ভালোবাসার কত রকম রূপই না আমরা দেখি! কখনও তা প্রচারমুখর, কখনও বিদ্রোহী, কখনও বা কেবল উপলব্ধিতে ঠাসা। কিন্তু এমন কিছু ভালোবাসা আছে, যা কোনদিন কারো চোখে পড়ে না, কারো কানেও পৌঁছায় না তবুও তার ওজন থাকে পাহাড়সম, তার প্রভাব থাকে মহাকালের মতো অনন্ত। এমন ভালোবাসা শব্দে প্রকাশ পায় না, দাবিতে বাঁধা পড়ে না, শুধুই নীরবতায় গাঁথা থাকে। যেন এক চুপচাপ নদী, যার স্রোত গভীরে বয়ে চলে, অথচ বাইরে একফোঁটা শব্দ নেই।
এই গল্প ঠিক তেমনই এক ভালোবাসার। রাহাত আর রিনাদুইটি চরিত্র, দুইটি পৃথক জীবন, অথচ এক গভীর আত্মিক সংযোগে বাঁধা। তাদের গল্পে নেই নাটকীয় মোড়, নেই সামাজিক বিদ্রোহ কিংবা প্রত্যাঘাতের ঝড়। তাদের গল্প চলে নিরবধি, নিঃশব্দে, যেন শহরের ব্যস্ত রাস্তায় হেঁটে যাওয়া দুইজন মানুষের চোখে-মুখে লুকিয়ে থাকা হাজারো অপ্রকাশিত কথা। এই গল্প শুরু হয় না কোনো চিঠির মাধ্যমে, শেষ হয় না কোনো বিচ্ছেদ চিৎকারে। এই গল্পচলে, কেবল চলে, আর থেকে যায় স্মৃতির নীরব পটভূমিতে।
রাহাত, এক সংবেদনশীল, চিন্তাশীল পুরুষ। তার ভালোবাসা কখনো দাবি করেনি রিনার কাছে কিছু, শুধু দিয়েছে। সে ভালোবেসেছে নিঃশব্দে, রিনার সম্মতিসূচক হাসির প্রতীক্ষায় নয়, বরং তার অস্তিত্বের সান্নিধ্যেই সে খুঁজে পেয়েছে শান্তি। রিনার প্রতি তার ভালোবাসা ছিল ঠিক সেই চাঁদের মতো, যা দূর থেকে আলো দেয়, কিন্তু ছুঁতে চায় না; স্পর্শহীন, অথচ গভীরভাবে উপস্থিত।
রিনা, সমাজের নিয়মে বাঁধা, পারিবারিক দায়িত্বে মোড়া এক সাধারণ মেয়ে, যার জীবন চলে হিসেব-নিকেশে। কিন্তু তার চোখে ছিল এক অজানা নরমতা, যা কেবল রাহাতই পড়তে পারত। তারা কোনোদিন একে অপরের ‘প্রেমিক-প্রেমিকা’ হয়ে ওঠেনি, অথচ একে অপরের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুভব হয়ে থেকেছে। তারা হয়তো একসাথে কোন উৎসবে হাতে হাত ধরে হাঁটেনি, কিন্তু পারিবারিক কোনো অনুষ্ঠান এলে, একবার চোখাচোখি হওয়া, একটুখানি স্মিত হাসিএই ছোট্ট নীরব মুহূর্তগুলোতেই তাদের সম্পর্ক বেঁধে ছিল হাজারো অদৃশ্য সুতোর বাঁধনে।
সময় কেটে যায়। জীবন তাদের আলাদা করে দেয়। রিনা হয়তো সংসারের গহিনে হারিয়ে যায়, আর রাহাত তার নির্জন একাকীত্বে গড়ে তোলে স্মৃতির এক বিশাল দুর্গ। তবুও, রাহাতের ভালোবাসা বদলায় না। সে আজও সেই আগের রাহাত, যে রিনাকে ভালোবেসেছিল একদিন। সে জানে, রিনা যেখানেই থাকুক না কেন, ভালো থাকুক। কারণ তার ভালোবাসা কখনো নিজের সুখের জন্য ছিল নাতা ছিল নিঃস্বার্থ, আত্মিক, আর অনন্ত।
এই গল্প কোনো চিৎকারের নয়, কোনো প্রতিবাদের নয়। এই গল্পনীরবতার, সংবেদনশীলতার, আর অনুভবের। এই গল্প আমাদের শেখায়, যে ভালোবাসা প্রকাশ না পেলেও, দাবি না জানালেও, তা কিন্তু কমে যায় না। বরং, সে ভালোবাসাই হয়তো সবচেয়ে পবিত্র, সবচেয়ে গাঢ়।
এই লেখার প্রতিটি ছত্রে আপনি খুঁজে পাবেন সেই নীরব ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি, যা হয়তো আপনার নিজের জীবনেও একসময় কোনো না কোনোভাবে থেকেছেঅপ্রকাশিত, কিন্তু অমলিন। হয়তো পাঠক হিসেবে আপনি নিজেও একবার থেমে ভাববেন, "আমার জীবনেও কি এমন কোনো রাহাত বা রিনা ছিল?"
কারণ, ভালোবাসা যখন শব্দে ধরা দেয় না, তখন সে হৃদয়ের ভাষায় কথা বলে। আর সেই ভাষাই—সবচেয়ে সত্য, সবচেয়ে শুদ্ধ।
ঢাকা শহরের এক কোণে, পুরোনো এক বাড়ির নিচতলার ফ্ল্যাটে সাজানো রিনাদের সংসার। ইট-পাথরের এই শহরে প্রতিটি ঘরের নিজস্ব নিঃশ্বাস আছে, নিজস্ব গল্প আছে। আর তাদের বাড়ির এক আলাদা ঘরে রাহাত যখন এসে উঠল, তখন যেন সেই গল্পে নতুন এক অধ্যায় শুরু হলো। রাহাতের পরিবার গ্রাম থেকে শহরে এসেছিল, কিন্তু তাদের শহরে কোনো নিজস্ব ঠিকানা ছিল না। রিনার বাবার পরিচিতির সূত্র ধরে, এবং রাহাতের লেখাপড়ার সুবিধার কথা ভেবে, তারা তাকে নিজেদের ঘরেই থাকার আশ্রয় দিয়েছিলেন। রাহাত ছিল দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়, কিন্তু তার সাথে রিনা আর তার ছোট বোন রানীর সম্পর্কটা হয়ে উঠেছিল রক্তের সম্পর্কের থেকেও গভীর।
রাহাত ছিল দুরন্ত আর স্বপ্নবাজ। তার চোখে ছিল এক ভিন্ন পৃথিবী দেখার আকুলতা। গল্পের বই ছিল তার নিত্যসঙ্গী, আর ক্রিকেট ব্যাট ছিল তার প্রিয় খেলা। অন্যদিকে রিনা ছিল শান্ত, ধীর-স্থির, যেন শরতের এক ঝলক স্নিগ্ধ বাতাস। তার পড়ালেখায় ছিল অসাধারণ মনোযোগ, আর তার হাসিতে মিশে থাকত এক অদ্ভুত মাদকতা, যা রাহাতের হৃদয়কে অনবরত দোলা দিত। আর রানী, সে ছিল তাদের ছোট্ট খেলার সাথী, গোপন কথার সাক্ষী, ভালোবাসার নীরব দর্শক। রানী ছিল রিনার থেকে বছর তিনেকের ছোট, তার চোখে ছিল বড়দের রহস্যময় জগতকে বোঝার এক অনাবিল কৌতূহল।
রাহাত আর রিনার ভালোবাসার শুরুটা হয়েছিল এই একই ছাদের নিচে। সকালে একসাথে স্কুলের পথে হাঁটা, দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে এসে একই টেবিলে বসে খাওয়া, বিকেলে একসাথে পড়তে বসা সবকিছুর ভেতর দিয়েই তাদের কৈশোরের প্রেম ডানা মেলেছিল। ক্লাসনাইন থেকে তারা একই সেকশনে পড়ত। সেই সময়েই একদিন রিনা যখন গণিতের একটি জটিল সমস্যা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছিল, আর রাহাত, তার খেলার মাঝেও, কীভাবে যেন ব্যাপারটা টের পেয়েছিল। সে এগিয়ে এসেছিল, তার ভঙ্গিতে ছিল এক বন্ধুত্বপূর্ণ উদারতা। সেই প্রথম আলাপ সেই প্রথম সহানুভূতির হাতছানি থেকেই তাদের সম্পর্কের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছিল। তবে তাদের প্রেম ছিল আরও গভীর, আরও নিবিড়, কারণ তাদের জীবন একে অপরের সাথে মিশে গিয়েছিল এক অদৃশ্য সুতোয়।
রাত যখন গভীর হতো, শহরের কোলাহল যখন স্তিমিত হয়ে আসত, তখন শুরু হতো তাদের নিজস্ব জগত। রাত দুটো থেকে তিনটে পর্যন্ত চলত তাদের তিনজনের আড্ডা – রাহাত, রিনা আর রানী। রিনার ঘরের জানালা দিয়ে দেখা যেত শহরের নিভু নিভু আলো। শীতের রাতে কম্বলের নিচে গুটিসুটি মেরে, অথবা গরমের রাতে জানালার পাশে বসে, তারা তিনজন গল্প করত, স্বপ্ন দেখত, হাসত। রানী ঘুমিয়ে পড়ত মাঝেমধ্যে, তাদের গল্প শুনতে শুনতে। কিন্তু রাহাত আর রিনা জেগে থাকত, তাদের চোখে চোখে চলত নীরব কথোপকথন। সেখানে কোনো শব্দ ছিল না, ছিল শুধু অনুভূতির আদান-প্রদান। রাহাত যখন রিনার দিকে তাকাত, তার চোখে ফুটে উঠত এক অব্যক্ত ভালোবাসা। রিনা চোখ নামিয়ে নিত লাজুক ভঙ্গিতে, কিন্তু তার মনের গভীরে সেই ভালোবাসার ঢেউ তীব্র হয়ে উঠত।
তাদের প্রেম ছিল স্কুলের বেঞ্চে পাশাপাশি বসে নীরবে হাত ধরা, ক্লাসের ফাঁকে আড়চোখে একে অপরের দিকে তাকানো, আর স্কুলের ছুটির পর সাইকেল নিয়ে অনেকটা পথ একসাথে হেঁটে যাওয়া – তবে এসব কিছুতেই যুক্ত হয়েছিল একই বাড়ির ভেতরে তাদের নিভৃত moments গুলো। রাতের পর রাত জেগে তারা একে অপরের অস্তিত্ব অনুভব করত। রাহাত রিনার জন্য তার প্রিয় গল্পের বইগুলো নিয়ে আসত, আর রিনা তার নতুন আঁকা ছবিগুলো দেখাত রাহাতকে। তাদের স্বপ্ন ছিল একই সুতোয় গাঁথা – ভালো ফল করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া, তারপর দু’জনে মিলে নিজেদের একটা সাজানো সংসার গড়া, হয়তো এই একই শহরের কোনো এক প্রান্তে। রাহাত প্রায়ই বলত, "রিনা, আমরা যখন বড় হব, তখন আমাদের একটা ছোট্ট ছাদের ঘর হবে, যেখানে শুধু বই আর তোমার আঁকা ছবি থাকবে। আর রানী, সেও থাকবে আমাদের সাথে।" রিনা হাসত, তার চোখে তখন ঝলমল করত এক আকাশ স্বপ্ন। রানী হয়তো তাদের কথা পুরোপুরি বুঝত না, কিন্তু তাদের চোখের তারায় সে এক অন্যরকম জগত দেখতে পেত।
তাদের বাড়ির প্রতিটি কোণা, প্রতিটি দেয়াল যেন তাদের ভালোবাসার নীরব সাক্ষী ছিল। পুরনো বটগাছের নিচে তাদের স্কুলের গোপন আড্ডা, বিজ্ঞান ল্যাবের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে স্বপ্ন দেখা, বা বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার দিন রাহাতের জয়ের পর রিনার চোখে গর্বের আভা – এ সবকিছুই ছিল তাদের গল্পের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু সবচেয়ে মূল্যবান ছিল তাদের বাড়ির ভেতরের দিনগুলো। রাতের আড্ডায় রানী যখন ঘুমিয়ে যেত, রাহাত আর রিনা তখন ফিসফিস করে কথা বলত, তাদের নিঃশ্বাসের উষ্ণতা একে অপরের সাথে মিশে যেত। একে অপরের দিকে তাকিয়েই তারা বুঝতে পারত মনের কথা। তাদের মনে ভয় ছিল, যদি কেউ জেনে যায়! কিন্তু সেই ভয়ের মাঝেও তাদের সম্পর্কের নিবিড়তা তাদের আরও কাছে টেনে আনত, একই ছাদের নিচে থাকার দুর্লভ সুযোগ তাদের ভালোবাসাকে আরও গভীর করে তুলেছিল।
তবে জীবনের পথ সবসময় সরলরেখায় চলে না। তাদের এস.এস.সি. পরীক্ষার পরই এলো এক অপ্রত্যাশিত ঝড়। রিনার বাবা বিদেশের একটি বড় কোম্পানিতে ভালো চাকরির সুযোগ পেলেন, আর সিদ্ধান্ত নিলেন সপরিবারে অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাবেন। এই সংবাদটি ছিল রাহাতের জন্য বজ্রপাতের মতো। রিনাকে ছেড়ে যাওয়া! সে কল্পনাও করত না। শুধু রিনা নয়, রানীও চলে যাবে, যে কিনা তাদের নীরব ভালোবাসার একমাত্র সঙ্গী ছিল। রিনার চোখেও ছিল রাজ্যের বিষাদ। তারা দু’জনেই জানত, এই বিচ্ছেদ তাদের জীবনকে অন্য খাতে প্রবাহিত করবে।
যাবার আগের রাতে, রাহাত রিনার সাথে দেখা করেছিল তাদের সেই নিভৃত জানালার পাশে। সেদিন আকাশে চাঁদ ছিল না, ছিল মেঘে ঢাকা কালো অন্ধকার। রাহাত রিনার হাত ধরে বলেছিল, "রিনা, আমি বদলে যাব না। আমার মন, আমার ভালোবাসা – সব তোমার জন্য এই ঢাকা শহরেই রেখে যাব। তুমি যখন ফিরে আসবে, আমাকে ঠিক এমনটাই পাবে।" রিনা রাহাতের বুকে মাথা রেখে কেঁদেছিল। তার চোখের জলে ভিজে গিয়েছিল রাহাতের জামা। রানীও তাদের পাশে বসেছিল, তার ছোট্ট চোখেও ছিল অশ্রু। সে হয়তো পুরোপুরি না বুঝলেও, বড় বোন আর রাহাতের কষ্টটা অনুভব করছিল। রিনা বিশ্বাস করত রাহাতের কথা, কিন্তু সমুদ্রের ওপারে অনিশ্চিত এক ভবিষ্যৎ তাকে ভীত করে তুলেছিল। তারা দু’জনে প্রতিজ্ঞা করেছিল, একে অপরের জন্য অপেক্ষা করবে, যত দিনই লাগুক না কেন।
রিনা তার পরিবার সহ অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেল। রাহাত থেকে গেল ঢাকায়, একাকী তাদের সেই পুরোনো বাড়িতে। তাদের ঘরটা এখন শূন্য, তাদের রাতের আড্ডা বন্ধ। শহরের কোলাহল আর স্কুলের পুরনো স্মৃতিগুলো তাকে অনবরত তাড়া করত, কিন্তু সবচেয়ে বেশি মনে পড়ত তাদের সেই নিভৃত রাতগুলো। রিনার চলে যাওয়ার পর, রাহাতের কাছে সেই ঘরটা যেন এক বিশাল শূন্যতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। বুকচেরা এক হাহাকার তার নিত্যসঙ্গী হলো। প্রথম কয়েকমাস ইমেইল আর ফোন কলের মাধ্যমে তাদের যোগাযোগ বজায় থাকলেও, ধীরে ধীরে তা কমতে শুরু করল। অস্ট্রেলিয়ার নতুন জীবন রিনাকে ঘিরে ধরল তার নিজস্ব গতিতে। নতুন স্কুল, নতুন বন্ধু, নতুন সংস্কৃতি – সব মিলিয়ে সে এক নতুন জগতে পা রাখল। রাহাতের মনে হতো, রিনার ব্যস্ততা কি তার ভালোবাসা কমিয়ে দিচ্ছে? নাকি এটাই সময়ের নিয়ম? প্রতিটা ইমেইল পাঠানোর আগে সে বারবার শব্দগুলো যাচাই করত, যেন তার আবেগ কোনোভাবে রিনার নতুন জীবনের বাঁধ সাধতে না পারে। কিন্তু অপর প্রান্তে রিনার উত্তর আসতে সময় লাগত, কখনও শুধু সংক্ষিপ্ত উত্তর। রাহাত বুঝতে পারত, দূরত্ব কেবল ভৌগোলিক নয়, মানসিকভাবেও এক অদৃশ্য প্রাচীর গড়ে তুলছে তাদের মাঝে।
রাহাতের হাতে এখন কেবল রিনার একটি পুরনো ছবি আর তাদের পুরনো বাড়ির স্মৃতি। সেই ছবিটা ছিল তাদের সেই রাত দুটোর আড্ডার এক নীরব সাক্ষী। রাহাত নিজেকে পড়ালেখায় আরও বেশি মগ্ন করল। সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো স্থাপত্য বিভাগে, তার স্বপ্ন ছিল শহরের সবচেয়ে সুন্দর দালানগুলো তৈরি করার। তার মনে হতো, যদি সে সফল হতে পারে, তবে হয়তো রিনা ফিরে আসবে, তাদের ভালোবাসা আবার নতুন করে শুরু হবে। এই স্বপ্নই ছিল তার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। প্রতিটি পরীক্ষায় ভালো ফল করা, প্রতিটি ডিজাইনকে শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া – সবকিছুই যেন রিনার কাছে নিজের ভালোবাসার প্রমাণ দেওয়ার এক নীরব প্রচেষ্টা ছিল। তার বন্ধুরা তাকে হাসিখুশি দেখতে পেলেও, তার ভেতরের কষ্টটা ছিল একান্তই তার নিজের। রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ত, সে রিনার ছবিটা দেখত, আর মনে মনে কথা বলত – "আমি তো বদলাইনি, রিনা। তুমি কি আজও তেমনই আছো?"
ওদিকে রিনার জীবনও নিজের গতিতে চলছিল। অস্ট্রেলিয়ার ঝলমলে আলো, আধুনিক জীবন তাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করতে শুরু করল। নতুন ভাষা, নতুন জীবনধারা, নতুন আকাঙ্ক্ষা। রাহাতের সাথে যোগাযোগ রাখাটা একসময় তার কাছে পুরোনো অভ্যাসের মতো মনে হতে শুরু করল। তার মনে এক ধরণের অপরাধবোধ কাজ করত – সে কি রাহাতকে ভুলে যাচ্ছে? সে কি বদলে যাচ্ছে? কিন্তু নতুন জীবনের চ্যালেঞ্জগুলো তাকে এতোটাই ব্যস্ত করে তুলত যে, রাহাতের জন্য পুরোনো আবেগগুলো ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছিল। রানী, ছোট হলেও, তাদের এই দূরত্বটা বুঝতে পারত। সে মাঝে মাঝে রিনাকে রাহাতের কথা মনে করিয়ে দিত, কিন্তু রিনা তখন কেবল নীরব থাকত। হয়তো সে নিজেও জানত না তার মনে কী চলছে। একসময় তাদের ফোন কল বন্ধ হয়ে গেল, ইমেইলও পাঠানো হতো না। মাঝেমধ্যে ফেসবুকে রাহাতের পোস্ট দেখলে রিনা চুপ করে দেখত, কিন্তু কোনো মন্তব্য বা বার্তা দিত না। তাদের সম্পর্কটা যেন এক নীরব অধ্যায়ে প্রবেশ করল, যেখানে যোগাযোগের মাধ্যম ছিল কেবল স্মৃতি আর একরাশ অনুদ্দেশ্য।
রাহাত জানত, রিনার জীবনে নতুন মানুষ আসতে পারে, নতুন স্বপ্ন তৈরি হতে পারে। এই বাস্তবতাকে সে মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল। সে নিজেকে বোঝাত, হয়তো এটাই নিয়তি। তার মনে একটি বিশ্বাস স্থির ছিল – তার ভালোবাসা বদলায়নি। তার ভেতরে সেই স্কুলের রাহাতটা তখনও বেঁচে ছিল, যে রিনাকে গভীর ভালোবেসেছিল। কিন্তু এই ভালোবাসার কোনো প্রকাশ ছিল না, ছিল কেবল নীরব অপেক্ষা। সে অপেক্ষা করত, হয়তো একদিন রিনা ফিরে আসবে, আর তাকে নতুন করে চিনতে পারবে। এই দূরত্ব তাদেরকে শারীরিক ভাবে অনেক দূরে ঠেলে দিলেও, রাহাতের মনের গভীরে রিনার স্থানটা ছিল অপরিবর্তিত। প্রতিটি ইট-পাথরের মাঝে, প্রতিটি ডিজাইন করা দালানে সে রিনার ছায়া খুঁজে পেত।
কয়েক বছর পর, রাহাত একজন প্রতিষ্ঠিত স্থপতি হিসেবে পরিচিতি পেল। তার ডিজাইন করা ইমারতগুলো শহরের সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলল। তার নামডাক সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল। তার জীবন এখন বিলাসবহুল, তার কাছে এখন সব আছে, যা সে একসময় স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু তার মন আজও সেই স্কুলের সহজ-সরল রাহাতই আছে, যে রিনাকে ভালোবেসেছিল।
রাহাত তার পুরনো স্কুল প্রাঙ্গণে প্রায়ই যেত, আর প্রায়ই যেত রিনাদের সেই পুরোনো বাড়িতে, যেখানে সে একসময় থাকত। পুরনো স্মৃতিগুলো তাকে তাড়া করত। প্রতিটি ক্লাস রুম, প্রতিটি করিডোর, বটগাছের ছায়া – সবখানে সে রিনার উপস্থিতি অনুভব করত। আর রিনাদের বাড়িতে প্রতিটি ঘর, প্রতিটি জানালার কোণা যেন তার বুকে এক নীরব দীর্ঘশ্বাস ফেলে যেত। সে তার স্কুল জীবনের বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রাখত, কিন্তু রিনার খোঁজ সে কখনও সরাসরি নিত না। তার মনে হতো, যদি রিনা সুখে থাকে, তবে তাকে আর Disturb করা উচিত নয়।
একদিন, স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের একটি পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে রাহাত যোগ দিল। অনেক পুরনো বন্ধুকে দেখে তার মন আনন্দে ভরে উঠল। আড্ডার মাঝে হঠাৎ তার চোখ খুঁজে ফিরছিল একটি পরিচিত মুখ। রিনা। সে কি আসবে? রাহাত জানত না। তার বুকে তখন এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি।
সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। রাহাত মঞ্চের এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিল, যখন তার পাশে এক নরম স্পর্শ অনুভব করল। রিনা! সময়ের সাথে তার চেহারায় পরিপক্কতা এলেও, রাহাত তাকে চিনতে পারল এক মুহূর্তেই। সেই একই কাজল-টানা চোখ, সেই একই শান্ত হাসি। তবে এবার তার পাশে ছিল রানী, যে এখন আর ছোট্টটি নেই, সেও পরিণত এক নারী।
"তুমি এসেছ?" রিনা শান্ত কন্ঠে বলল। তার কন্ঠে ছিল এক চাপা আবেগ।
রাহাত তার দিকে তাকাল। তার চোখে ছিল এক গভীর আবেগ, যা এতোদিন ধরে পুষে রেখেছিল। "আমি তো কোনোদিন যাইনি, রিনা। আমার মন তো সবসময় এখানেই ছিল।"
রিনার চোখে জল এসে গেল। তার পাশে থাকা রানীও আবেগাপ্লুত হয়ে উঠল। "আমি ভুল বুঝেছিলাম, রাহাত। আমি ভেবেছিলাম তুমি বদলে গেছ।"
"আমি বদলে যাইনি, রিনা। আমার জীবন হয়তো বদলেছে, কিন্তু আমার ভালোবাসা আজও তেমনই আছে। আমি সেই রাহাতই আছি, যে এই স্কুলের বটগাছের নিচে তোমাকে কথা দিয়েছিল কোনোদিন ছেড়ে যাবে না, যে একই ছাদের নিচে রাত দুটোর আড্ডায় তোমার চোখে চোখ রেখে নীরব কথা বলত।"
তাদের মধ্যে কোনো দীর্ঘ কথোপকথন হলো না। শুধু নীরব চোখের ভাষা। রিনা বুঝতে পারল, রাহাত সত্যিই বদলায়নি। তার সাফল্য তাকে তার শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করেনি, তার ভেতরের সরল ভালোবাসা আজও অমলিন। তাদের ভালোবাসার বাঁধন আজও অক্ষুণ্ণ। হয়তো তাদের জীবনের পথ ভিন্ন দিকে গেছে, হয়তো তারা এখন ভিন্ন ভিন্ন পৃথিবীতে বসবাস করে, কিন্তু তাদের হৃদয়ের সংযোগ আজও অটুট। রানীর চোখেও ছিল এক অদ্ভুত মুগ্ধতা, সে যেন তাদের সেই নীরব ভালোবাসার গল্পটা আবার নতুন করে অনুভব করল।
অনুষ্ঠান শেষ হতেই রিনা ও রানী বিদায় নিল। রাহাত তাদের ডাকল না। কারণ সে জানত, কিছু গল্প অসম্পূর্ণই সুন্দর। কিছু সম্পর্ক নীরব অধ্যায় হয়েই রয়ে যায়, কিন্তু তাদের গভীরতা সময়ের সাথে আরও স্পষ্ট হয়। কিন্তু পুনর্মিলনীর সেই নীরব সাক্ষাতের পর তাদের দূরত্ব আরও বেড়ে গেল। সেদিনের চোখে চোখে যেটুকু ভাষা বিনিময় হয়েছিল, তা কেবল এক ঝলক আশা জাগিয়েছিল, কিন্তু তার পর তা আবার হারিয়ে গেল এক গভীর শূন্যতায়।
এর পর বহুবার রাহাতের সাথে রিনার দেখা হয়েছে পারিবারিক বা সামাজিক অনুষ্ঠানে। কখনো কোনো দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বিয়েতে, কখনো বা কোনো পারিবারিক দাওয়াতে। রাহাত যখন প্রবেশ করত, রিনার চোখ এক পলকের জন্য তার দিকে যেত, কিন্তু পরক্ষণেই সে তা ফিরিয়ে নিত। রাহাতও একইভাবে রিনাকে দেখত, আর মনে মনে তার পরিবর্তনগুলো বোঝার চেষ্টা করত। রিনার চেহারায় এখন এক নতুন দৃঢ়তা এসেছে, যা রাহাতের চেনা রিনার সাথে পুরোপুরি মেলে না। সে নিজেকে আরও বেশি গুটিয়ে নিয়েছে। রানী অবশ্য রাহাতের সাথে কথা বলত, তাদের ছোটবেলার স্মৃতিচারণ করত। কিন্তু রানী নিজেও বুঝতে পারত, রিনা আর রাহাতের মাঝখানে এক অদৃশ্য প্রাচীর তৈরি হয়েছে, যা ভেঙে ফেলার সাহস কারো নেই।
একবার রিনার এক চাচাতো বোনের গায়েহলুদ অনুষ্ঠানে রাহাত ও রিনা দু'জনই উপস্থিত ছিল। হলুদ শাড়িতে রিনাকে অপূর্ব লাগছিল, কিন্তু তার মুখে হাসি ছিল না। রাহাত দূর থেকে রিনাকে দেখছিল, তার ভেতরে এক অদ্ভুত অস্থিরতা কাজ করছিল। সে চেয়েছিল এগিয়ে গিয়ে কথা বলতে, তার মনের সব না বলা কথাগুলো বলে দিতে। কিন্তু তার পা যেন আর চলছিল না। রিনা সেদিকে না তাকিয়ে তার বন্ধুদের সাথে কথা বলছিল, হাসছিল, কিন্তু রাহাতের চোখে সেই হাসি ছিল এক ধরণের কৃত্রিমতা। রাতের আড্ডার সেই সরল হাসি আর তার মুখে দেখা যেত না। রাহাত শুধু দেখেই গিয়েছিল, তার চোখ দিয়ে যেন শত অভিযোগ আর ভালোবাসা রিনার দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছিল। রিনাও হয়তো তা অনুভব করত, কিন্তু সে ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখত। তাদের মাঝের নীরবতা এতটাই স্পষ্ট ছিল যে, পাশের লোকজনও তা টের পেত।
তাদের বিচ্ছেদের এই নীরব অধ্যায় চলতে লাগল। রাহাত ও রিনা দুজনেই জানত, তাদের ভালোবাসা এখনও আছে, কিন্তু তা আর প্রকাশের কোনো পথ খুঁজে পায় না। বছরের পর বছর কেটে গেল, তারা দুজনেই নিজেদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হলো। রাহাত শহরের নামকরা স্থপতি, আর রিনা হয়তো অস্ট্রেলিয়াতে নিজের এক নতুন জগৎ তৈরি করে নিয়েছে। মাঝে মাঝে পুরনো বন্ধুদের আড্ডায় তাদের কথা উঠত, কিন্তু কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারত না রিনা এখন কেমন আছে। রাহাত শুধু শুনত, আর তার ভেতরে সেই পুরনো স্মৃতিগুলো যেন এক নতুন মোড় নিত।
রাহাত তার পুরনো ডায়েরিটা আজও সযত্নে রেখে দিয়েছে। সেখানে রিনার হাতে লেখা কিছু চিঠি, তাদের একসাথে তোলা কিছু ঝাপসা ছবি। রাতের নিস্তব্ধতায়, যখন শহরের সব আলো নিভে যায়, রাহাত ডায়েরির পাতা ওল্টায়। প্রতিটি অক্ষরে, প্রতিটি ছবিতে সে রিনাকে খুঁজে ফেরে। তার মনে হয়, রিনা কি আজও সেই রাত দুটোর আড্ডার কথা মনে রাখে? সে কি আজও জানে, রাহাত বদলায়নি? এই প্রশ্নগুলো তার মনে এক চাপা কষ্ট হয়ে বিচরণ করে।
এক সন্ধ্যায়, রাহাত তার নির্মিত এক বিশাল দালানের ছাদ থেকে শহরের দিকে তাকিয়ে ছিল। আলো ঝলমলে শহরের বুকে তার স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু তার মনে তখনো এক শূন্যতা। তার পাশে তখন কেউ ছিল না, কেবল একাকীত্ব। হঠাৎ তার চোখ পড়ল দূরের এক জানালার দিকে, যেখানে একসময় রিনা আর রানী রাত জাগত। সে দেখল, জানালার পাশে এখনো কোনো এক দম্পতি রাত জেগে গল্প করছে। তার মনে হলো, ভালোবাসা হয়তো এভাবেই এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে বয়ে চলে, কেবল রূপ বদলায়, কিন্তু তার অস্তিত্ব কখনও ফুরিয়ে যায় না।
রাহাতের ভালোবাসা রিনার জন্য আজ আর কোনো দাবি রাখে না, শুধু এক গভীর শ্রদ্ধাবোধ আর নীরব স্মৃতিচারণ। সে জানে, রিনা যেখানেই থাকুক না কেন, সুখে থাকুক। তাদের সম্পর্কের এই নীরব অধ্যায়টি তাদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান অংশ হয়ে থাকবে, যা তাদের দুজনকে অদৃশ্য এক সুতোয় বেঁধে রেখেছে। এই ভালোবাসা অপ্রকাশিত, অকথিত, কিন্তু চিরন্তন। রাহাত আজও সেই রাহাতই আছে, যে রিনাকে ভালোবেসেছিল। সে বদলায়নি। তার ভালোবাসা বদলায়নি। তাদের গল্পটা শহরের কোলাহলে মিশে গেলেও, তাদের দু’জনের হৃদয়ে তা চিরকাল এক নীরব অধ্যায় হয়ে থাকবে, যেখানে রাত দুটোর আড্ডার নীরব কথোপকথনগুলো আজও জীবন্ত, আর প্রতিটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে তাদের চোখে চোখে চলা নীরব বার্তাও। এই নীরবতাই তাদের ভালোবাসার সবচেয়ে গভীর প্রকাশ, যা কোনোদিন শব্দ খুঁজে পায়নি, কিন্তু অনুভবে তার অস্তিত্ব আজও বিদ্যমান।
সময় চলে যায়। স্মৃতি রয়ে যায়। মানুষ বদলে যায়, জীবন এগিয়ে যায়, শহরের আলো নিভে যায়, আবার জ্বলে ওঠে। কিন্তু কিছু অনুভব থেকে যায় ঠিক আগের জায়গায়, অবিচল। রাহাতের ভালোবাসা যেমন। সময় তাকে বুড়ো করে দিলেও, অভিজ্ঞতা তাকে পরিণত করলেও, রিনার জন্য তার ভেতরের সেই নিঃশব্দ অনুভবটি আজও ঠিক আগের মতোই আছেঅটুট, অপরিবর্তনীয়।
সে কোনোদিন রিনাকে চিঠি লেখেনি, মেসেজ পাঠায়নি, কিংবা পুরনো ছবি খুলে দেখেওনি বহুদিন। অথচ, প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙার পর অথবা রাত গভীর হলে, তার ভিতরে এক নিঃশব্দ আলো জ্বলে ওঠেরিনার স্মৃতির আলো, যা কোনোদিন নিভে যায় না। এমন ভালোবাসা হয়তো অনেকেই দেখে না, বোঝে না, এমনকি তার অস্তিত্বকেও অস্বীকার করে। কিন্তু সে তো থেকেই যায়সেই ভালোবাসা, যে কারো চোখে পড়ে না, কিন্তু যে হৃদয়ে জায়গা করে নেয় চিরদিনের মতো।
রিনা জানত কি না, রাহাত তাকে আজও ভালোবাসেতা কেউ জানে না। কিন্তু তাতে কি ভালোবাসা থেমে যায়? ভালোবাসা কি প্রতিদানেই পরিপূর্ণতা পায়? নাকি সে নিজেই এক পূর্ণতা, যদি সে হয় নিঃস্বার্থ ও নিঃশব্দ?
এই প্রশ্নই আজ আমাদের ভাবিয়ে তোলে। সমাজ আমাদের শিখিয়েছে, ভালোবাসা মানেই একসাথে থাকা, প্রেম মানেই শব্দে প্রকাশ, চিহ্নে দৃশ্যমান। কিন্তু রাহাত ও রিনার গল্প তার সম্পূর্ণ বিপরীত। তারা ভালোবেসেছে একে অপরকে নীরবে, এমনভাবে যা চোখে দেখা যায় না, মুখে বলা যায় না, তবুও হৃদয়ে অনুভব করা যায় চিরকাল।
আজও কোনো এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে, যখন সবাই ব্যস্ত হাসি-আড্ডায়, তখন হয়তো রাহাত এক কোণে চুপ করে বসে থাকে, আর দূরে কোথাও রিনাকে দেখে ফেলে। তাদের চোখাচোখি হয় মাত্র এক সেকেন্ড, কিন্তু সেই সেকেন্ডটি যেন সময়কে থামিয়ে দেয়। কোনো কথা নেই, কোনো অভিব্যক্তিও নয়শুধু চোখের ভাষায় ঘটে যায় এক গভীর বার্তা আদান-প্রদান। এই এক মুহূর্তেই যেন তারা ফিরে যায় বহু বছর পেছনে, সেই নির্ঝঞ্ঝাট সময়টিতে, যখন ভালোবাসা ছিল বিশুদ্ধ, অব্যক্ত, আর পরিপূর্ণ।
রিনাও হয়তো সেই মুহূর্তে মনে মনে ভাবে"তুই আজও ঠিক আগের মতোই আছিস রাহাত!" কিন্তু সে কিছু বলে না, কারণ তার জীবনে এখন বহু সম্পর্ক, বহু বাধ্যবাধকতা। তবুও, এই চোখে চোখে কথা বলা যেন এক গোপন কবিতা, যেটা তারা দুজনই মনে মনে পড়ে যায়, প্রতিবার দেখা হলে।
আপনি, আমি, আমরাএই পাঠকরাআমরাও কি এমন কোনো সম্পর্কের ভেতর দিয়ে যাইনি কোনো এক সময়ে? যেখানে ভালোবাসা ছিল, কিন্তু বলা হয়নি? যেখানে অনুভব ছিল, কিন্তু প্রকাশ পাইনি? এমন কেউ কি নেই, যাকে এখনো আমরা ভাবি, কিন্তু কখনো জানাইনি?
তাহলে প্রশ্নটা উঠবেইভালোবাসা কি প্রকাশে শক্তিশালী, না নীরবতায়? ভালোবাসার কি চিহ্ন লাগে, না অনুভবই যথেষ্ট? আমরা প্রতিদিন ভালোবাসি, আবার ভুলে যাই, আবার নতুন করে ভালোবাসি। কিন্তু এমন কিছু অনুভব থাকে, যা কোনোদিন চাইলেও মুছে যায় না। কারণ, তা গেঁথে থাকে আমাদের অস্তিত্বের গভীরে।
রাহাত আর রিনার মতো সম্পর্ক হয়তো সমাজের চোখে অসম্পূর্ণ, কিন্তু হৃদয়ের চোখেতা-ই সবচেয়ে নিখুঁত। তারা কারো হয়নি, কিন্তু একে অপরের হৃদয়ে চিরকাল আছে। নেই কোনো দাবি, নেই কোনো অপেক্ষাআছে শুধু শ্রদ্ধা, স্মৃতি আর সেই অনুচ্চারিত ভালোবাসা, যা আজও বেঁচে আছে, নিঃশব্দে।
পাঠক, এখন আপনি নিজেই ভাবুনআপনার জীবনেও কি এমন কোনো "নীরব অধ্যায়" আছে, যা আপনি কাউকে কোনোদিন বলেননি, অথচ আজও বুকের গভীরে চেপে রেখেছেন? যদি থাকে, তবে জেনে রাখুন, আপনি একা নন। এই পৃথিবীর সবচেয়ে নিখুঁত ভালোবাসাগুলোই হয়তো অপ্রকাশিত থাকে, কিন্তু তাদের সত্যতা কোনোদিন মরে না।
নীরব ভালোবাসা, অপ্রকাশিত প্রেম, বাংলা গল্প, আবেগঘন সম্পর্ক, হৃদয়স্পর্শী উপন্যাস, রাহাত রিনা, বাংলা সাহিত্য।
🌸 আপনার মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ!
আপনার মতামত আমাদের অনুপ্রাণিত করে এবং আগামীতে আরও মানসম্পন্ন কনটেন্ট তৈরিতে সহায়তা করে।
আপনি যদি কোনো নির্দিষ্ট বিষয় বা গল্প পছন্দ করে থাকেন, জানালে ভালো লাগবে।
নিয়মিত পাশে থাকুন — আপনার সহযোগিতা ও ভালোবাসাই আমাদের এগিয়ে চলার শক্তি।
শুভ কামনায়,
✍️ কল্পকথা-৩৬০ ব্লগ টিম
https://kalpakatha360.blogspot.com