একটা সময় ছিল, যখন এই ভূখণ্ড রক্তে রাঙিয়ে জেগে উঠেছিল স্বাধীনতার জন্য, সাম্যের জন্য, মানুষের মৌলিক অধিকার আদায়ের জন্য। একাত্তরের সেই লাল-সবুজ স্বপ্ন কি আজও অমলিন? নাকি সময়ের প্রলেপে তা শুধু ইতিহাসের পৃষ্ঠায় ঠাঁই নিয়েছে?
আজ আমরা গর্ব করি উন্নয়ন দিয়ে, শহরের বুক চিরে দৌড়ায় মেট্রোরেল, উড়ালপথে ছুটে চলে গাড়ির স্রোত, ঝাঁ চকচকে শপিং মল গজিয়ে উঠছে রাতারাতি। কিন্তু এই উজ্জ্বল ছবির আড়ালে রয়েছে এক অবর্ণনীয় অন্ধকার, যা হয়তো ক্যামেরায় ধরা পড়ে না, সংবাদেও আসে না। একদিকে যখন অর্থনীতির পরিসংখ্যান চূড়ায় পৌঁছায়, অন্যদিকে তখন পোশাকশ্রমিক নারী নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, পাহাড়ে বসবাসকারী আদিবাসী তার পরিচয় হারায়, আর শহরের কোনায় কোনায় বেড়ে ওঠে এক অব্যক্ত বঞ্চনার প্রাচীর।
কে যেন বলে বাংলাদেশ বদলেছে।
হ্যাঁ, বদলেছে।
কিন্তু বদলটা কি সবাইকে ছুঁয়ে গেছে?
রিকশাচালক যখন তার ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠাতে পারে না,
তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ যখন পরিচয়ের স্বীকৃতি থেকেও বঞ্চিত,
সংখ্যালঘু যখন নিজের উপাসনালয়ে নিরাপদ নয়,
কর্মজীবী নারী যখন দিনের পর দিন হয়রানির শিকার হয়ে ঘরে ফেরে
তখন উন্নয়ন কাকে বলে, সেটাই প্রশ্ন।
আর এই প্রশ্নই হলো আজকের লেখার কেন্দ্রে।
এটি শুধু একটি কবিতা নয়,
এটি একটি চিৎকার নিঃশব্দদের হয়ে, যারা বলার সুযোগ পায় না।
এটি একটি দর্পণ যেখানে আমরা নিজেদের মুখোমুখি হই,
আর দেখি সেই বাংলাদেশ,
যেটা হয়তো আমরা গড়তে চেয়েছিলাম, কিন্তু হারিয়ে ফেলেছি নানা বিভেদের গলিপথে।
পাঠক, তুমি যদি এই লেখার শেষে একটু থেমে ভাবো,
তবে বুঝব, শব্দগুলো বৃথা গেল না।
কারণ এই ভাবনাই একদিন রচনা করতে পারে
একটি সত্যিকারের সাম্যের বাংলাদেশ
যেখানে কেউ পিছিয়ে থাকবে না,
যেখানে বর্ণ, লিঙ্গ, পেশা বা পরিচয়ে নয়,
মানবতায় লেখা হবে সকলের পরিচয়।
একাত্তরের ভেজা মাটি বুকে নিয়ে জেগেছিল যে জাতি,
তার স্বপ্নেরা আজো কাঁদে, দ্বিধান্বিত এক দিবারাতি।
প্রতিশ্রুতি ছিল সাম্যের, থাকবে না কোনো ভেদাভেদ,
আজো কেন কানে বাজে, শুধু বঞ্চনার করুণ খেদ?
সংবিধানের পাতায় লেখা সোনার অক্ষরে যে সাম্য,
বাস্তবতার রুক্ষ পথে, সে যেন এক গভীর আলেখ্য।
মেট্রোরেলের ঝকঝকে কাঁচের ওপাশে ঝাপসা বস্তি,
উন্নয়নের মহাসড়ক কার রক্তে রাঙা? এ কেমন স্বস্তি!
পোশাকের চাকচিক্য ঢেকে দেয় নারী শ্রমিকের দীর্ঘশ্বাস,
বৈদেশিক মুদ্রার আড়ালে জমে অব্যক্ত এক ক্ষোভের ত্রাস।
ন্যূনতম মজুরির দাবি রাজপথে তোলে প্রতিবাদের সুর,
ডিজিটাল যুগেও তাদের জীবন কেন এত অসুর?
নিরাপত্তার চাদর ছিঁড়ে হাতছানি আসে কালো ছায়ার মতো,
কর্মজীবী নারীর স্বপ্ন ভাঙে, হৃদয়ে জমা হয় শত ক্ষত।
আর তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, যেন সমাজের পরিত্যক্ত দ্বীপ,
পরিচয়ের স্বীকৃতিটুকুও জ্বালায় যেন নিয়তির টিপ।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আশ্রয় সবই যেন সুদূর আকাশ,
অস্তিত্বের সংগ্রামে তাদের প্রতিটি মুহূর্ত এক দীর্ঘ উপবাস।
চাকমা, মারমা, সাঁওতালের সবুজ পাহাড়ে নামে লোভের ধস,
নিজের ভূমিতেই তারা পরবাসী, জীবনে নেই কোনো রস।
শান্তিচুক্তির অক্ষরগুলো বিবর্ণ হয় অবহেলায়,
আদিবাসী সত্তার কান্না মেশে পাহাড়ের কুয়াশায়।
মন্দিরের ঘণ্টা স্তব্ধ হয়, ভেঙে পড়ে বিশ্বাসের ভিত,
সংখ্যালঘুর অসহায় আর্তনাদে ভারী হয় চারদিক।
আইনের চোখে ধনী-গরিবের ফারাক আকাশ-পাতাল,
ক্ষমতার দাপটে সত্য পরাজিত, ন্যায়বিচারও বেসামাল।
অগম্য ফুটপাত, উঁচু দালান প্রতিবন্ধী মানুষের চোখে ধাঁধা,
ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন তাদের জন্য কঠিন এক বাধা।
আর গৃহকর্মীর অদৃশ্য শ্রমে চলে নীরব শোষণ,
আইনের বাইরে তাদের জীবন, কে করবে এর পোষণ?
রিকশাচালক, ঝাড়ুদার, জেলে শ্রমেরই ভিন্ন নাম,
তবু পেশার বৈষম্যে এই সমাজে বিকোয় তাদের ঘাম।
ক্ষমতার অলিন্দে জন্ম নেওয়া সন্তানেরা পায় ভিন্ন মিউ ,
সাধারণের সন্তানের জন্য শুধু বঞ্চনার ঢেউ।
সাইবার আইনে কণ্ঠ রোধ, ভিন্নমতের বুকে ভয়,
বাকস্বাধীনতার এই দ্বন্দ্বে গণতন্ত্রের হয় ক্ষয়।
তবুও এই ধূসর ক্যানভাসে ফোটে বিদ্রোহের ফুল,
ছাত্র-জনতার মিছিলে ভাঙে আধিপত্যের ভুল।
বঞ্চনার দেয়াল ভেঙে নতুন দিনের স্বপ্ন বোনে,
এক নতুন প্রত্যয়ের গান বাজে এই বাংলার কোণে।
আশা আজো মরে নাই, নিভে নাই স্বপ্নের শিখা,
প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মাঝে একদিন ঘুচবে এই বিভেদ রেখা।
রক্তে কেনা এই বাংলায় নামুক সাম্যের ভোর,
যেখানে সবার গল্প লেখা হবে, ভাঙবে সব আধার-ঘোর।
ঢাকার কোনো এক অভিজাত এলাকার কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ের জমকালো আয়োজন। ঝলমলে আলো, দামী খাবারের সুবাস আর পরিচিত মুখের ভিড়ে এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছেন বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আরিফ সাহেব। পুরনো এক বন্ধুর সাথে দেখা হতেই কুশল বিনিময়ের পর যে প্রশ্নটি অবধারিতভাবে এলো, তা হলো "কী করছ আজকাল? কোন পদে আছ? গাড়িটা বদলালে?"
এই একটি মামুলি প্রশ্ন, অথচ এর গভীরে লুকিয়ে আছে আমাদের সামাজিক অস্তিত্বের এক গভীর সংকট। এই সংকট হলো ‘মর্যাদা’ টিকিয়ে রাখার বা বাড়ানোর এক অদৃশ্য, অন্তহীন প্রতিযোগিতা। একে নিছক সামাজিক চাপ বললে ভুল হবে, এটি এখন আমাদের অনেকের মনে একধরনের ‘বিভ্রাট’ বা অস্থিরতা তৈরি করেছে। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত এই মর্যাদা বিভ্রাট আমাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে এক আলেয়ার পেছনে, যার শেষ কোথায়, তা আমরা কেউই জানি না।
শহরকেন্দ্রিক জীবন এখন অনেকটাই সংখ্যা আর বাহ্যিকতার নিরিখে মাপা হয়। আপনার সামাজিক মর্যাদা নির্ভর করে আপনি ঢাকার কোন এলাকায় থাকেন, আপনার সন্তানেরা কোন বিদ্যালয়ে পড়ে, আপনার গাড়ির মডেল কোনটি, কিংবা ছুটিতে আপনি দেশের ভেতরে ঘুরতে যান নাকি বিদেশে এইসব সূচকের ওপর।
রাজধানীর একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা রায়হান সাহেবের কথাই ধরা যাক। তিনি তার সন্তানের জন্য শহরের নামকরা একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তির সুযোগ পাননি। এই ঘটনা তাঁর রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। তাঁর কাছে এটি কেবল সন্তানের লেখাপড়ার বিষয় নয়, বরং সামাজিক বৃত্তে তাঁর পরিবারের ‘স্ট্যাটাস’ বা মর্যাদার প্রশ্ন। বন্ধুদের আড্ডায় বা পারিবারিক অনুষ্ঠানে তিনি এখন কিছুটা গুটিয়ে থাকেন, কারণ সন্তানের ভালো স্কুলে না পড়াটা তাঁর কাছে এক ধরনের ব্যক্তিগত পরাজয়।
এই পরাজয়বোধ কেবল রায়হান সাহেবের একার নয়। এটি এখন মধ্যবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর এক সাধারণ মানসিক পীড়ন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দৌলতে এই প্রতিযোগিতা পেয়েছে এক নতুন মাত্রা। অন্যের সফলতার চাকচিক্যময় প্রদর্শনী দেখে নিজের জীবনকে অর্থহীন মনে হওয়াটা এখন খুবই স্বাভাবিক একটি ঘটনা। দামী রেস্তোরাঁর খাবারের ছবি, বিদেশে অবকাশ যাপনের মুহূর্ত কিংবা নতুন কেনা ফ্ল্যাটের দলিল এই সবকিছুই যেন অন্যের জীবনে সাফল্যের বিজ্ঞাপন। আর সেই বিজ্ঞাপনের দর্শকাসনে বসে আমরা নিজেদের বিচার করি, মাপি এবং প্রায়শই হতাশ হই। এই ডিজিটাল দেয়াল আমাদের একে অপরের থেকে মানসিকভাবে আরও বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে, আর বাড়িয়ে তুলছে একাকিত্ব ও বিষণ্ণতা।
তরুণ প্রজন্মের ওপর এই চাপ আরও ভয়ংকর। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোনোর আগেই ‘কোন ধরনের চাকরি পেলে সমাজে মুখ দেখানো যাবে’ এই ভাবনা তাদের স্বাভাবিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে। সরকারি চাকরি, বিশেষত বিসিএস ক্যাডার হওয়ার দৌড়ে যে বিপুল সংখ্যক তরুণ-তরুণী অংশ নিচ্ছেন, তার পেছনে কেবল স্থিতিশীল ভবিষ্যতের আকাঙ্ক্ষা নয়, বরং ‘প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড কর্মকর্তা’ হিসেবে সমাজে যে বিশেষ মর্যাদা পাওয়া যায়, সেই মোহও প্রবলভাবে কাজ করে। যারা এই দৌড়ে পিছিয়ে পড়েন, তাদের অনেকের মনেই গভীর হীনম্মন্যতা জন্মায়, যা তাদের বাকি কর্মজীবনের ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে।
ভাবাটা ভুল হবে যে, এই মর্যাদা বিভ্রাট কেবল শহরের উঁচু দালানেই সীমাবদ্ধ। এর ঢেউ এখন আছড়ে পড়ছে গ্রামের শান্ত জীবনেও। তবে সেখানে এর প্রকাশ এবং কারণ ভিন্ন।
সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার একটি গ্রামের বাসিন্দা হাশেম মিয়া। প্রায় পনেরো বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যে শ্রম দিচ্ছেন। তাঁর পাঠানো টাকায় গ্রামে একতলা দালান উঠেছে, বোনদের বিয়ে দিয়েছেন, পরিবারের কৃষিজমিও কিনেছেন। গ্রামে তাঁর পরিবার এখন বেশ সম্মানিত। প্রতি ঈদে তিনি যখন বাড়ি ফেরেন, তখন তাঁর জন্য যে খাতির-যত্ন করা হয়, তা গ্রামের অন্য অনেকের জন্যই ঈর্ষার কারণ।
কিন্তু এই মর্যাদার পেছনে লুকিয়ে আছে হাশেম মিয়ার অমানবিক পরিশ্রম আর নিঃসঙ্গতার গল্প। মরুভূমির বুকে হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে তিনি যে অর্থ পাঠান, তা দিয়ে কেনা হয় পরিবারের সম্মান। তাঁর নিজের ভালো থাকা, নিজের স্বপ্ন বা আকাঙ্ক্ষার চেয়ে পরিবারের ‘সামাজিক মর্যাদা’ রক্ষা করাটাই তাঁর কাছে মুখ্য হয়ে ওঠে। তিনি যদি দালানবাড়ি করতে না পারতেন, বা প্রতিবেশীর চেয়ে ভালো কোরবানি দিতে না পারতেন, তবে তাঁর প্রবাস জীবনকেই অর্থহীন মনে করা হতো।
অন্যদিকে, গ্রামীণ জীবনে কৃষির মতো মৌলিক পেশার প্রতি সম্মান দিন দিন কমছে। একজন কৃষক এখন চান না, তাঁর সন্তানও কৃষিকাজ করুক। তিনি মনে করেন, কৃষিকাজ করে সমাজে ‘মর্যাদা’ পাওয়া যায় না। এর চেয়ে শহরে গিয়ে একটি পোশাক কারখানায় কাজ করা বা ছোটখাটো ব্যবসা করাও ভালো। ফলস্বরূপ, গ্রামের পর গ্রাম তরুণশূন্য হয়ে পড়ছে। কৃষির মতো একটি মহান পেশা তার উত্তরাধিকার হারাচ্ছে শুধু সামাজিক মর্যাদার ভ্রান্ত ধারণার কারণে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে এখন মর্যাদা মানে গ্রামের সাথে সংযোগ ছিন্ন করে শহুরে জীবনের যেকোনো একটি অংশ হয়ে ওঠা, তা যতই কষ্টসাধ্য হোক না কেন।
আমাদের এই সামাজিক ব্যাধির শেকড় প্রোথিত আছে অনেক গভীরে। এর পেছনে ঔপনিবেশিক মানসিকতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের মতো একাধিক কারণ জড়িত।
১. ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার: ব্রিটিশ আমলে তৈরি করা ‘বাবু’ বা কেরানি সংস্কৃতি আমাদের মজ্জাগত হয়ে গেছে। আমরা কায়িক শ্রমের চেয়ে ‘ডেস্ক জব’ বা চেয়ারে বসে করার কাজকে বেশি সম্মানের বলে মনে করি। একজন কৃষক বা শ্রমিকের চেয়ে একজন অফিস সহকারীর সামাজিক মর্যাদা আমাদের কাছে বেশি। এই মানসিকতা আজও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও সামাজিক মূল্যবোধকে নিয়ন্ত্রণ করে।
২. অর্থনৈতিক বৈষম্য: গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে একটি নতুন ধনী শ্রেণী তৈরি হয়েছে, যাদের জীবনযাপন এবং ভোগবিলাস সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। এই শ্রেণীর সাথে নিজেদের তুলনা করে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের মনে একধরনের অতৃপ্তি ও আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। আকাশচুম্বী বৈষম্যই মূলত এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার মূল চালিকাশক্তি।
৩. সামাজিক বন্ধনের অবক্ষয়: পূর্বে সামাজিক মর্যাদা অনেকাংশে নির্ভর করত সততা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা বা পারিবারিক ঐতিহ্যের ওপর। কিন্তু এখন ব্যক্তির বিচার হয় তার আর্থিক সামর্থ্য বা পেশাগত পদবি দিয়ে। যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার হওয়ায় এবং প্রতিবেশীদের মধ্যে আত্মিক সম্পর্ক কমে যাওয়ায়, মানুষ এখন বাহ্যিক স্বীকৃতির ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
এই অন্তহীন দৌড় থেকে মুক্তির উপায় কী? এই বিভ্রাট থেকে বেরিয়ে আসার পথটি কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন স্বতন্ত্র ও সামাজিক পর্যায়ের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।
প্রথমত, আমাদের সাফল্যের সংজ্ঞা বদলাতে হবে। অন্যের চোখে বড় হওয়ার চেয়ে নিজের কাছে সৎ থাকা, নিজের কাজ নিয়ে তৃপ্ত থাকা এই অনুভূতিকে গুরুত্ব দিতে হবে। যে কোনো পেশার প্রতি সম্মান দেখানো এবং শ্রমের মর্যাদাকে স্বীকৃতি দেওয়াটা সামাজিক আন্দোলনের মতোই ছড়িয়ে দিতে হবে। একজন সৎ রিকশাচালক বা একজন দক্ষ কারিগর সমাজের জন্য ততটাই গুরুত্বপূর্ণ, যতটা একজন ব্যাংকার বা প্রকৌশলী। এই বোধটি পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিশুদের মনে বীজ বপণ করে দিতে হবে।
দ্বিতীয়ত, নিজের জীবনের লাগাম নিজের হাতে নিতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অন্যের জীবনের সেরা মুহূর্তগুলোর সাথে নিজের সাধারণ দিনগুলোর তুলনা করা বন্ধ করতে হবে। বুঝতে হবে, পর্দার ওপারের জীবন আর বাস্তবতার মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া এবং প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়াটাও জরুরি।
সবশেষে, আমাদের একটি সহানুভূতিশীল সমাজ গঠন করতে হবে, যেখানে মানুষকে তার ব্যাংক ব্যালেন্স বা পদবি দিয়ে বিচার করা হবে না, বরং তার মানবিক গুণাবলি, সততা এবং সামাজিক অবদানের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হবে।
‘মর্যাদা’ শব্দটি আসুক ‘আত্মমর্যাদা’ থেকে। যে মর্যাদা ধার করা বা লোক দেখানো নয়, বরং নিজের ভেতর থেকে অর্জিত। যেদিন আমরা অন্যের নির্ধারিত ছকে নিজেদের জীবনকে না মেপে, নিজের শর্তে বাঁচার সাহস অর্জন করব, সেদিনই এই ক্লান্তিহীন দৌড় থামবে এবং আমরা এক সুস্থ, সুন্দর ও মানবিক সমাজের দিকে এগিয়ে যেতে পারব।
সব দেখে-শুনে প্রশ্ন আসে এই কি সেই বাংলাদেশ,
যে দেশের জন্ম হয়েছিল বঞ্চনার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে?
যেখানে মানুষ শুধু নাগরিক নয়,
একটা জাতিসত্তার গর্বিত উত্তরাধিকার?
আমরা কী করে এত অচেনা হয়ে উঠলাম নিজেদের কাছেই?
আজ যারা মাথা উঁচু করে হাঁটে, তারা কি একদিন ভুলে যাবে
কারা কাঁধে নিয়েছিল দেশ গড়ার প্রথম ইট?
যারা হারায়, তারা শুধু পরিসংখ্যানে থাকে না
তাদের কান্না মিশে থাকে বাতাসে,
তাদের নিঃশব্দ প্রতিবাদ জেগে থাকে প্রতিটি ইট-পাথরে।
এই সমাজে যদি কিছু মানুষ অদৃশ্য থাকে,
বাকিদের দেখা হয়ে ওঠে ভানমাত্র।
এভাবে কি চলে একটা দেশ?
না কি এভাবেই ধীরে ধীরে নিভে যায় এক সময়ের দীপ্ত শপথ?
তবুও, অন্ধকারের গভীরেও একটা আলোর রেখা থাকে।
প্রত্যেক প্রশ্নই সম্ভাবনার সূচনা।
প্রত্যেক প্রতিচ্ছবি নতুন ভাবনার দিশা দেখায়।
তুমি যদি আজ থেমে একটুখানি ভেবে দেখো
এই লেখার প্রতিটি পঙক্তি কি সত্যিই কারো না কারো জীবনের প্রতিচ্ছবি নয়?
তবে এই লেখার আসল কাজটা সার্থক।
তুমি কি দেখেছো নিজেকে এই আয়নায়?
তুমি কি চাও না, এমন একটি বাংলাদেশ
যেখানে কারো পরিচয় হবে না তার সীমাবদ্ধতায়,
বরং তার মানবতায়?
👉 তোমার ভাবনা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
এই লেখাটি যদি তোমার হৃদয় ছুঁয়ে যায়,
তবে একবার নিজের মতো করে মতামত জানাও।
শেয়ার করো যাতে অন্যরাও ভাবতে পারে,
অনুভব করতে পারে, প্রশ্ন তুলতে পারে।
কারণ পরিবর্তন শুরু হয় একটিমাত্র প্রশ্ন থেকে।
তুমি কি সেই প্রশ্নের জন্মদাতা হতে প্রস্তুত?
বাংলাদেশ, সাম্য, বঞ্চনা, সামাজিক বৈষম্য, মানবাধিকার, উন্নয়ন, কবিতা, প্রতিবাদ, নারীর অধিকার, আদিবাসী, গণতন্ত্র, শ্রমজীবী
🌸 আপনার মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ!
আপনার মতামত আমাদের অনুপ্রাণিত করে এবং আগামীতে আরও মানসম্পন্ন কনটেন্ট তৈরিতে সহায়তা করে।
আপনি যদি কোনো নির্দিষ্ট বিষয় বা গল্প পছন্দ করে থাকেন, জানালে ভালো লাগবে।
নিয়মিত পাশে থাকুন — আপনার সহযোগিতা ও ভালোবাসাই আমাদের এগিয়ে চলার শক্তি।
শুভ কামনায়,
✍️ কল্পকথা-৩৬০ ব্লগ টিম
https://kalpakatha360.blogspot.com