এক সময় সন্ধ্যা নামলেই গ্রামবাংলার উঠোনে শোনা যেত শিশুর হাসির কলরব, কুপি কিংবা হারিকেনের আলোয় বইয়ের পাতায় ডুবে থাকা কিশোরের গুনগুন। ঘরে ফিরে বাবার দৃঢ় কণ্ঠস্বর, মায়ের নরম বকুনি আর দাদির গল্পের আসর এসবই ছিল আমাদের শেকড়ের উর্বর মাটি। সেই শেকড়েই ছিল নিরাপত্তা, ভালোবাসা আর ভবিষ্যতের স্বপ্ন।
কিন্তু আজকের সমাজ যেন এক উল্টোপথের যাত্রী। খবরের কাগজের পাতায় প্রতিদিন ভেসে আসে এমন সব গল্প, যা শুনলে হৃদয় কেঁপে ওঠে। যে ঘর ছিল আশ্রয়, সেখানে আজ রক্ত ঝরছে। যে সম্পর্ক ছিল ঈশ্বরতুল্য, সেখানে বিষ ছড়াচ্ছে অবিশ্বাস ও হিংসা। এক সময়কার ছায়াঘেরা বটবৃক্ষ আজ ভেঙে পড়ছে টুকরো টুকরো হয়ে, আর তার নিচে দাঁড়িয়ে আমাদের সন্তানরা দিশাহারা হয়ে তাকিয়ে আছে “আমরা কোথায় যাব?”
এই ছিঁড়ে যাওয়া শেকড় শুধু পরিবারকেই নষ্ট করছে না, ধীরে ধীরে সমাজের ভেতর থেকে মানুষ হওয়ার ভিত্তিটাই উপড়ে ফেলছে। আর প্রশ্নটা থেকে যাচ্ছে এই পথচলার শেষ কোথায়?
যে শেকড় ছিঁড়ে যাচ্ছে: পরিবার, সমাজ এবং আমাদের সন্তানেরা কোথায় দাঁড়াবে?
একটা সময় ছিল, যখন কুপি বা হারিকেনের আলো জ্বলে ওঠার আগেই পাড়ার শিশু-কিশোরদের কোলাহল থেমে যেত। প্রতিটি ঘর থেকে ভেসে আসত পড়ার সুর কিংবা মায়ের নরম বকুনির শব্দ। বাবা ছিলেন বাড়ির অঘোষিত বটবৃক্ষ, যার ছায়ায় আশ্রয় নিত পুরো পরিবার। মা ছিলেন ভালোবাসার সেই অফুরন্ত ঝর্ণাধারা, যাঁর স্নেহে ভিজে যেত সব অভিমান। সেই স্মৃতিগুলো এখন ধূসর ক্যানভাসে আঁকা ছবির মতো মনে হয়।
আজকের সংবাদপত্রের পাতা খুলতেই যে বীভৎস চিত্র আমাদের সামনে আসে, তা শুধু আমাদের ব্যথিত করে না, বরং আমাদের অস্তিত্বের গভীরে গিয়ে আঘাত করে। যে সমাজে পিতা-মাতার স্থান ছিল মহান আল্লাহর পরে, সেখানে আজ রক্তের দাগ লাগছে সম্পর্কের আঙিনায়।
সংবাদপত্রের পাতাগুলো আজ আর কেবল অক্ষরের সমষ্টি নয়, বরং তা যেন আমাদের সমাজের গভীরে চলতে থাকা নীরব রক্তক্ষরণের জীবন্ত দলিল। যে সম্পর্কগুলো ছিল জীবনের মহীরুহ, যার ছায়ায় আমরা খুঁজে পেতাম আশ্রয়, আজ সেই মহীরুহের শিখর থেকেই খসে পড়ছে বিশ্বাসের একেকটি পাতা। আপনজনেরাই যখন অচেনা আগন্তুকের চেয়েও বেশি পর হয়ে যায়, তখন পায়ের নিচের মাটিটুকুও যেন অতল গহ্বরে মিলিয়ে যায়। এই শিরোনামগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন আঁধারের গল্প নয়, এ আমাদের আত্মার ক্ষয়িষ্ণু আয়নায় ভেসে ওঠা এক একটি ভাঙা প্রতিবিম্ব।
প্রথমে ভাবুন সেই সন্তানের কথা, যার হাতে সামান্য মাটির জন্য জন্মদাতা পিতার শোণিত লাগে। মনে করুন, উত্তরের কোনো এক গ্রামের কৃষক হাশেম উদ্দিনের কথা। সারাজীবন গায়ের ঘাম পায়ে ফেলে তিনি পাঁচ বিঘা জমি করেছিলেন। ভেবেছিলেন, শেষ বয়সে এই জমিটুকুই হবে তার ও তার বৃদ্ধা স্ত্রীর সম্বল। কিন্তু তার ছোট ছেলে শহরে থেকে শিখে আসা লোভের বশবর্তী হয়ে সেই জমি নিজের নামে লিখে দেওয়ার জন্য বাবাকে চাপ দিতে শুরু করে। হাশেম উদ্দিন রাজি না হওয়ায়, এক অমাবস্যার রাতে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে সেই ছেলেই কুঠারের আঘাতে বাবার নিথর দেহ ফেলে রাখে উঠোনের কোণে। যে পিতা একদিন কচি আঙুল ধরে পৃথিবীর পথে চলতে শিখিয়েছিলেন, তিনিই আজ সন্তানের হাতে চিরঅন্ধকারের যাত্রী হন। পার্থিব সম্পদের মোহে মানবতা আজ এতটাই দেউলিয়া যে, রক্তের বন্ধনের চেয়ে জমির দলিলের ওজন বেশি হয়ে উঠেছে।
এবার দৃষ্টি ফেরানো যাক সেই কন্যার দিকে, যার কাছে বাবা ছিলেন প্রথম নায়ক, আস্থার হিমালয়। মফস্বলের এক শান্ত পাড়ায় বেড়ে ওঠা কিশোরী মেয়েটির পৃথিবী ছিল তার বাবাকে ঘিরেই। বাবা ফিরলে তবেই তার নাওয়া-খাওয়া, বাবার কাছেই তার সকল আবদার। সেই বাবাই যখন এক নির্জন দুপুরে তার পবিত্রতাকে গ্রাস করে, তখন মেয়েটির বিশ্বাসের আকাশ এক মুহূর্তে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। এ আঘাত কেবল শরীরের উপর নয়, এ হলো তার আস্থা, স্বপ্ন আর ভবিষ্যতের এক নির্মম হত্যাকাণ্ড। যাকে সে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আশ্রয় ভেবেছিল, তার কাছ থেকে পাওয়া এই বিষাক্ত ছোবল মেয়েটির আত্মার ঝর্ণাকে চিরদিনের জন্য বিষিয়ে দেয়। সে এখন জীবন্ত থেকেও যেন এক মৃতপ্রায় সত্তা, যার পৃথিবীর আর কোনো সম্পর্কের উপর আস্থা রাখার সাহস নেই।
একবার কল্পনা করুন সেই জননীর মুখ, যিনি তার নাড়িছেঁড়া ধনকে নিজ হাতে অনন্তের পথে পাঠিয়ে দেন। ঢাকার কোনো এক বস্তিতে থাকা পোশাককর্মী আমেনার গল্পটা ভাবুন। স্বামীহারা আমেনা তার একমাত্র পঙ্গু সন্তানকে নিয়েই বেঁচে ছিল। হঠাৎ কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তার আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যায়। কয়েকদিন না খেয়ে থাকার পর, সন্তানের ক্ষুধার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে, তার চিকিৎসার খরচ জোগাতে না পেরে, এক বর্ষার রাতে তিনি সন্তানকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বিষ তুলে দেন তার মুখে, নিজেও পান করেন। তিনি ভেবেছিলেন, এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে ধুঁকে ধুঁকে মরার চেয়ে অনন্তের ঘুমই হয়তো তার সন্তানের জন্য শ্রেয়। দারিদ্র্যের কষাঘাত আর সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা যখন একজন মাকে এই অতল অন্ধকারে ঠেলে দেয়, তখন বুঝতে হবে এ কেবল একজন মায়ের পরাজয় নয়, এ আমাদের সমগ্র সমাজ ব্যবস্থার দেউলিয়াপনা।
শৈশবের দিনগুলোতে মামার বাড়ি, খালার বাড়ি ছিল যেন একখণ্ড স্বর্গ। কিন্তু সেই নিরাপদ আশ্রয়ও যখন বিভীষিকার নামান্তর হয়, তখন বিশ্বাস শব্দটিই তার সকল অর্থ হারিয়ে ফেলে। গ্রামের বাড়ি থেকে শহরে চাচার বাসায় পড়তে আসা দুই ভাইবোনের কথা ভাবুন। বাবা-মা নিশ্চিন্ত ছিলেন, নিজের ভাইয়ের কাছে তাদের সন্তানেরা নিরাপদে থাকবে। কিন্তু সেই চাচাই রাতের আঁধারে শিশুটির শৈশবকে কলুষিত করে। ভয়ে, লজ্জায় শিশুটি পাথর হয়ে যায়, তার মনের গভীরে বয়ে চলা রক্তক্ষরণ কেউ দেখতে পায় না। এই ক্ষত তাদের স্বাভাবিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে, সারাজীবনের জন্য তাদের কপালে এক গভীর বিষাদের রেখা এঁকে দেয়।
শুধু তাই নয়, ভাইবোনের সম্পর্কও আজ স্বার্থের বেড়াজালে আবদ্ধ। বৃদ্ধা মায়ের সেবাযত্ন বা চিকিৎসার ভার কে নেবে, তা নিয়ে ভাইদের মধ্যে চলে রশি টানাটানি। মাকে এক ভাই আরেক ভাইয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়, যেন তিনি কোনো অপ্রয়োজনীয় বস্তু। এই অবহেলা আর অনাদরে বৃদ্ধা মা নিজের বাড়িতেই পরবাসী হয়ে যান, নীরবে চোখের জল ফেলেন।
এই সকল বিচ্ছিন্ন ঘটনার গভীরে লুকিয়ে আছে একই সংকট মূল্যবোধের অবক্ষয়, নৈতিক শিক্ষার অভাব আর লাগামহীন আত্মকেন্দ্রিকতা। আমরা একে অপরের থেকে এতটাই দূরে সরে গেছি যে, পাশের মানুষটির আর্তনাদও আমাদের হৃদয়কে স্পর্শ করে না। এই শিরোনামগুলো আসলে আমাদের জন্য এক একটি আয়না, যেখানে আমাদের সমাজেরই প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠছে। এখনই যদি আমরা প্রতিটি ঘরের উনুনে নিভে যাওয়া স্নেহের আগুনকে আবার জ্বালিয়ে না তুলি, একে অপরের প্রতি সহমর্মিতা আর শ্রদ্ধাবোধ জাগিয়ে না তুলি, তবে এই অবক্ষয় আমাদের এক অন্তহীন অন্ধকারের দিকেই নিয়ে যাবে। নইলে একদিন এই বিশ্বাসের সমাধিস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে আমরা দেখব, আমাদের চারপাশে আপন বলে ডাকার মতো আর কেউ অবশিষ্ট নেই।
এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এগুলো আমাদের সমাজের গভীরে ছড়িয়ে পড়া এক নীরব ক্যান্সারের লক্ষণ। এই চিত্রগুলো এক নির্মম সত্যের প্রতিধ্বনি আমরা মানুষ হিসেবে ধীরে ধীরে দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছি। প্রশ্ন একটাই, আমাদের এই যাত্রার শেষ কোথায়?
এই অবক্ষয়ের কারণগুলো আমাদের চারপাশেই ছড়িয়ে আছে। আমরা হয়তো দেখেও দেখছি না, অথবা দেখেও এড়িয়ে যাচ্ছি।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এখন এক অদ্ভুত ইঁদুর দৌড়ের নাম। জিপিএ-৫ আর ভালো চাকরির পেছনে ছুটতে গিয়ে আমরা শিশুদের জীবনবোধ শেখাতে ভুলে গেছি। একজন ছাত্র হয়তো গণিতের জটিল সূত্র সমাধান করতে পারে, কিন্তু বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয়, তা জানে না। পরিবার বা সমাজে তার দায়িত্ব কী, সেই শিক্ষা সে পাচ্ছে না। পারিবারিক বন্ধন, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহনশীলতা এই শব্দগুলো পাঠ্যবইয়ে থাকলেও বাস্তব জীবনে এর কোনো প্রতিফলন নেই। ফলে তৈরি হচ্ছে এক শিক্ষিত কিন্তু আত্মকেন্দ্রিক প্রজন্ম।
"আমার চাই, এবং এখনই চাই" এই মানসিকতা আজ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে এবং বিজ্ঞাপনের ঝলকানিতে আমাদের চাহিদাগুলো আকাশচুম্বী হয়েছে। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা ছড়িয়ে পড়েছে। একজন কৃষক তার পাশের বাড়ির পাকা দালান দেখে নিজের ভিটেমাটি বিক্রি করে দিচ্ছেন। অন্যদিকে, শহরের এক কিশোর তার বন্ধুর দামী স্মার্টফোনের জন্য বাবা-মায়ের ওপর যে মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে, তা একসময় সহিংসতায় রূপ নিচ্ছে। এই প্রতিযোগিতায় সম্পর্কগুলো হয়ে উঠেছে নিছকই স্বার্থের। যেখানে স্বার্থে আঘাত লাগে, সেখানেই জন্ম নেয় হিংসা, ঘৃণা এবং পরিশেষে অপরাধ।
বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে একাকিত্ব এক ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়ায় এবং বাবা-মা উভয়েই কর্মব্যস্ত হওয়ায় সন্তানেরা এক ভার্চুয়াল জগতে আশ্রয় খুঁজছে। এই সুযোগে তাদের গ্রাস করছে মাদক এবং অনিয়ন্ত্রিত অনলাইন কনটেন্ট। পাবজি, ফ্রি-ফায়ারের মতো সহিংস গেম এবং পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতা তাদের মনোজগতে এক বিকৃত প্রভাব ফেলছে। এই বিকৃত মানসিকতা থেকেই জন্ম নিচ্ছে ধর্ষণ, খুন এবং নানা ধরনের পাশবিক অপরাধ। গ্রামের চায়ের দোকানে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইল ফোনে বুঁদ হয়ে থাকা তরুণটিও শহরের ফ্ল্যাটবাড়িতে একা থাকা কিশোরটির মতোই বিপথগামী হচ্ছে।
আমাদের সমাজে আজও ‘মনের অসুখ’ এক লজ্জার বিষয়। শারীরিক অসুস্থতায় আমরা সেরা ডাক্তার খুঁজি, কিন্তু মানসিক সমস্যায় কাউকে কাউন্সেলরের কাছে যেতে বললে তাকে ‘পাগল’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়। হতাশা, বিষণ্ণতা, অ্যাংজাইটি বা বাইপোলার ডিসঅর্ডারের মতো সমস্যাগুলোকে আমরা "বেশি চিন্তা করা" বা "ঈমানের অভাব" বলে উড়িয়ে দিই। ফলে, ভেতরে ভেতরে একজন মানুষ যখন মানসিক যন্ত্রণায় ক্ষয়ে যেতে থাকে, আমরা তা টেরও পাই না। সময়মতো চিকিৎসা না পাওয়ার ফলে এই মানসিক বিকৃতিই একসময় ভয়ঙ্কর অপরাধের জন্ম দেয়।
সমাজটা যেহেতু আমাদের, সমাধানের দায়িত্বও আমাদেরই নিতে হবে। শুধু সমালোচনা নয়, প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ।
পরিবারই শিশুর প্রথম পাঠশালা। প্রতিটি পরিবারে যদি শ্রদ্ধা, সহমর্মিতা, সততা এবং সহনশীলতার চর্চা শুরু হয়, তাহলে সমাজ বদলাতে বাধ্য। রোজ রাতে পরিবারের সবাই মিলে অন্তত দশ মিনিটের জন্য একসাথে বসা সেটা হতে পারে গল্প করা, বই পড়া বা দিনের ভালো-মন্দ ঘটনা নিয়ে আলোচনা করা। এই ছোট অভ্যাসটিই সন্তানের মনে পারিবারিক মূল্যবোধের বীজ বপন করবে।
শুধু পুঁথিগত বিদ্যা নয়, স্কুলগুলোতে মানবিকতা, আত্মসংযম, লিঙ্গ সংবেদনশীলতা এবং ভালো-মন্দ বিচার করার মতো বিষয়গুলোকে বাধ্যতামূলক করা উচিত। ‘মানবতা সপ্তাহ’ বা ‘পরিবার দিবস’ পালনের মাধ্যমে শিশুদের মধ্যে সামাজিক দায়বদ্ধতা তৈরি করা যেতে পারে।
প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এবং নাগরিক কমিউনিটি সেন্টারে মানসিক স্বাস্থ্য সহায়ক কেন্দ্র স্থাপন করা আজ সময়ের দাবি। যেখানে মানুষ পরিচয় গোপন রেখেও বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে পারবে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত, যেন তারা শিক্ষার্থীদের আচরণগত পরিবর্তন দেখে প্রাথমিক কাউন্সেলিং প্রদান করতে পারেন।
প্রতিটি স্কুল বা পাড়ায় এমন একজন শিক্ষক, কাউন্সেলর বা নির্ভরযোগ্য বড় ভাই বা বোন থাকা প্রয়োজন, যার কাছে শিশু-কিশোররা তাদের যেকোনো সমস্যা হোক তা পারিবারিক বা ব্যক্তিগত নির্ভয়ে খুলে বলতে পারবে। এই ‘সুপার লিসেনার’ বা ‘নীরব শ্রোতা’ মডেলটি অনেক তরুণকে বিপথে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে পারে।
প্রিয় সন্তান,
যেদিন তুই প্রথম আমার আঙুল ধরে হাঁটতে শিখেছিলি, সেদিন আমার মনে হয়েছিল পৃথিবীর সব সুখ আমার। আজ তুই বড় হয়েছিস, তোর নিজের জগৎ তৈরি হয়েছে। হয়তো আমার শাসন তোর ভালো লাগে না, আমার ব্যস্ততা তোকে একা করে দেয়। কিন্তু বিশ্বাস কর, রাতের শেষে আমি তোর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবি আমার পুরো পৃথিবীটাই তুই। আমি হয়তো তোর বন্ধু হতে পারিনি, কিন্তু আমি তোর শেকড় হতে চেয়েছি, যা তোকে যেকোনো ঝড়ে আগলে রাখবে। আয়, আমরা আবার কথা বলি। তোর ভেতরের ঝড়টা আমাকে বুঝতে দে।
প্রিয় বাবা-মা,
তোমরা আমাকে মানুষ করতে গিয়ে নিজেদের সব শখ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়েছ, তা আমি জানি। কিন্তু তোমরা কি কখনো আমার ভয়গুলোকে বোঝার চেষ্টা করেছ? আমি পরীক্ষায় খারাপ করলে তোমরা রেগে গেছ, কিন্তু কেন আমার পড়তে ভালো লাগেনি, তা জানতে চাওনি। আমারও কিছু স্বপ্ন ছিল, কিছু বলার ছিল। কিন্তু তোমাদের চুপচাপ গর্জন আর কঠিন চোখের ভাষার ভয়ে আমি সব লুকিয়ে ফেলেছি। আমাকে শুধু একটু শোনার চেষ্টা করো। শাসন আর আদরের মাঝে যে একটা ভালোবাসার সেতু আছে, সেটা তৈরি করো। আমি তোমাদের গর্ব হতে চাই, বোঝা নয়।
প্রিয় সমাজ,
একসময় তুমিই আমাদের শেখাতে, "সবার উপরে মানুষ সত্য"। তোমার ছায়াতেই আমরা নির্ভয়ে বেড়ে উঠতাম। কিন্তু আজ তোমার অলিগলিতে এত ভয় কেন? কেন শিশুরা নিজের ঘরেই নিরাপদ নয়? কেন रिश्तोंর বন্ধন এত ঠুনকো? তুমি কি ভুলে গেছো, বাড়ি মানেই আশ্রয়, পরিবার মানেই ভালোবাসা আর সমাজ মানেই নিরাপত্তা? তুমি কি আর ফিরবে না সেই পুরনো রূপে?
এই অবক্ষয়ের দায় আমাদের সবার। আমরা যদি নিজেদের বদলাতে শুরু করি, তবে সমাজ বদলাতে বাধ্য। আসুন, ভালোবাসা হোক আমাদের নীতির প্রথম পাঠ, শ্রদ্ধা হোক সম্পর্কের মূলধন, আর সহানুভূতি হোক আমাদের নৈতিক শক্তি।
হয়তো একদিন সত্যিই এমন একটি সকাল আসবে, যেদিন খবরের কাগজে কোনো বাবা-মা হত্যার খবর থাকবে না। থাকবে "ছেলের সাফল্যে আজও কাঁদলেন এক গর্বিত পিতা"।
এই স্বপ্নটুকু সত্যি হোক আমাদের সবার সম্মিলিত চেষ্টায়। আমরা যেন আর কোনোদিন ভুলে না যাই, মানুষ হওয়াই আমাদের প্রথম এবং শেষ পরিচয়।
এই বার্তাটি যদি আপনার হৃদয়ে সামান্যতম নাড়া দেয়, তবে অন্তত একজন প্রিয় মানুষকে জড়িয়ে ধরে বলুন "আমি আছি, তোমার পাশে। ভালোবাসি।" ❤️
সমাজের ভাঙা আয়নায় প্রতিদিন আমরা নিজেদের প্রতিচ্ছবি দেখছি, কিন্তু প্রশ্নটা মুখে বলতে ভয় পাচ্ছি আমরা কি এখনো মানুষ আছি? একদিকে প্রযুক্তি, উন্নতি আর জাঁকজমক আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে, অন্যদিকে সম্পর্কের মাটি ক্রমে উর্বরতা হারাচ্ছে। আমরা সন্তানদের হাতে বইয়ের বদলে মোবাইল তুলে দিচ্ছি, অথচ তাদের চোখের ভেতর জমে থাকা শূন্যতাকে দেখতে পাচ্ছি না। আমরা বাবা-মায়ের প্রতি দায়িত্ব ভুলে যাচ্ছি, অথচ সন্তানদের কাছ থেকে নিখুঁত আনুগত্য চাইছি।
একদিন হয়তো আমরা সত্যিই বুঝব ভালোবাসা ছাড়া কোনো সমাজ টিকে থাকে না, শ্রদ্ধা ছাড়া কোনো পরিবার বাঁচে না, আর সহানুভূতি ছাড়া কোনো মানুষ মানুষ হয়ে উঠতে পারে না। কিন্তু তখন হয়তো অনেক দেরি হয়ে যাবে।
তাহলে কি আমরা অপেক্ষা করব সেই দেরির? নাকি আজই একবার সন্তানের কাঁধে হাত রেখে বলব “আমি আছি, তোমার পাশে”? নাকি আজই বৃদ্ধ বাবার দিকে তাকিয়ে বলব “তুমি একা নও”?
শেষ প্রশ্নটা সবার কাছে আমরা কি চাই আমাদের শেকড় ছিঁড়ে গিয়ে সমাজটা একদিন ধুলিসাৎ হয়ে যাক, নাকি চাই আগামী প্রজন্ম আবার নতুন শেকড় গজিয়ে উঠুক ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আর মানবিকতার মাটিতে?
❤️ প্রিয় পাঠক, এই লেখা যদি আপনার হৃদয়ে সামান্যতম নাড়া দেয়, তবে শেয়ার করুন, আলোচনা করুন, মতামত দিন। আপনার একটি শেয়ার হয়তো আরেকটি পরিবারকে নতুন করে ভাবতে শেখাবে, আরেকটি হৃদয়কে মানবিকতার পথে ফেরাবে।
পরিবার ভাঙন, সমাজ অবক্ষয়, সন্তানদের ভবিষ্যৎ, নৈতিক শিক্ষা, মানসিক স্বাস্থ্য, মানবিক মূল্যবোধ, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা।
🌸 আপনার মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ!
আপনার মতামত আমাদের অনুপ্রাণিত করে এবং আগামীতে আরও মানসম্পন্ন কনটেন্ট তৈরিতে সহায়তা করে।
আপনি যদি কোনো নির্দিষ্ট বিষয় বা গল্প পছন্দ করে থাকেন, জানালে ভালো লাগবে।
নিয়মিত পাশে থাকুন — আপনার সহযোগিতা ও ভালোবাসাই আমাদের এগিয়ে চলার শক্তি।
শুভ কামনায়,
✍️ কল্পকথা-৩৬০ ব্লগ টিম
https://kalpakatha360.blogspot.com