জানালার কাঁচে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো আঁকিবুঁকি কাটছে। হাতে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ, আর টেলিভিশনের পর্দায় সংবাদের শিরোনামগুলো ঝাপসা হয়ে আসছে। এই পরিচিত ঘরোয়া দৃশ্যটার ভেতরেও কেমন যেন একটা অদৃশ্য দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে থাকে। এই দীর্ঘশ্বাসটা শুধু আমার বা আপনার নয়, এটা হয়তো এই ভূখণ্ডের সাড়ে সতেরো কোটি মানুষের বুকের গভীরে জমে থাকা এক সম্মিলিত অনুভূতির প্রতিধ্বনি। আমরা এক স্বপ্নের জন্য জন্মেছিলাম, যে স্বপ্নের নাম বাংলাদেশ। সেই স্বপ্নের মূল ভিত্তি ছিল দুটো শব্দ সত্য এবং ন্যায়।
আজ, স্বাধীনতার পাঁচ দশক পেরিয়ে, সেই শব্দ দুটো নিয়ে যখন ভাবতে বসি, তখন মনে হয়এগুলো কি নিছকই অভিধানে থাকা কিছু বর্ণসমষ্টি, নাকি আমাদের জাতীয় চেতনার জীবন্ত স্পন্দন? এই সত্য, ন্যায় আর স্বপ্নের বাংলাদেশকে খুঁজে বের করার চেষ্টাই হয়তো আজকের প্রজন্মের সবচেয়ে বড় মুক্তিযুদ্ধ।
সত্য শব্দটা যতটা সহজ, এর নাগাল পাওয়া ততটাই কঠিন। আমাদের দেশে সত্য অনেক সময় পরিস্থিতির দাস। এর নানা রূপ, নানা চেহারা। কোনটা আসল, কোনটা নকল, তা বুঝে ওঠার আগেই নতুন কোনো সত্যের সংস্করণ আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়।
ভাবুন তো একবার ঢাকার কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ের টং দোকানের আড্ডার কথা। একদল তরুণ ইতিহাসের এক বীরত্বগাথা নিয়ে তর্ক করছে। তাদের একজন পাঠ্যবইয়ে পড়া ইতিহাসের কথা বলছে, আরেকজন তার দাদার কাছে শোনা গল্পের কথা বলছে, আর তৃতীয়জন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাওয়া কোনো এক ভাইরাল পোস্টের তথ্যকে অভ্রান্ত বলে ধরে নিয়েছে। তিনজনের কাছেই তাদের জানা তথ্যটাই "সত্য"। কিন্তু আসল সত্যটা কোথায়? আসলে, সত্য এখানে একটা ভাঙা আয়নার মতো, যার প্রত্যেকটা টুকরোয় একেকটা খণ্ডিত প্রতিবিম্ব দেখা যায়, কিন্তু পুরো ছবিটা আর জোড়া লাগে না।
এই খণ্ডিত সত্যের পেছনে সবচেয়ে বড় অনুঘটক হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের তথ্যপ্রবাহের ধরন। একদিকে যেমন মূলধারার গণমাধ্যমকে নানা অদৃশ্য চাপের মধ্যে কাজ করতে হয়, তেমনি অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অনিয়ন্ত্রিত জগতে গুজবের স্রোত বইছে। এখানে ব্যক্তিগত বিশ্বাস আর আবেগ দিয়ে সত্যকে যাচাই করা হয়, তথ্য বা যুক্তি দিয়ে নয়। ফলে, একজন মানুষ যখন তার নিজের বিশ্বাসের প্রতিধ্বনি শোনে, তখন সেটাকেই সে পরম সত্য বলে ধরে নেয়। এর ফলাফল ভয়াবহ। সমাজে তৈরি হচ্ছে অদৃশ্য দেয়াল, বাড়ছে বিভেদ আর অসহিষ্ণুতা।
বাস্তব উদাহরণ চান? ধরা যাক, কোনো একটা ছোট্ট শহরে একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলো। মুহূর্তের মধ্যে সেই ঘটনার ডালপালা গজিয়ে ফেসবুকে আর হোয়াটসঅ্যাপে ছড়িয়ে পড়লো। কে ঠিক, কে ভুলসেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলো। একে অপরকে দোষারোপ, কাদা ছোড়াছুড়ি চলতে থাকলো। আসল ঘটনাটা হয়তো খুবই সাধারণ ছিল, কিন্তু সত্যের এই বিকৃত উপস্থাপনার কারণে দুটো সম্প্রদায়ের মধ্যে হয়তো স্থায়ী অবিশ্বাসের জন্ম নিলো। এটাই হলো সত্যকে ম্যানিপুলেট করার পরিণতি।
তাই সত্যের সন্ধান মানে শুধু তথ্য খুঁজে বের করা নয়। এর অর্থ হলো, যেকোনো তথ্যকে গ্রহণ করার আগে প্রশ্ন করার স্পর্ধা থাকা, নিজের বিশ্বাসের বিপরীতে গেলেও যুক্তিকে সম্মান করার মানসিকতা তৈরি করা এবং অন্যের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করা। সত্য কোনো স্থির বস্তু নয়, এটি একটি নিরন্তর অনুসন্ধান।
সত্যের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত যে ধারণাটি, তা হলো ন্যায়। ন্যায়বিচার ছাড়া একটি সমাজ কখনোই স্থিতিশীল হতে পারে না। আমাদের সংবিধান সকল নাগরিকের জন্য সমান অধিকারের কথা বলে, আইনের চোখে সবাই সমানএই কথাগুলো শুনতে খুব আশাব্যঞ্জক। কিন্তু বাস্তবতা কি সবসময় এই আদর্শকে অনুসরণ করে?
ঢাকার কোনো এক অভিজাত এলাকার কথাই ধরুন। সেখানে হয়তো দামী গাড়ি থেকে নামা কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি ট্রাফিক আইন ভাঙলেন। ট্রাফিক পুলিশ হয়তো ইতস্তত করে তাকে ছেড়ে দিলেন। আবার একই দিনে, শহরের অন্য প্রান্তে একজন রিকশাচালক হয়তো ভুল করে একমুখী রাস্তায় ঢুকে পড়েছিলেন, আর তার জন্য তাকে কঠোর শাস্তি বা হেনস্তার শিকার হতে হলো। আইন একটাই, কিন্তু তার প্রয়োগ দুজনের জন্য দুই রকম হয়ে গেলো। এখানেই "আইন" আর "ন্যায়বিচারের" মধ্যে একটা পরিষ্কার ফারাক তৈরি হয়। আইন যখন শক্তি বা পদের কাছে নতি স্বীকার করে, তখন ন্যায়বিচার মুখ থুবড়ে পড়ে।
এই বৈষম্য শুধু রাস্তাতেই সীমাবদ্ধ নেই, এর শিকড় সমাজের অনেক গভীরে। একজন সাধারণ কৃষক যখন তার জমির দলিল নিয়ে বছরের পর বছর আদালতের বারান্দায় ঘোরেন, তখন তার প্রতিপক্ষ প্রভাবশালী মহল হয়তো আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যায়। একজন গার্মেন্টসের নারী শ্রমিক যখন তার ন্যায্য মজুরির জন্য আওয়াজ তোলেন, তখন তাকে সিস্টেমের নানা জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়। এই ছোট ছোট অন্যায়ের গল্পগুলোই একত্রিত হয়ে এক বিরাট আস্থাহীনতার জন্ম দেয়। মানুষ তখন সিস্টেমের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। তাদের মনে হতে থাকে, এই ব্যবস্থা শুধু শক্তিশালী আর বিত্তবানদের রক্ষা করার জন্যই তৈরি হয়েছে।
তবে সবকিছুই হতাশাব্যঞ্জক নয়। এর মধ্যেই কিছু মানুষ ন্যায়ের জন্য লড়ে যাচ্ছেন। আমরা এমন আইনজীবীর গল্প শুনি, যিনি বিনা পারিশ্রমিকে নির্যাতিত মানুষের জন্য মামলা লড়েন। আমরা এমন সাংবাদিকের কথা জানি, যিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুর্নীতির খবর জনসমক্ষে নিয়ে আসেন। আমরা এমন সরকারি কর্মকর্তার দেখা পাই, যিনি শত চাপের মুখেও নিজের সততা বিসর্জন দেন না। এনারাই হলেন ন্যায়ের বাতিঘর। তাদের আলোতেই সাধারণ মানুষ এখনো বিচার পাওয়ার স্বপ্ন দেখে।
ন্যায়বিচার মানে শুধু অপরাধের শাস্তি দেওয়া নয়। ন্যায়বিচার মানে হলো সুযোগের সমতা। এর অর্থ হলো, একজন প্রান্তিক গ্রামের শিশুও যেন শহরের সবচেয়ে ভালো স্কুলে পড়ার স্বপ্ন দেখতে পারে। এর অর্থ হলো, একজন নারী উদ্যোক্তা যেন কোনো লিঙ্গীয় বৈষম্যের শিকার না হয়ে তার ব্যবসা দাঁড় করাতে পারেন। ন্যায়বিচার হলো সেই সামাজিক নিরাপত্তা, যা প্রত্যেক নাগরিককে অনুভব করায় যে, রাষ্ট্র তার পাশে আছে।
তাহলে আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ টা ঠিক কেমন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমরা প্রায়শই কিছু অর্থনৈতিক সূচকের দিকে তাকাই। জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়, বড় বড় অবকাঠামোএগুলো নিঃসন্দেহে দেশের অগ্রগতির পরিচায়ক। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল বা কর্ণফুলী টানেল আমাদের জাতীয় সক্ষমতার প্রতীক। কিন্তু আমাদের স্বপ্ন কি শুধু কংক্রিটের উন্নয়নে সীমাবদ্ধ?
আমার মনে হয়, স্বপ্নের বাংলাদেশ মানে শুধু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নয়, এর মূল ভিত্তি হলো মানবিক মর্যাদা।
কল্পনা করুন তো এমন একটি বাংলাদেশের কথা
যেখানে একজন তরুণ চাকরি খোঁজার জন্য মামা-চাচার সুপারিশের কথা ভাবে না, নিজের যোগ্যতার ওপর আস্থা রাখে।
যেখানে একজন নারী গভীর রাতে কাজ শেষে নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারে, তার পোশাক বা চালচলন নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে না।
যেখানে ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো হয়। সরকারের গঠনমূলক সমালোচনাকে দেশদ্রোহিতা হিসেবে দেখা হয় না, বরং গণতন্ত্রের সৌন্দর্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
যেখানে হাসপাতালের বেডে কোনো রোগীকে টাকার অভাবে বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে হয় না।
যেখানে প্রতিটি শিশুর শৈশব কাটে বইয়ের পাতায়, খেলার মাঠে; কারখানার ধোঁয়ায় বা ইটভাটার ধূলোয় নয়।
এই স্বপ্নটা কি খুব বেশি অবাস্তব? হয়তো কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। এই স্বপ্নটা জিডিপি’র পরিসংখ্যানের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দিনশেষে, মানুষ শুধু সংখ্যা দিয়ে বাঁচে না, বাঁচে সম্মান, নিরাপত্তা আর ভালোবাসার অনুভূতি নিয়ে।
আমার এক বন্ধু, যে কিনা একটা ছোট আইটি ফার্ম চালায়, তার গল্পটা বলি। সে প্রায়ই বলে, "আমি বিলিয়ন ডলারের কোম্পানি বানানোর স্বপ্ন দেখি না। আমি এমন একটা প্রতিষ্ঠান বানাতে চাই, যেখানে আমার কর্মীরা কাজ শেষে হাসিমুখে বাড়ি ফিরবে। যেখানে তাদের মাস শেষে বেতনের জন্য চিন্তা করতে হবে না। যেখানে তাদের মেধার সঠিক মূল্যায়ন হবে।" এই ছোট ছোট স্বপ্নগুলোই একত্রিত হয়ে একটা বড়, মানবিক বাংলাদেশের স্বপ্ন তৈরি করে। আমাদের প্রয়োজন এমন এক উন্নয়ন মডেল, যার কেন্দ্রে থাকবে মানুষ।
এতক্ষণ ধরে যে সমস্যা আর স্বপ্নের কথা বললাম, তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব কার? আমরা খুব সহজেই রাষ্ট্র, সরকার বা কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর ওপর দায় চাপিয়ে দিতে পারি। কিন্তু তাতে কি সমস্যার সমাধান হবে? পরিবর্তনটা শুরু করতে হবে আমাদের নিজেদের থেকে।
১. প্রশ্ন করার অভ্যাস: যেকোনো কিছু সহজে বিশ্বাস করার আগে, আসুন আমরা প্রশ্ন করতে শিখি। কেন এমন হলো?, "এর পেছনের কারণটা কী?অন্য কোনো ব্যাখ্যা কি থাকতে পারে?এই প্রশ্নগুলো আমাদের অন্ধ বিশ্বাস আর গুজবের স্রোত থেকে বাঁচাবে।
২. সহানুভূতির চর্চা: আমরা খুব দ্রুত অন্যকে বিচার করে ফেলি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিন্নমত দেখলেই তাকে আক্রমণ করে বসি। এর বদলে, আসুন আমরা অন্যের জায়গায় নিজেকে বসিয়ে ভাবার চেষ্টা করি। তার পরিবেশ, তার পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করি। সহানুভূতিই পারে সমাজের বিভেদের দেয়াল ভাঙতে।
৩. ছোট ছোট অন্যায়ের প্রতিবাদ: আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত ছোট ছোট অন্যায় হচ্ছে। বাসে একজন বয়স্ক মানুষকে সিট ছেড়ে না দেওয়া, অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া, কিংবা পরিচিত কেউ সাইবার বুলিংয়ের শিকার হওয়াএই প্রতিটি ঘটনাতেই আমাদের আওয়াজ তোলার সুযোগ আছে। এই ছোট প্রতিবাদের অভ্যাসই বড় অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস যোগাবে।
৪. ইতিবাচক গল্পের বিস্তার: হতাশার খবরের ভিড়ে আমরা প্রায়ই ভালো খবরগুলো এড়িয়ে যাই। যে তরুণটি নিজের গ্রামে একটি লাইব্রেরি গড়ে তুলেছে, যে মেয়েটি সব বাধা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মাননা পেয়েছে, যে কৃষকটি নতুন পদ্ধতিতে চাষ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেএই গল্পগুলো আমাদের অনেক বেশি করে বলতে হবে। কারণ স্বপ্ন আর আশা সংক্রামক।
সত্য, ন্যায় আর স্বপ্নের বাংলাদেশ কোনো ইউটোপিয়া বা কল্পলোকের ধারণা নয়। এটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অন্তর্নিহিত প্রতিশ্রুতি। এই পথচলা সহজ নয়। এখানে অন্ধকার আছে, বাধা আছে, হতাশা আছে। কিন্তু রাতের গভীরতাই যেমন ভোরের আগমনী বার্তা দেয়, তেমনি এই সংকটগুলোই আমাদের নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রেরণা যোগাতে পারে।
এই স্বপ্ন কোনো একক নেতা বা দলের পক্ষে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন সাড়ে সতেরো কোটি মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। চায়ের কাপে ঝড় তোলা তর্কের বদলে যখন আমরা গঠনমূলক আলোচনা শুরু করবো, একে অপরকে দোষারোপ করার বদলে যখন আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবো, এবং ভাঙা আয়নার খণ্ডিত প্রতিবিম্বের দিকে না তাকিয়ে যখন আমরা একটা পূর্ণাঙ্গ, মানবিক বাংলাদেশের ছবি আঁকার চেষ্টা করবোসেদিন থেকেই শুরু হবে আমাদের স্বপ্নের বাস্তবায়ন।
এই সত্য, ন্যায় আর স্বপ্নের বাংলাদেশ আমাদের সম্মিলিত চেতনারই প্রতিচ্ছবি। একে গড়ে তোলার দায়িত্বও আমাদের সকলের। যাত্রাটা অসমাপ্ত, কিন্তু পথচলার শপথেই লুকিয়ে আছে গন্তব্যে পৌঁছানোর সম্ভাবনা।
আমাদের জীবনটা চলে বিজ্ঞান আর যুক্তির ঝকঝকে আলোয়। আমরা সবকিছু পরিমাপ করতে চাই, ব্যাখ্যা করতে চাই। কিন্তু এই চেনা পথের বাঁকেই মাঝে মাঝে এমন কিছু ঘটনা ঘটে, যা আমাদের সব হিসাব-নিকাশকে মুহূর্তের জন্য থামিয়ে দেয়। এগুলো ভূত-প্রেতের গল্প নয়; এগুলো আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া এমন কিছু অমীমাংসিত অধ্যায়, যা বিজ্ঞানের চৌহদ্দির বাইরে এক ছায়াময় রহস্যের জগৎ তৈরি করে। আসুন, এমনই কয়েকটি বাস্তব ও রিলেটেবল গল্পের গভীরে প্রবেশ করি।
সাজিদের বাবা মারা গেছেন সপ্তাহখানেক হলো। ফুসফুসের ক্যানসারের সাথে দীর্ঘ লড়াই শেষে হঠাৎ করেই একদিন সব থেমে যায়। বাবার ব্যবহৃত ফোনটা বন্ধ করে ড্রয়ারে রেখে দিয়েছে সাজিদ। কিন্তু বাবার শূন্যতাটা প্রতি মুহূর্তে তাকে গ্রাস করছে। কত কথা বলার ছিল, কত কিছু শোনার ছিল। এক বিকেলে বিষণ্ণ মনে বারান্দায় বসে কফি খাচ্ছে সাজিদ, এমন সময় তার ফোনে একটা কল এলো। স্ক্রিনে তাকিয়ে সে জমে পাথর হয়ে গেল। 'Baba Calling...'।
এটা অসম্ভব! বাবার ফোন বন্ধ, সিমকার্ডও খোলা। তাহলে? কাঁপা কাঁপা হাতে সাজিদ কলটা রিসিভ করলো। হ্যালো? হ্যালো? কোনো উত্তর নেই। ওপাশ থেকে শুধু একটা অদ্ভুত শান্ত শব্দ আসছে, অনেকটা পুরনো রেডিওতে স্টেশন মেলানোর চেষ্টার মতো একটা হালকা স্ট্যাটিক আওয়াজ। সাজিদের মনে হলো, এই শব্দটা তার খুব চেনা। ছোটবেলায় বাবার পাশে বসে রেডিওতে খবর শোনার সময় ঠিক এমনই শব্দ হতো। কয়েক সেকেন্ড পর লাইনটা কেটে গেল।
এই ঘটনাকে কী বলবেন? নেটওয়ার্ক গ্লিচ? কারিগরি ত্রুটি? হতেই পারে। প্রযুক্তিগতভাবে এর হাজারটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানো সম্ভব। টেলিকম নেটওয়ার্কে মাঝে মাঝে এমন "ঘোস্ট কল" (Ghost Call) আসতেই পারে, যেখানে পুরনো কলার আইডি ডেটা কিছুক্ষণের জন্য সক্রিয় হয়ে যায়।
কিন্তু সাজিদের কাছে এটা কোনো নেটওয়ার্ক গ্লিচ ছিল না। তার শোকাতুর মনে, ওই কয়েক সেকেন্ডের নৈঃশব্দ্য ছিল বাবার তরফ থেকে পাঠানো এক অব্যক্ত বার্তা। একটা বিদায় সম্ভাষণ। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, চরম মানসিক আঘাত বা শোকের সময় আমাদের মস্তিষ্ক পরিচিত প্যাটার্ন বা সান্ত্বনা খুঁজে নেয়। সাজিদের মস্তিষ্ক হয়তো একটি র্যান্ডম টেকনিক্যাল ত্রুটিকে তার বাবার স্মৃতির সাথে জুড়ে দিয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তাতে কি ঘটনাটার আবেগিক তাৎপর্য কমে যায়? এই রহস্যের সমাধান যুক্তিতে নয়, অনুভূতিতে লুকিয়ে আছে। এটি আমাদের শেখায়, প্রিয়জনের সাথে আমাদের সম্পর্ক শুধু শারীরিক উপস্থিতির উপর নির্ভর করে না, তার শিকড় থাকে স্মৃতির অনেক গভীরে।
নদীয়ার গল্পটা তার নানীর। দেশভাগের সময় সহায়-সম্পত্তি, ঘরবাড়ি সব ফেলে শুধু জীবনটা নিয়ে চলে আসতে হয়েছিল এপারে। সঙ্গে ছিল শুধু তার বিয়ের একটা ছোট্ট সোনার লকেট, যেটা তার শাশুড়ি তাকে দিয়েছিলেন। সেই লকেটটা ছিল পরিবারের ঐতিহ্যের প্রতীক। কিন্তু শরণার্থী শিবিরের ভিড়ে, জীবনের সেই চরম দুঃসময়ে একদিন লকেটটা হারিয়ে যায়। অনেক খুঁজেও আর পাওয়া যায়নি। নানীর মনে এই নিয়ে একটা চাপা কষ্ট আজীবন ছিল।
প্রায় ৬০ বছর পরের ঘটনা। নদীয়া তার পুরনো পৈতৃক বাড়িটা বিক্রি করে দেওয়ার আগে শেষবারের মতো সব গোছাচ্ছিল। চিলেকোঠায় রাখা একটা পুরনো ট্রাঙ্ক খুলতেই ধুলোর আস্তরণের নিচ থেকে বেরিয়ে এলো তার নানীর বিয়ের বেনারসিটা। শাড়িটা ভাঁজ করে রাখতে গিয়েই শাড়ির ভাঁজের ভেতর থেকে কী একটা ঝিলিক দিয়ে উঠলো। নদীয়া হাতে তুলে নিয়ে দেখলো, একটা ছোট্ট সোনার লকেট। অবিকল সেই লকেট, যার ছবি সে অ্যালবামে দেখেছে আর যার গল্প সে ছোটবেলা থেকে শুনে আসছে।
কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব? যে লকেট হারিয়ে গিয়েছিল সীমান্তের ওপারে, সেটা এপারে একটা বন্ধ ট্রাঙ্কের ভেতর এলো কীভাবে?
সবচেয়ে যৌক্তিক ব্যাখ্যা হলো, নানীর হয়তো স্মৃতিভ্রম হয়েছিল। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন লকেটটা হারিয়ে গেছে, কিন্তু আসলে সেটা শাড়ির ভাঁজেই কোথাও আটকে ছিল। মানুষের স্মৃতি, বিশেষ করে আঘাতমূলক ঘটনার স্মৃতি, সবসময় নির্ভরযোগ্য হয় না।
তবে এই ঘটনার আর একটা দিকও আছে। মনোবিজ্ঞানী কার্ল ইয়ুং "সিনক্রোনিসিটি" (Synchronicity) বা অর্থপূর্ণ কাকতালীয় ঘটনার কথা বলেছেন। যখন দুটি সম্পর্কহীন ঘটনা এমনভাবে ঘটে যে অংশগ্রহণকারীর কাছে তার একটি গভীর অর্থ তৈরি হয়, তাকেই সিনক্রোনিসিটি বলে। নদীয়ার কাছে এই লকেট খুঁজে পাওয়াটা শুধু একটা কাকতালীয় ঘটনা ছিল না। এটা ছিল তার শেকড়ের সাথে পুনঃসংযোগের একটা প্রতীকী মুহূর্ত। এই রহস্য আমাদের মনে করিয়ে দেয়, জীবনের কিছু ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার চেয়ে তার আবেগিক এবং প্রতীকী মূল্য অনেক বেশি।
ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করে ফাহিম। কাজের সূত্রে তাকে প্রায়ই ঢাকার বাইরে যেতে হয়। একবার সে গিয়েছে চট্টগ্রামের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে, যেখানে নেটওয়ার্ক প্রায় থাকেই না। একটা ছোট্ট রিসোর্টে উঠেছে, যার ঠিকানা বা নাম সে তার পরিবার বা বন্ধু-বান্ধব কাউকেই জানায়নি। ভেবেছিল, কয়েকটা দিন একেবারে নিরিবিলিতে কাজ করবে।
তৃতীয় দিন দুপুরে হঠাৎ রিসোর্টের ল্যান্ডলাইনে তার নামে একটা ফোন এলো। রিসিভার তুলতেই ওপাশ থেকে তার মায়ের গলা, "কিরে, তুই ঠিক আছিস? আজ সকাল থেকে বুকের ভেতরটা কেমন যেন খচখচ করছে। মনে হচ্ছে তোর কোনো বিপদ হয়েছে।" ফাহিম তো অবাক! তার মা এই রিসোর্টের নম্বর কীভাবে পেলেন? তিনি তো এই জায়গার নামই জানেন না।
পরে ঢাকায় ফিরে সে মাকে জিজ্ঞেস করেছিল। তার মা যা বললেন, তা আরও অদ্ভুত। তিনি নাকি সকালে স্বপ্নে দেখেন, ফাহিম একটা সবুজ পাহাড়ের পাশে একতলা একটা সাদা কটেজে বসে আছে আর তার খুব মন খারাপ। ঘুম থেকে উঠে তার এত অস্থির লাগতে শুরু করে যে, তিনি ফাহিমের এক বন্ধুর কাছে ফোন দেন। সেই বন্ধুও ঠিকানা জানতো না। কিন্তু সে তখন অন্য এক বন্ধুর সাথে কথা বলছিল, যে কিনা ট্যুরিজম কোম্পানিতে কাজ করে। কথায় কথায় ফাহিমের কথা উঠতেই সে বলে, "আরে, ফাহিম ভাই তো মনে হয় আমাদের কোম্পানির বুকিংয়ে 'সাগরিকা' রিসোর্টে গেছেন!" সেই সূত্র ধরেই তার মা ফোন করেন।
এটাকে আপাতদৃষ্টিতে শুধুই কতগুলো কাকতালীয় ঘটনার সমষ্টি মনে হতে পারে। কিন্তু ঘটনাগুলো পর পর এমনভাবে সাজানো যে, তাকে আর সাধারণ কাকতালীয় বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মায়ের মন বা ইনটুইশন বা সহজাত অনুভূতিএর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি হয়তো নেই। কিন্তু পৃথিবীর প্রায় সব প্রান্তের মানুষই এমন ঘটনার সাক্ষী।
বিজ্ঞানীরা বলেন, আমাদের অবচেতন মন ক্রমাগত তথ্য বিশ্লেষণ করতে থাকে, যা আমাদের সচেতন মন টের পায় না। হয়তো ফাহিম যাওয়ার আগে তার মায়ের সাথে কথায় কথায় এমন কোনো ইঙ্গিত দিয়েছিল, যা তার মায়ের অবচেতন মনে গেঁথে ছিল। স্বপ্নটা ছিল সেই তথ্যেরই একটি প্রক্রিয়াজাত রূপ। কিন্তু এই ব্যাখ্যাও ওই অদ্ভুত ফোন কলের সময় আর ঘটনার নিখুঁত মিলনকে পুরোপুরি ধারণ করতে পারে না। এই রহস্য আমাদের শেখায়, মানুষের মধ্যকার মানসিক সংযোগ বা বন্ধন মাঝে মাঝে যুক্তি ও দূরত্বের ঊর্ধ্বে কাজ করতে পারে।
এই গল্পগুলোর কোনো চূড়ান্ত সমাধান নেই। আর হয়তো থাকার প্রয়োজনও নেই। জীবনের সব রহস্যের সমাধান হয়ে গেলে জীবনটা বড্ড একঘেয়ে হয়ে যেত। এই অমীমাংসিত মুহূর্তগুলোই আমাদের ভাবায়, আমাদের কল্পনাকে উসকে দেয়। এগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, এই পরিচিত বিশ্বের সমান্তরালে আরও একটি জগৎ আছেঅনুভূতির, বিশ্বাসের এবং খ্যাত সম্পর্কের জগৎ। এই রহস্যগুলোই হয়তো আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, জীবন শুধু মেপে চলার নাম নয়, মাঝে মাঝে অবাক হওয়ারও নাম।
রহস্যময় গল্প, অলৌকিক ঘটনা, বাস্তব অভিজ্ঞতা, অমীমাংসিত রহস্য, আবেগঘন লেখা।


🌸 আপনার মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ!
আপনার মতামত আমাদের অনুপ্রাণিত করে এবং আগামীতে আরও মানসম্পন্ন কনটেন্ট তৈরিতে সহায়তা করে।
আপনি যদি কোনো নির্দিষ্ট বিষয় বা গল্প পছন্দ করে থাকেন, জানালে ভালো লাগবে।
নিয়মিত পাশে থাকুন — আপনার সহযোগিতা ও ভালোবাসাই আমাদের এগিয়ে চলার শক্তি।
শুভ কামনায়,
✍️ কল্পকথা-৩৬০ ব্লগ টিম
https://kalpakatha360.blogspot.com