পুরোনো বাঁধাধরা চিন্তাভাবনার দেয়াল তুলে তাদের স্বপ্নকে রুদ্ধ করছি?
একজন নাসরিনের সাফল্য পুরো একটি গ্রামকে আলোকিত করতে পারে। তাহলে যদি প্রত্যেক গ্রামেই একজন করে নাসরিন উঠে আসে কেমন হবে আমাদের বাংলাদেশ? হয়তো তখন কোনো শিশুই বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে না কোনো মেয়ে শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে না কোনো স্বপ্ন কুসংস্কারের আঁধারে হারিয়ে যাবে না।
এখন সিদ্ধান্ত আমাদের আমরা কি শুধু গল্প পড়ে আবেগে ভাসব নাকি নিজেদের চারপাশে থাকা নাসরিনদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়াব?
বাংলাদেশি অনুপ্রেরণামূলক গল্প দারিদ্র্য জয় মেয়েদের শিক্ষা ডাক্তার নাসরিন সংগ্রামের কাহিনি নারীর সাফল্য।


🌸 আপনার মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ!
আপনার মতামত আমাদের অনুপ্রাণিত করে এবং আগামীতে আরও মানসম্পন্ন কনটেন্ট তৈরিতে সহায়তা করে।
আপনি যদি কোনো নির্দিষ্ট বিষয় বা গল্প পছন্দ করে থাকেন, জানালে ভালো লাগবে।
নিয়মিত পাশে থাকুন — আপনার সহযোগিতা ও ভালোবাসাই আমাদের এগিয়ে চলার শক্তি।
শুভ কামনায়,
✍️ কল্পকথা-৩৬০ ব্লগ টিম
https://kalpakatha360.blogspot.com