আমরা বিশ্বাস করিজায়গা মানেই ইতিহাস আর ইতিহাস মানেই মানুষ। কিন্তু পৃথিবীর কিছু জায়গা আছে যেগুলোর আছে নিজস্ব ব্যক্তিত্ব নিজস্ব অভিমত। তারা কথা বলে না কিন্তু অনুভূতি পাঠিয়ে দেয় বাতাসে জলে নিস্তব্ধতায়।
কখনো কি তুমি এমন নদীর কথা শুনেছযার পানি নীল নয় যেন স্বপ্ন নীল?
কখনো কি এমন জায়গায় গিয়েছ যেখানে দাঁড়িয়ে মনে হয় “আমি এখন বাস্তবে আছি তো?”
বাংলাদেশের এক প্রান্তে এমনই একটি জায়গা আছেনাম তার লালাখাল।
এটি যেন এক জীবন্ত রূপকথা যার প্রতিটি ঢেউয়ে লুকিয়ে আছে এমন গল্প যা মুখে কেউ বলে না শুধু অনুভব করা যায়।
কিন্তু লালাখাল কি কেবল সৌন্দর্যের আধার?
না। এখানে রয়েছে এমন রহস্যযা শুনলে তুমি কাঁপবে না ঠিকই কিন্তু শিউরে উঠবে। এখানে রাতে নদীর পানি নাকি ‘জেগে’ থাকে। দিনে তার রঙ যেমন শান্ত রাতে তার চোখে জ্বলজ্বল করে অদ্ভুত নিঃশব্দ প্রশ্ন।
এখন প্রশ্ন হলোতুমি কি সাহস রাখো এই সৌন্দর্যের নীচে লুকিয়ে থাকা নীরব গল্প শুনতে?
শহরের জীবনটা কেমন তাই না? খালি দৌড়ের ওপর থাকা। উঁচু উঁচু বিল্ডিংয়ের ফাঁকে আকাশটা ঠিকমতো দেখাই যায় না। এই সব কিছু থেকে যখন মনটা হাঁপিয়ে ওঠে তখন ইচ্ছে করে এমন কোথাও হারিয়ে যাই যেখানে গেলে মনে হবে আরে! জীবন তো সুন্দর। বাংলাদেশে এমনই এক জায়গা আছে নাম তার লালাখাল। সিলেটের সবুজ পাহাড়ের কোলে লুকিয়ে থাকা এক নীল জলের নদী।
এটা কিন্তু কোনো ভ্রমণ কাহিনী না। এটা হলো সেই নীল জলের গভীরে ডুব দিয়ে তুলে আনা কিছু গল্প কিছু শোনা কথা আর কিছু রহস্যের একটা খাতা। চলেন আমার সাথে এই গল্পটা শুনতে শুনতে ঘুরে আসি।
দিনটা ছিল অক্টোবরের মাঝামাঝি বেশ একটা ঠান্ডা ঠান্ডা ভোর। সিলেটের ভিড়ভাট্টা পেছনে ফেলে আমাদের গাড়ি যখন জাফলংয়ের দিকে ছুটছে তখন ভোরের নরম আলো চা-বাগানের ভেজা পাতায় মুক্তোর মতো চিকচিক করছিল। আর বাতাস? সে তো ভেজা মাটি আর কচি চা-পাতার গন্ধে একেবারে মাতাল করে দিচ্ছিল। আমাদের আসল গন্তব্য ছিল তামাবিল রোডের একটা বিশেষ বাঁক যেখান থেকে সরু একটা রাস্তা সোজা চলে গেছে সারীঘাটেমানে লালাখালের দরজায়।
সারী নদীযার পেটে লালাখালের জন্ম সে নিজেই একটা আশ্চর্যের জিনিস। ভারতের মেঘালয় পাহাড় থেকে হাজারটা গল্প নিয়ে নামার পর বাংলাদেশে ঢুকেই নদীটা কেমন যেন শান্ত হয়ে যায় একেবারে ঠান্ডা মাথায়। সারীঘাটে নামার পর গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ হতেই অন্য এক পৃথিবীর শব্দ কানে এলোমাঝিদের চিল্লাচিল্লি জলের ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ আর পাখির কিচিরমিচির। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে গেল নদীর জলের রঙটা। মনে হচ্ছিল হাজার হাজার পান্না কেউ একসাথে গলিয়ে দিয়েছে! জল এতটাই পরিষ্কার যে নিচের বালি ছোট পাথর আর সবুজ শেওলাসব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। আমাদের মাঝি হাসিম চাচা তার ভাঙাচোরা নৌকায় আমাদের তুলে যখন লালাখালের দিকে বৈঠা চালানো শুরু করলেন আমি আমার শহরের মনটাকে ঘাটে ফেলে এক রূপকথার জগতে ঢুকে পড়লাম।
লালাখালের আসল কেরামতি হলো তার জলের রঙ। কিন্তু এই রঙের রহস্যটা কী? বিজ্ঞান নাকি মানুষের বিশ্বাস?
লোকে কী বলে: হাসিম চাচা তার পুরানো লুঙ্গিটা হাঁটুর ওপর তুলে বৈঠায় একটা লম্বা টান দিয়ে বলতে শুরু করলেন আজ্ঞে খালি আসমানি পাথরই না। লোকে কয় জৈন্তা রাজার মাইয়্যার চোখের জলে নাকি এই নদী হইছে। রাজার মাইয়্যা এক গরিব জেলের পোলার প্রেমে পড়ছিল। রাজা তো মানবেই না। মাইয়্যাটা এই নদীর পাড়ে বইসা দিন-রাত কানতো। তার চোখের জল যত পড়ছিল নদীর জলও নাকি তত নীল হইছে। যুগ যুগ ধরে এমন অনেক গল্পই ভাসে এখানকার বাতাসে।
বিজ্ঞান কী বলে: বিজ্ঞানীরা অবশ্য অন্য কথা বলেন। তাদের মতে মেঘালয়ের পাহাড়ে নাকি প্রচুর পরিমাণে কপার সালফেট চুনাপাথরএইসব খনিজ জিনিস আছে। বৃষ্টির জল পাহাড় ধুয়ে ওইগুলো নিয়ে আসে। সারী নদীতে পলিমাটি প্রায় নেই বললেই চলে তাই জলটা কাঁচের মতো পরিষ্কার থাকে। জলের গভীরতা পরিষ্কার ভাব আর সূর্যের আলোর কারসাজিতেই নাকি রঙটা এমন নীলাভ-সবুজ দেখায়।
আমি যা দেখলাম: সত্যি বলতে কী বিজ্ঞান বা গল্পকোনোটাই আমার মনের খটকা দূর করতে পারছিল না। কারণ একই নদীর জল একেক বাঁকে কীভাবে রঙ বদলায় ভাই! নৌকায় যেতে যেতে আমি নিজের চোখে দেখেছিকোথাও জলটা গাঢ় নীল যেন নীলার খনি। একটু এগোতেই সেটা হয়ে যাচ্ছে হালকা ফিরোজা মনে হচ্ছে কেউ আকাশটাই গুলে দিয়েছে। আবার চরের কাছে জলটা হয়ে যাচ্ছে পান্না সবুজ। মনে হচ্ছিল কোনো এক শিল্পী তার বিশাল ক্যানভাসে একটার পর একটা রঙ পরীক্ষা করছে।
লালাখালের এই শান্তশিষ্ট চেহারার পেছনে কিন্তু কিছু গা ছমছমে গল্পও আছে। হাসিম চাচার কাছেই শুনলাম সেই হারানো সওদাগরের গল্পটা।
অনেক বছর আগে এক বর্ষার বিকেলে জৈন্তা রাজ্যের ইদ্রিস সওদাগর মসলা আর দামি কাপড় নিয়ে তার ছোট ডিঙিতে ফিরছিলেন। আকাশ সেদিন মেঘলা ছিল আর নদীর জল ছিল কেমন অস্বাভাবিক রকমের শান্ত। লালাখালের সবচেয়ে গভীর জায়গা যেটাকে ‘জিরো পয়েন্ট’ বলে সেখানে আসার পর হঠাৎ তার নৌকাটা কোনো কারণ ছাড়াই বনবন করে ঘুরতে শুরু করে। মাঝিরা বৈঠা মেরেও নৌকা থামাতে পারছিল না। এরপর চোখের পলকে এক বিশাল ঘূর্ণি তৈরি হয় আর সওদাগরের নৌকা মালপত্রসহ সবাইকে জলের অতলে টেনে নিয়ে যায়। তারপর থেকে তাদের আর কোনো খোঁজই মেলেনি।
অনেকে বলে ওই জায়গায় জলের নিচে নাকি ভয়ঙ্কর স্রোত আছে কেউ বলে ওটা নাগ-নাগিনীর বাড়ি। হাসিম চাচার ভাষায়
এই জল যতো শান্ত এর পেটও ততো গভীর। কারে যে কখন বুকে টাইনা লয় কেউ কইতে পারে না। পূর্ণিমার রাইতে নাকি ওই জায়গা থেইকা কান্দনের শব্দও হুনছে কেউ কেউ।
এই গল্প শোনার পর থেকে আমার চোখে লালাখালের শান্ত জলকে আর আগের মতো নিরীহ মনে হচ্ছিল না।
দিনের বেলা তো লালাখালে অনেক ভিড়ভাট্টা কিন্তু আসল খেলাটা শুরু হয় সন্ধার পর। সূর্যটা যখন পশ্চিমের পাহাড়ে ডুব দেয় তখন পুরো এলাকায় এমন এক নীরবতা নেমে আসে যা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। চারপাশ যখন ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে যায় তখন শোনা যায় প্রকৃতির আসল গানলক্ষ কোটি ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক জলের মৃদু কলকল আওয়াজ আর দূর পাহাড় থেকে ভেসে আসা বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ।
লালাখালের পাশে একটা ছোট রিসোর্টে আমরা রাত কাটালাম। মাঝরাতে বারান্দায় বসে চাঁদের আলোয় নদীর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বুকের ভেতরটা কেমন যেন ছ্যাঁৎ করে উঠছিল। চারদিকে পিনপতন নীরবতা কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল যেন কেউ ফিসফিস করে কথা বলছে। কখনো মনে হচ্ছিল নদীর হাঁটু পানিতে কেউ যেন নুড়ি পাথরের ওপর দিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে। হয়তো পুরোটাই মনের ভুল বাতাস আর জলের খেলা। কিন্তু ওই পরিবেশে থাকলে আপনারও মনে হবে এই নদীটা জীবন্ত; সে কিছু বলতে চায়।
যাবেন কীভাবে? খরচ কেমন? কিছু টিপস
যাওয়ার রাস্তা: সিলেট শহর থেকে সিএনজি বা গাড়ি ভাড়া করে সোজা সারীঘাট। ঘণ্টা দেড়েকের মতো লাগবে। সারীঘাট থেকে ইঞ্জিন নৌকা ভাড়া করে লালাখাল ঘুরতে হবে।
কখন যাবেন: বর্ষার পর মানে অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস হলো লালাখাল যাওয়ার সেরা সময়। তখন জলের রঙ সবচেয়ে সুন্দর থাকে।
নৌকা ভাড়া: এটা পুরোটাই দরদামের ওপর। এক-দুই ঘণ্টার জন্য একটা নৌকা ১৫০০ থেকে ২৫০০ টাকা নিতে পারে।
থাকার জায়গা: লালাখালের কাছেই নাজিমগড় ওয়াইল্ডারনেস পার্ক লালাখাল টি রিসোর্ট ছাড়াও কিছু নতুন রিসোর্ট আর হোমস্টে হয়েছে। সিলেটে থেকেও দিনে দিনে ঘুরে আসা যায়।
কিছু কথা মনে রাখবেন:
লালাখালের অনেক জায়গায় জল কিন্তু সাংঘাতিক গভীর। সাঁতার না জানলে হুট করে পানিতে নামবেন না।
নৌকা ভাড়া করার আগে মাঝির সাথে কথা বলে নেবেন যে কোন কোন জায়গা (যেমন: জিরো পয়েন্ট চা বাগান) দেখাবে।
জায়গাটা আমাদের দেশের সম্পদ। দয়া করে প্লাস্টিকের বোতল বা প্যাকেট নদীতে ফেলে পরিবেশ নষ্ট করবেন না।
লালাখাল থেকে যখন ফিরছিলাম তখন মনে হচ্ছিল শুধু কিছু ছবি বা স্মৃতি নিয়ে ফিরছি না; ফিরছি একরাশ প্রশ্ন আর অদ্ভুত এক ভালো লাগা নিয়ে। লালাখাল শুধু তার নীল জলের জন্য সুন্দর নয় তার না বলা গল্প আর রহস্যের জন্যও সুন্দর।
আপনি যদি এমন একজন হন যিনি প্রকৃতির সাথে কথা বলতে ভালোবাসেন তবে জীবনে একবার অন্তত লালাখালে ঘুরে আসুন। দেখবেন এই নীল জল আপনার মনের ভেতরের কথাগুলোও বের করে আনবে।
তবে মনে রাখবেন কিছু রহস্যের সমাধান না হওয়াটাই ভালো। লালাখাল তেমনই এক রহস্য।
জীবনে আমরা কত জায়গায় ঘুরে বেড়াইশহর সমুদ্র পাহাড় ঝর্ণা। ছবি তুলি গল্প বলি স্মৃতি বানাই। কিন্তু খুব কম কিছু জায়গাই আমাদের ভেতরের একটা অংশ ছুঁয়ে দিয়ে যায়যেমনটা করে লালাখাল।
এই জায়গা শুধু চোখ জুড়ায় না মনেও প্রশ্ন তোলে।
কেন কিছু সৌন্দর্য এত নিঃশব্দ? কেন কিছু পানি দেখে মনে হয় সে কিছু ভুলে যেতে চাইছে?
লালাখাল যেন আমাদের শেখায়নীরবতাই অনেক সময় সবচেয়ে গভীর ভাষা।
আজ তুমি এই গল্পটা পড়লে। কিন্তু ভাবো তোআমাদের দেশেই এমন কত জায়গা আছে যাদের গল্প এখনো কেউ শোনেনি?
তুমি কী কখনো এমন কোনো নদীর ধারে দাঁড়িয়ে থেকেছো যার জল শুধু বইছিল নাতোমার দৃষ্টিকে কোথাও ডুবিয়ে দিচ্ছিল?
🌟 তোমার চোখে লালাখাল কেমন মনে হলো? এমন অন্য কোন রহস্যময় জায়গায় তুমি গিয়েছো কি?
👇 কমেন্টে লিখো তোমার অনুভূতি। তোমার মতামত আর অভিজ্ঞতা জানাওহয়তো তা কাউকে নতুন এক গন্তব্যের পথ দেখাবে!
📤 এই লেখাটি যদি তোমার ভালো লেগে থাকে তবে বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করো। কে জানে হয়তো কারও জীবনের সবচেয়ে গভীর অনুভূতিটা অপেক্ষা করছে লালাখালের নীল জলের ধারে...
লালাখাল ভ্রমণ, সিলেট ট্যুর, সারী নদী, বাংলাদেশের সুন্দর জায়গা, রহস্যময় ভ্রমণ, নীল জলের নদী, ভ্রমণ ব্লগ বাংলা।
🌸 আপনার মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ!
আপনার মতামত আমাদের অনুপ্রাণিত করে এবং আগামীতে আরও মানসম্পন্ন কনটেন্ট তৈরিতে সহায়তা করে।
আপনি যদি কোনো নির্দিষ্ট বিষয় বা গল্প পছন্দ করে থাকেন, জানালে ভালো লাগবে।
নিয়মিত পাশে থাকুন — আপনার সহযোগিতা ও ভালোবাসাই আমাদের এগিয়ে চলার শক্তি।
শুভ কামনায়,
✍️ কল্পকথা-৩৬০ ব্লগ টিম
https://kalpakatha360.blogspot.com