আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেনএকজন নির্যাতিতা নারী এক হতাশ তরুণ আর এক ঘুষখোর সরকারি কর্মকর্তাতাদের মধ্যে কী সম্পর্ক থাকতে পারে?
তিনজন আলাদা মানুষ আলাদা পরিস্থিতি আলাদা ব্যথাকিন্তু একটা অদৃশ্য সুতো যেন তাদের সবাইকে এক অন্ধকার বৃত্তে বেঁধে রেখেছে। কেউ একজন কাঁদছে কেউ চিৎকার করছে না বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে সে সুখে আছে আর কেউ নিজের বিবেককে প্রতিদিন একটু একটু করে হত্যা করে নির্বিকারভাবে সিস্টেমকে টিকিয়ে রাখছে।
আমরা এইসব সমস্যাকে আলাদা আলাদা দৃষ্টিতে দেখি। নারী নির্যাতন মানে পারিবারিক সমস্যা বেকারত্ব মানে চাকরি নেই আর দুর্নীতি মানে উঁচু মহলের ব্যাপার। কিন্তু যখন এই তিনটি রক্তচক্ষু একে অপরকে পুষ্টি জোগায় তখন তা পরিণত হয় এক বিষাক্ত ত্রিভুজে যার এক প্রান্তে লুকানো কান্না এক প্রান্তে ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন আর আরেক প্রান্তে সমাজের বিবেকহীনতা।
এই লেখায় আমরা শুধু সংখ্যা বা শিরোনাম নয় মানুষের গল্প শুনব। সেই মানুষ যাদের গল্প হয়তো সংবাদের পাতায় নেই কিন্তু আমাদের সমাজের প্রতিটি কোণে প্রতিধ্বনি তোলে।
আপনি প্রস্তুত তোএই অদৃশ্য বন্ধনের ভিতর ঢুকে দেখতে কীভাবে আমাদের নীরবতা সিস্টেমের ব্যর্থতা আর নৈতিক অবক্ষয় একসাথে বিষাক্ত চক্র তৈরি করছে?
যদি প্রস্তুত থাকেন তাহলে চলুনচোখ বন্ধ নয় খোলা রেখে পড়া শুরু করি। কারণ এ গল্প শুধু কারও না এ গল্প আমাদেরই।
আমাদের সমাজের গভীরে এমন কিছু ক্ষত আছে যা বাইরে থেকে সবসময় দেখা যায় না। আমরা নারী নির্যাতন নিয়ে কথা বলি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হই বেকারত্বের অভিশাপে হতাশ হই। কিন্তু আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি এই তিনটি ভিন্ন চেহারার দৈত্য আসলে একই অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা? এরা একা আসে না বরং একে অপরকে শক্তি জোগায় একে অপরের ছায়ায় বেড়ে ওঠে। এটি একটি বিষাক্ত ত্রিভুজ যার এক কোণে চাপা কান্না অন্য কোণে দীর্ঘশ্বাস আর তৃতীয় কোণে ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন।
চলুন গতানুগতিক পরিসংখ্যান আর সংবাদের বাইরে গিয়ে কয়েকটি সাধারণ মানুষের গল্পে এই অদৃশ্য বাঁধনটাকে খুঁজে দেখি।
সুমনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েও চার দেয়ালের ভেতর বন্দী। তার স্বামী আকাশ একসময় এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভালো চাকরি করত। কিন্তু অর্থনৈতিক মন্দা আর কোম্পানির অভ্যন্তরীণ দুর্নীতির কারণে চাকরিটা চলে যায়। গত এক বছর ধরে আকাশ বেকার। যে হাত দিয়ে সে একসময় সুমনার জন্য উপহার আনত সেই হাতে এখন হতাশার আগুন।
প্রথম প্রথম সব ঠিক ছিল। কিন্তু মাস গড়ানোর সাথে সাথে আকাশের মেজাজ খিটখিটে হতে শুরু করে। সামান্য কথায় চেঁচামেচি এরপর গায়ে হাত তোলা। সুমনা ভাবে মানুষটা তো এমন ছিল না! সে বোঝে এই রাগ তার ওপর নয় এই রাগ নিজের অসহায়ত্বের ওপর সিস্টেমের ওপর। বেকারত্বের যন্ত্রণা আকাশকে ভেতর থেকে এতটা বিষিয়ে তুলেছে যে তার ভেতরের পশুটা আজ জেগে উঠেছে।
অত্যাচার থেকে বাঁচতে আর সংসারে একটু সাহায্য করতে সুমনা নিজেও চাকরির চেষ্টা শুরু করে। কিন্তু সেখানে গিয়ে সে এক নতুন দেয়ালের সম্মুখীন হয়। কয়েকটি ইন্টারভিউতে তাকে শুনতে হয় আপনি তো বিবাহিত বাচ্চা হলে চাকরি ছেড়ে দেবেন না তো? কোথাও আবার ইন্টারভিউ বোর্ডের কোনো সদস্যের কুৎসিত ইঙ্গিতপূর্ণ চাহনি তাকে বুঝিয়ে দেয় যোগ্যতা এখানে একমাত্র মাপকাঠি নয়। সে উপলব্ধি করে নারীর জন্য পৃথিবীটা আরও কঠিন।
একদিন অত্যাচারের মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে সুমনা সিদ্ধান্ত নেয় সে আইনের সাহায্য নেবে। থানায় গিয়ে সে যা দেখল তা তার ভাঙা মনকে আরও ভেঙে দিল। ডিউটি অফিসার তার অভিযোগ দায়সারাভাবে শুনলেন। আড়ালে একজন কনস্টেবল ফিসফিস করে বলল মামলা শক্ত করতে চাইলে কিছু খরচাপাতি তো লাগবেই।
সুমনা স্তব্ধ হয়ে যায়। যে ন্যায়বিচারের আশায় সে এসেছে সেখানেও দুর্নীতির দেয়াল। তার কাছে 'খরচাপাতি' করার মতো টাকা নেই। সে খালি হাতে ফিরে আসে। তার ভাঙা চুড়ির শব্দ আর আকাশের বেকারত্বের দীর্ঘশ্বাস মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। এখানে বেকারত্ব জন্ম দিয়েছে নারী নির্যাতনের আর দুর্নীতি সেই ক্ষতটাকে আরও গভীর করেছে বিচারের পথ বন্ধ করে দিয়েছে।
( বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ২০২৪ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে শুধু ২০২৩ সালেই দেশে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে প্রায় ১৪৮০০টির বেশি। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৭০০ নারী এবং প্রায় ৭৫% ভুক্তভোগী কোনো বিচার পাননি )
আকাশ যার কথা আমরা সুমনার গল্পে শুনেছি সে একজন মেধাবী ছাত্র ছিল। তার সিজিপিএ ঈর্ষণীয়। চাকরির জন্য গত এক বছরে সে অন্তত শত জায়গায় সিভি জমা দিয়েছে। প্রতিবার ইন্টারভিউ বোর্ডে গিয়ে সে একই অভিজ্ঞতার শিকার হয়। তার চেয়ে কম যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীরা চাকরি পেয়ে যায় কারণ তাদের 'শক্তিশালী মামা' বা 'মোটা অঙ্কের ঘুস' দেওয়ার ক্ষমতা আছে।
একবার এক সরকারি চাকরির ভাইভায় তাকে প্রায় বলেই দেওয়া হলো যোগ্যতা তো ভালো কিন্তু সিস্টেম তো বুঝতে হবে। 'সিস্টেম' মানে এখানে দুর্নীতির এক অদৃশ্য জাল। যে জালে আকাশের মতো হাজারো তরুণের স্বপ্ন প্রতিদিন আটকে যায়। তার চোখের সামনে দিয়ে যখন অযোগ্যরা টাকার জোরে চাকরি নিয়ে চলে যায় তখন তার মনে হয় তার এত বছরের পড়াশোনা তার সার্টিফিকেটগুলো যেন এক একটা অর্থহীন কাগজ।
এই বেকারত্ব আকাশকে শুধু আর্থিকভাবে পঙ্গু করেনি মানসিকভাবেও ধ্বংস করে দিয়েছে। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতেও তার লজ্জা হয়। আত্মীয়-স্বজনের অনুষ্ঠানে যাওয়া সে বন্ধ করে দিয়েছে কী করছিস এখন?এই প্রশ্নটা তার কাছে তীরের মতো বিঁধে। সে তার পুরুষত্বের অহংকারকে চূর্ণ হতে দেখে। পরিবারের কাছে সমাজের কাছে সে একজন 'ব্যর্থ' মানুষ। এই ব্যর্থতার গ্লানি আর হতাশা তাকে এমন এক মানুষে পরিণত করেছে যাকে সুমনা আর চিনতে পারে না। তার ভেতরের ক্ষোভ প্রকাশের জায়গা না পেয়ে প্রকাশ পায় তার সবচেয়ে কাছের মানুষটির ওপর।
এখানে দুর্নীতি সরাসরি বেকারত্বের জন্ম দিচ্ছে। আর এই বেকারত্ব থেকে জন্ম নেওয়া হতাশা পারিবারিক সম্পর্কে বিষ ঢেলে দিচ্ছে যা শেষ পর্যন্ত নারী নির্যাতনের মতো অপরাধের পথ খুলে দিচ্ছে।
( বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) ২০২৩ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী দেশের মোট যুব বেকারত্বের হার ১০.৬%। এর মধ্যে স্নাতকোত্তর বা তার বেশি শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের বেকারত্বের হার ৩২% পর্যন্ত )
জনাব রহমান একজন মধ্যম সারির সরকারি কর্মকর্তা। তিনি সৎ থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর দেখলেন এখানে সততা মানে 'সিস্টেমের বাইরে' থাকা। পদোন্নতি ভালো জায়গায় পোস্টিংসবকিছুই নির্ভর করে আপনি কতটা 'উপরি' আয় করতে পারেন তার ওপর। তার ছেলেমেয়েরা ভালো স্কুলে পড়ে পরিবারের চাহিদা মেটাতে তিনিও একসময় স্রোতে গা ভাসান।
তার টেবিলের নিচের ড্রয়ারটা এখন একটা অলিখিত ব্যাংক। আকাশের মতো ছেলেদের আটকে দিয়ে তিনি যখন কোনো অযোগ্য প্রার্থীকে চাকরি দেন তখন তিনি নিজেকে বোঝান আমি একা কী করব? সবাই তো यही করছে। যখন কোনো নির্যাতিতা নারীর ফাইল চাপা পড়ে যায় টাকার চাপে তখন তিনি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেন।
একদিন তার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়ে বাড়ি ফিরে কাঁদতে কাঁদতে বলল এক শিক্ষক তাকে অনৈতিক প্রস্তাব দিয়েছে ভালো নম্বরের বিনিময়ে। সেদিন প্রথম জনাব রহমানের বুকটা কেঁপে ওঠে। তিনি যে দুর্নীতির বীজ বুনছেন সেই বিষবৃক্ষের ফল যে তার নিজের ঘরেও ঢুকতে পারে এটা তিনি কখনো ভাবেননি। তিনি দেখেন তার চারপাশে দুর্নীতির টাকায় গজিয়ে ওঠা দালানকোঠা বিলাসবহুল গাড়ি। তিনি তার সন্তানদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে চান। কিন্তু তিনি কি ভেবে দেখেছেন যে সমাজ তিনি তৈরি করতে সাহায্য করছেন সেই সমাজে তার নিজের মেয়েটিও কি নিরাপদ?
জনাব রহমানরা দুর্নীতির কারিগর। তারা আকাশের মতো যুবকদের বেকারত্বের দিকে ঠেলে দেন এবং সুমনার মতো নারীদের বিচারহীনতার অন্ধকারে ডুবিয়ে দেন। তারা সমাজের ঘুণপোকা যা ভেতর থেকে সবকিছু শেষ করে দেয়।
( ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (TIB)-এর মতে ২০২৩ সালে বাংলাদেশে সরকারি সেবা নিতে গিয়ে প্রায় ৭০% মানুষকে ঘুষ দিতে হয়েছে। বিচারব্যবস্থার ক্ষেত্রেও ৫৬% মানুষ বিশ্বাস করেন যে ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে অর্থ ও প্রভাব ভূমিকা রাখে )
মিতু গ্রামের এক মেধাবী ছাত্রী। এসএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে। তার স্বপ্ন সে ডাক্তার হবে। তার বাবা একজন সামান্য কৃষক যিনি দিনরাত এক করে মেয়ের পড়ার খরচ জোগান। কিন্তু কলেজে ওঠার পর মিতু দেখতে পায় বিশ্বটা বইয়ের পাতার মতো সরল নয়।
তার এলাকার এক প্রভাবশালী নেতার ছেলে কলেজে তাকে নিয়মিত উত্ত্যক্ত করে। মিতু প্রতিবাদ করলে ছেলেটি হুমকি দেয় তার বাবাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেবে। মিতুর বাবা ভয়ে মেয়েকে বলেন মা ওদের সাথে লাগতে যাস না। আমরা গরিব মানুষ। এখানে নারী নির্যাতন ক্ষমতার দাপটে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে।
এরই মধ্যে মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যায়। মিতুর মতো হাজারো মেধাবী ছাত্রছাত্রী দিনরাত পড়াশোনা করেও সুযোগ পায় না। মোটা অঙ্কের টাকায় প্রশ্ন কিনে অযোগ্যরা ডাক্তার হওয়ার পথে এগিয়ে যায়। মিতুর বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন টাকা ছাড়া এ দেশে কিছুই হয় না রে মা। এখানে দুর্নীতি একটি প্রজন্মর স্বপ্নকে হত্যা করে।
মিতুর স্বপ্ন ভেঙে যায়। তার বাবা তাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য পাত্র খুঁজতে শুরু করেন। তিনি ভাবেন মেয়েকে পড়িয়ে কী লাভ? শেষে তো এই নিরাপত্তাহীন সমাজেই থাকতে হবে। মিতুর ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন এখন সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে রান্নাঘরের চার দেয়ালে। সে হয়তো একদিন আকাশের মতো কোনো হতাশ বেকার যুবকের স্ত্রী হবে এবং সুমনার মতো নির্যাতনের শিকার হবে। চক্রটা চলতেই থাকবে।
( ২০২২ ও ২০২৩ সালে দুইবার মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ ওঠে যার তদন্তে দেখা যায় সংগঠিত চক্রের মাধ্যমে টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন আগেই বিক্রি করা হয়। এতে মেধাবীদের প্রবেশ বাধাগ্রস্ত হয় এবং নৈতিকভাবে শিক্ষা ব্যবস্থায় আঘাত লাগে)
চাঁপা কুড়িগ্রামের এক প্রত্যন্ত চর এলাকার মেয়ে। বাবার সঙ্গে ক্ষেত খামারে কাজ করে বড় হয়েছে। লেখাপড়া মাত্র অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত যেতে পেরেছেসেইটুকুই তাদের এলাকায় অনেক বলে ধরা হয়।
তার পরিবার চরম দারিদ্র্যের মধ্যে দিন কাটায়। বাবা সারাদিন পরিশ্রম করেও ঠিকমতো তিন বেলা খেতে পারে না। এমন সময় পাশের গ্রামের এক লোক আসে চাঁপার বাবা-মায়ের কাছে। বলেচাঁপার জন্য ভালো পাত্র পাওয়া গেছে। লোকটি ঢাকায় গার্মেন্টসে কাজ করে ‘ভালো রোজগার করে’ নাকি ‘মেয়ে সুখে থাকবে’।
অভাবের তাড়নায় আর ভাঙা ঘরের দায়ে চাঁপার বিয়ে হয়ে যায় মাত্র ১৫ বছর বয়সে। কিন্তু ঢাকায় গিয়ে চাঁপা বুঝতে পারে সে এক বস্তিতে এসে উঠেছে। ‘ভালো রোজগার’ নামের গল্পটা ছিল মিথ্যে। তার স্বামী কাজ হারিয়ে বহুদিন ধরে বেকার আর সারাক্ষণ মাতাল হয়ে চাঁপার গায়ে হাত তোলে।
চাঁপা পালিয়ে আবার বাড়ি ফেরে। কিন্তু গ্রামে এসে দেখে তার অভিযোগ কেউ শুনতে চায় না। কেউ বলে বউ হয়ে পালায় কেন? কেউ বলে গরিবের মেয়ে এসব কপালে ছিল। যখন সে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে যায় সেখানে এক কর্মকর্তা ফিসফিস করে বলে তুমি আবার ঢাকায় যাবে নাকি? আমি সাহায্য করতে পারি…
এখানে দারিদ্র্য নারী নির্যাতন এবং দুর্নীতির চক্র একই সুতোয় বোনা। চাঁপার মতো মেয়েরা দুইবার নির্যাতনের শিকার হয়একবার স্বামীর হাতে আরেকবার সমাজের ব্যবস্থার হাতে। তাদের প্রতিবাদ নিঃশব্দে গিলে নেয় রাষ্ট্রের নোংরা গর্তগুলো।
চাঁপার মতো মেয়েরা শহরের আলো থেকে অনেক দূরে। তারা জানেও না কোথায় অভিযোগ করতে হয় কীভাবে আইনি সাহায্য নিতে হয়। এদের জন্য সমাধান হতে পারে:
🟢 ১. স্থানীয় নারী সহায়তা কেন্দ্র স্থাপন:
ইউনিয়ন বা উপজেলা পর্যায়ে এমন কেন্দ্র গড়া দরকার যেখানে চাঁপাদের মতো নারীরা নিরাপদে আশ্রয় নিতে পারবেন এবং প্রাথমিক আইনি মানসিক ও চিকিৎসা সহায়তা পাবেন। এই কেন্দ্রগুলোতে স্থানীয় প্রশাসন নারী সংগঠন এবং উন্নয়ন সংস্থার যৌথ অংশগ্রহণ জরুরি।
🟢 ২. মোবাইল লিগ্যাল ক্লিনিক ও তথ্য অ্যাপ:
গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অনেকেই জানেন না কীভাবে অভিযোগ করতে হয় বা কোথায় যেতে হয়। উন্নয়ন সংস্থাগুলো চাইলে ভ্রাম্যমাণ আইন সহায়তা দল (mobile legal clinic) চালু করতে পারে যারা পাড়া-মহল্লায় গিয়ে আইনি সচেতনতা ছড়াবে। সাথে তথ্যভিত্তিক অ্যাপ বা হটলাইন চালু করা যেতে পারে যা ফ্রি ও সহজলভ্য হবে। যেমন: জেন্ডার ডেস্ক হেল্পলাইন - ১০৯ যার কথা প্রতিটি গ্রামে পৌঁছাতে হবে।
🟢 ৩. বাল্যবিয়ে ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে স্থানীয় ‘নজরদারি কমিটি’:
প্রতিটি গ্রামে নারীনেত্রী শিক্ষক ইমাম গ্রামপুলিশ এনজিও প্রতিনিধিএইসব মানুষদের নিয়ে একটি ‘নারী নিরাপত্তা কমিটি’ গঠন করা যায় যারা বাল্যবিয়ে ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটার আগেই হস্তক্ষেপ করবে।
এই মডেলটি ইতিমধ্যেই BRAC ও অন্যান্য এনজিও কিছু অঞ্চলে কার্যকরভাবে প্রয়োগ করেছে।
🟢 ৪. আয়মুখী দক্ষতা প্রশিক্ষণ ও ক্ষুদ্রঋণ:
চাঁপারা শুধু ভুক্তভোগী নয়তারা উদ্যোক্তা হতে পারে পরিবারের ভরসা হতে পারে। এজন্য দরকার আয়মুখী কারিগরি প্রশিক্ষণ (সেলাই কৃষি আইসিটি হস্তশিল্প ইত্যাদি) এবং সহজ শর্তে ক্ষুদ্রঋণ সুবিধা।
যেমন:
PKSF BRAC Grameen Bank TMSS–এর মতো সংস্থাগুলো ইতিমধ্যেই সফলভাবে এসব কার্যক্রম চালাচ্ছে।
🟢 ৫. শিক্ষায় প্রবেশগম্যতা ও সচেতনতা:
চাঁপার মতো মেয়েরা যদি স্কুলেই শেখেনারী নির্যাতন অপরাধ আইনি অধিকার কী বাল্যবিয়ে ঠেকানোর উপায়তাহলে তারা ভবিষ্যতে শুধু শিক্ষিত নয় সচেতন নাগরিকও হয়ে উঠবে। এই শিক্ষাকে পাঠ্যবইয়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে বাস্তব জীবনে পৌঁছাতে হবে।
চাঁপারা আমাদের সমাজের সবচেয়ে নীরব যোদ্ধা। তারা কাঁদে সহ্য করে আবার উঠে দাঁড়ায়যদি একটু সাহস পায় একটু সহায়তা পায়। উন্নয়ন সংস্থা স্থানীয় প্রশাসন ও সচেতন নাগরিকদের সম্মিলিত উদ্যোগে আমরা যদি সেই সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিই তাহলে চাঁপারা শুধু সহ্য করেই যাবে নাপ্রতিবাদ করবে জয় করবে।
বিষাক্ত ত্রিভুজের রসায়ন: কেন এরা একে অপরের বন্ধু?
গল্পগুলো কাল্পনিক কিন্তু এর বাস্তবতা আমাদের চারপাশে নিশ্বাস নিচ্ছে। এই তিনটি সমস্যা একে অপরকে যেভাবে বাঁচিয়ে রাখে তা এক ভয়ঙ্কর রসায়ন।
১. দুর্নীতি > বেকারত্ব > সামাজিক অস্থিরতা: যখন চাকরি বা সুযোগ পাওয়ার জন্য যোগ্যতা গৌণ হয়ে যায় তখন তরুণদের মধ্যে সিস্টেমের প্রতি তীব্র অনাস্থা তৈরি হয়। এই হতাশা থেকে জন্ম নেয় অপরাধপ্রবণতা মাদকাসক্তি এবং সামাজিক অস্থিরতা।
২. বেকারত্ব > নারী নির্যাতন > মানসিক অবক্ষয়: বেকারত্ব পুরুষের মধ্যে যে শুধু আর্থিক সংকট তৈরি করে তা নয় এটি তার আত্মসম্মান এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও প্রচণ্ড আঘাত হানে। এই মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে অনেকেই সহিংস হয়ে ওঠে। এর সহজ শিকার হয় নারীরা। যৌতুকের মতো প্রথাও এই বেকারত্বের কারণে আরও জেঁকে বসে।
৩. দুর্নীতি > বিচারহীনতা > নারীর স্বাধীনতা: যখন ন্যায়বিচার কেনাবেচার পণ্য হয়ে যায় তখন নারী নির্যাতনের অপরাধীরা শাস্তি পায় না। এটি অন্য অপরাধীদেরও সাহস জোগায়। ফলে সমাজ নারীর জন্য ক্রমশ দুর্বল হয়ে ওঠে। নারীরাও আর বিচার ব্যবস্থার ওপর আস্থা রাখতে পারে না।
এই চক্রাকার বাঁধনটা এতটাই শক্তিশালী যে একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটির সমাধান প্রায় অসম্ভব। এটি একটি সামাজিক ক্যান্সার যা ধীরে ধীরে আমাদের নৈতিকতার ভিত্তি ধ্বংস করে দিচ্ছে।
তাহলে মুক্তির পথ কোথায়? সুতোটা ছিঁড়বে কে?
এই অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষে আলোর আশা করাটা কঠিন কিন্তু অসম্ভব নয়। সমাধান কোনো একক জাদুকরী ফর্মুলায় নেই বরং এর জন্য প্রয়োজন একটি সম্মিলিত এবং বহুমাত্রিক প্রচেষ্টা।
পরিবার থেকে প্রতিরোধের শুরু: আমাদের বুঝতে হবে দুর্নীতি শুধু টাকা লেনদেন নয় এটি একটি নৈতিক অবক্ষয়। সবাই করে তাই আমিও করিএই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সন্তানকে শেখাতে হবে ঘুস দিয়ে চাকরি পাওয়াটা কোনো গৌরব নয় বরং লজ্জার। ছেলেকে শেখাতে হবে নারীর প্রতি সম্মান দেখানোই প্রকৃত পৌরুষ বেকারত্বের অজুহাতে সহিংস হওয়া নয়।
স্বচ্ছ, স্বাধীন ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা: প্রযুক্তি ব্যবহার করে সরকারি-বেসরকারি সব ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনা সম্ভব। চাকরি থেকে শুরু করে যেকোনো সরকারি সেবাসবকিছু ডিজিটাল এবং মনিটরিং-এর আওতায় আনতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে সত্যিকারের স্বাধীন এবং শক্তিশালী করতে হবে যাতে তারা কোনো পদের বা ক্ষমতার তোয়াক্কা না করে ব্যবস্থা নিতে পারে।
দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা ও উদ্যোক্তা তৈরি: আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা শুধু সার্টিফিকেট-সর্বস্ব না হয়ে যদি দক্ষতা-ভিত্তিক হতো তাহলে তরুণরা চাকরির পেছনে না ছুটে নিজেরাই উদ্যোক্তা হতে পারত। সরকারের উচিত তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা এবং তাদের ব্যবসা শুরু করার প্রক্রিয়াকে দুর্নীতিমুক্ত ও সহজ করা।
নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সামাজিক প্রতিরোধ: শুধু আইন দিয়ে নারী নির্যাতন বন্ধ করা যাবে না। পাড়ায়-মহল্লায় সামাজিক কমিটি গঠন করতে হবে। কোথাও নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে সম্মিলিতভাবে তার প্রতিবাদ করতে হবে এবং নির্যাতিতার পাশে দাঁড়াতে হবে। অপরাধীকে সামাজিকভাবে বয়কট করার মতো শক্তিশালী পদক্ষেপ নিতে হবে। একইসাথে নির্যাতিতাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করতে হবে।
সুমনা আকাশ জনাব রহমান বা মিতুএরা কেউ আমাদের থেকে আলাদা নয়। আমরাই এদের তৈরি করেছি আমাদের সমাজই এই চরিত্রগুলোর জন্ম দিয়েছে। এই বিষাক্ত ত্রিভুজের অদৃশ্য সুতোটা আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতার প্রতীক।
তবে আশার কথা হলো এই সুতো মানুষের তৈরি। আর যা কিছু মানুষ তৈরি করে তা মানুষ ভাঙতেও পারে। এর জন্য প্রয়োজন সৎ সাহস সম্মিলিত প্রতিরোধ এবং নিজের বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থাকা। যেদিন আমরা প্রত্যেকে নিজের জায়গা থেকে এই অদৃশ্য সুতোটা কাটার জন্য একটা ছোট কোপ বসাব সেদিনই এই ত্রিভুজের বাঁধন আলগা হতে শুরু করবে। সেদিন হয়তো সুমনারা নির্ভয়ে বাঁচবে আকাশরা স্বপ্ন দেখার সাহস পাবে আর মিতুরা নিজেদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে।
সেই দিনের অপেক্ষায় না থেকে চলুন আজ থেকেই শুরু করি।
এই বিষাক্ত ত্রিভুজের ছায়ায় আমরা সবাই আছি। কেউ নির্যাতনের শিকার কেউ নিরব দর্শক কেউ আবার নিজের সুবিধার জন্য চোখ বুজে থাকা চরিত্র। ভাবুনযদি এই ত্রিভুজের একটিও কোণ ভেঙে পড়ে তাহলে বাকিগুলো কি টিকে থাকবে?
আজকের এই লেখার প্রতিটি চরিত্র আমাদের সমাজের আয়নায় একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়আমিও কি কোনোভাবে এই ত্রিভুজকে টিকিয়ে রাখছি?
যখন আমরা ঘুষ দিয়ে সন্তানের জন্য চাকরি কিনে দিই তখন কি বুঝি না সেই ঘুষই অন্য কারও ছেলে-মেয়েকে বেকার করে তোলে?
যখন আমরা নারী নির্যাতনের ঘটনা শুনে বলি ওটা ওদের পারিবারিক বিষয়তখন কি আমরা নিজেরাই বিচারহীনতার সংস্কৃতি জারি রাখি না?
যখন আমরা বলি এই দেশে কিছু হবে নাতখন কি নিজের ভীতুর মানসিকতাকে বৈধতা দিচ্ছি না?
আপনার প্রতিবাদ শুরু হোক নিজের ভেতর থেকে।
প্রতিদিন আমরা যতগুলো পোস্ট শেয়ার করি তার একটাও যদি এই বিষাক্ত ত্রিভুজ ভাঙার জন্য হয় তবেই শব্দগুলো অর্থ পায়।
তবেই হয়তো ভবিষ্যতের কোনও সুমনা কাঁদবে না কোনও আকাশ নিজেকে হারাবে না কোনও মিতু রান্নাঘরে বন্দী হবে না।
📣 আপনার চিন্তা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ
🔹 এই লেখাটি যদি আপনার ভাবনায় নাড়া দেয় দয়া করে শেয়ার করুনহয়তো কারও চোখ খুলে যাবে।
🔹 আপনি কীভাবে এই ত্রিভুজ ভাঙার চেষ্টা করছেন বা করতে চান? মন্তব্যে জানান।
আপনার শব্দই হতে পারে কারও সাহসের উৎস।
আমরা অপেক্ষায় থাকবআপনার কণ্ঠস্বর শুনতে।
নারী নির্যাতন, দুর্নীতি, বেকারত্ব, সামাজিক অবক্ষয়, মানবিক গল্প, বাংলাদেশ, সমাজ বিশ্লেষণ।
🌸 আপনার মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ!
আপনার মতামত আমাদের অনুপ্রাণিত করে এবং আগামীতে আরও মানসম্পন্ন কনটেন্ট তৈরিতে সহায়তা করে।
আপনি যদি কোনো নির্দিষ্ট বিষয় বা গল্প পছন্দ করে থাকেন, জানালে ভালো লাগবে।
নিয়মিত পাশে থাকুন — আপনার সহযোগিতা ও ভালোবাসাই আমাদের এগিয়ে চলার শক্তি।
শুভ কামনায়,
✍️ কল্পকথা-৩৬০ ব্লগ টিম
https://kalpakatha360.blogspot.com