ভাবুন বাংলাদেশটা একটা শরীর। হৃদপিণ্ডটা ঢাকায় টাকার জোরে ধকধক করে কিন্তু হাত–পা গুলো চর হাওর পাহাড়ের গ্রামগুলো রক্ত পায় টপটপ করে কষ্টে। শহরের অ্যাম্বুলেন্সে সাইরেন বাজে আর দূরের নৌকায় ইঞ্জিনটা বারবার বন্ধ হয়ে যায়একই দেশের দুইটা শব্দ দুইটা ভাগ্য। এই শরীরের কোথাও জ্বর উঠলে স্টেথোস্কোপটা রাখা হয় শহরের বুকে; পায়ের গোড়ালিটা গ্রাম নীরবেই ফুলে থাকে।
একই সকাল দুই বাংলাদেশ। মিরপুরের গলিতে মানুষ ডাক্তারের কেবিনে টোকা দেয়; কুড়িগ্রামের চরে কেউ নদীর স্রোত কমার অপেক্ষায় থাকে। শহরে বেড নাইকিন্তু চিকিৎসা আছে; গ্রামে চিকিৎসা নাইতবু বিছানা ফাঁকা। কেমন করে একই অসুখ দুই ঠিকানায় দুইটা আলাদা বাক্য হয়ে যায়? কেন প্রেসক্রিপশন কখনো কখনো ঋণপত্রে বদলে যায়? কেন ডাক্তারদের মানচিত্রে আলো বেশি জমে আছে কয়েকটা জেলায় আর বাকিটা ছায়া?
গাইবান্ধার এক বিচ্ছিন্ন চরে বাস করেন করিম শেখ বয়স পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই। ব্রহ্মপুত্রের ভাঙাগড়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকা এই মানুষটির বুকের ভেতর কয়েক মাস ধরে এক অচেনা ভাঙন শুরু হয়েছে। চিনচিনে ব্যথাটা এখন আর দিনে-রাতে মানে না; কখনও মনে হয় বুকের ভেতর কেউ যেন লাল-গরম লোহা চেপে ধরেছে। রাতের নিস্তব্ধতায় যখন ব্যথার তীব্রতায় ঘুম ভেঙে যায় তখন খোলা জানালা দিয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে তার মনে হয় এই নদী যেমন কেড়ে নেয় ঘরবাড়ি তেমনি বুকের এই ব্যথাটাও হয়তো কেড়ে নেবে তার জীবন। গ্রামের বাজারের ওষুধের দোকানদার যাকে সবাই বড় ডাক্তার বলে জানে তিনি ভরসা দিয়ে বলেছেন ও কিছু না গ্যাসের সমস্যা। কিন্তু করিম শেখের মন মানে না। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যেতে হলে ভোর থাকতে নৌকায় উঠতে হবে তারপর ভাঙাচোরা রাস্তায় ভ্যানের ঝাঁকুনি। একদিনের কামাই বন্ধ যাতায়াত আর ডাক্তার দেখানোর খরচ মিলিয়ে প্রায় হাজার টাকার ধাক্কা। তাই তিনি ব্যথাটাকে নিয়তি হিসেবে মেনে নিয়েছেন ঠিক যেমন চরের মানুষ বন্যার জলকে প্রতি বছর মেনে নেয়।
এর ঠিক উল্টো চিত্র রাজধানী ঢাকার এক ঘিঞ্জি বস্তিতে। এখানে বাস করেন আয়েশা বেগম। তার সাত বছরের শিশু রিফাতের শরীরটা কয়েক দিন ধরে জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। থার্মোমিটারে পারদ ১০৩ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেছে। আয়েশা সন্তানের কপালে ভেজা কাপড়ের পট্টি দিতে দিতে মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন। বাসার কাছেই দেশের অন্যতম বড় সরকারি হাসপাতাল কিন্তু তার বিশাল ফটক আয়েশার কাছে বিভীষিকার মতো মনে হয়। সকাল থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে শত শত মানুষের ভিড় আর ধাক্কা সামলে বহির্বিভাগের টিকিট পাওয়াটাই এক যুদ্ধ। করিডোর উপচে পড়া ভিড় অসুস্থ মানুষের কাতরানি আর ওষুধের তীব্র গন্ধে মাথা ঝিমঝিম করে। অবশেষে যখন ডাক্তারের দেখা মেলে তখন তিনি ক্লান্ত চোখে রিফাতকে একনজর দেখেই একগাদা পরীক্ষার তালিকা ধরিয়ে দেন। সরকারি হাসপাতালে এসব পরীক্ষা করাতে গেলে সিরিয়াল মিলবে সপ্তাহখানেক পর। আয়েশার স্বামী রিকশাচালক একদিন আয় না করলে চুলোয় হাঁড়ি চড়ে না। বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যাওয়ার কথা তিনি দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেন না। তাই জ্বরে নিস্তেজ হয়ে পড়া সন্তানকে বুকে জড়িয়ে আয়েশা এক গভীর অসহায়ত্বে ডুবে যান।
করিম শেখ এবং আয়েশা বেগমদুজন ভিন্ন ভূগোল ভিন্ন জীবনের বাসিন্দা হলেও তাদের গল্পটা একই সুতোয় গাঁথা। এ গল্প বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার যা কাগজে-কলমে সার্বজনীন হলেও বাস্তবে শহর আর গ্রামের জন্য দুটি ভিন্ন পৃথিবী তৈরি করেছে। এটি একটি স্বাস্থ্যহীন ব্যবস্থার গল্প যেখানে অসুস্থতা শুধু শারীরিক যন্ত্রণা নয় বরং একটি পরিবারকে অর্থনৈতিক ও মানসিকভাবে পঙ্গু করে দেওয়ার এক নির্মম চক্রান্ত।
একটি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তার নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রের অঙ্গীকারের সবচেয়ে বড় প্রতিচ্ছবি। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেই প্রতিচ্ছবিটা বেশ ঘোলাটে এবং ক্ষতবিক্ষত। এর পেছনের কারণগুলো কোনো একক দায়িত্বে সীমাবদ্ধ নয় বরং একটি জটিল জালের মতো একে অপরের সাথে জড়িত।
একটি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার শক্তি নির্ভর করে তার অর্থনৈতিক বরাদ্দের ওপর। বাংলাদেশে এই বরাদ্দ হতাশাজনকভাবে কম যা মোট জাতীয় উৎপাদনের (GDP) মাত্র ২.৫ শতাংশের কাছাকাছি। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী এই হার কমপক্ষে ৫ শতাংশ হওয়া উচিত। এই বাজেটীয় অপুষ্টির কারণে হাসপাতালের জীর্ণশীর্ণ ভবনগুলো নতুন হয় না মরিচা পড়া বেডে নতুন চাদর জোটে না এবং সবচেয়ে বড় কথা যারা এই ব্যবস্থার প্রাণসেই ডাক্তার ও নার্সদের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দেওয়া সম্ভব হয় না। ফলে পুরো ব্যবস্থাটি একটি দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টিতে ভুগতে থাকে যার প্রভাব সরাসরি পড়ে সাধারণ মানুষের ওপর।
সরকারি বরাদ্দ কম হওয়ায় চিকিৎসার খরচের এক বিশাল বোঝা চাপে সাধারণ মানুষের কাঁধে। একে বলা হয় আউট-অব-পকেট এক্সপেন্ডিচার বা নিজের পকেট থেকে খরচ। বাংলাদেশে চিকিৎসার জন্য খরচ হওয়া প্রতি ১০০ টাকার মধ্যে প্রায় ৭৪ টাকাই আসে রোগীর পরিবার থেকে যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। এর মানে হলো একটি বড় ধরনের অসুস্থতা যেমনক্যান্সার হৃদরোগ বা কিডনি বিকল হওয়াএকটি মধ্যবিত্ত পরিবারকে দারিদ্র্যসীমার নিচে ঠেলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। মানুষ শেষ সম্বল জমিটুকু বিক্রি করে স্ত্রীর গয়না বন্ধক রাখে কিংবা চড়া সুদে ঋণ নেয় শুধু প্রিয়জনের চিকিৎসা করানোর জন্য। অনেক সময় খরচের ভয়ে মানুষ চিকিৎসাই শুরু করে না যা একটি ছোট রোগকে সময়ের সাথে সাথে ভয়াবহ করে তোলে। এই আউট-অব-পকেট খরচ যেন এক নীরব মহামারী যা প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ পরিবারকে নিঃস্ব করে দিচ্ছে।
বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় ডাক্তার নার্স এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা অনেক কম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুযায়ী প্রতি ১০০০০ মানুষের জন্য প্রায় ৪৪.৫ জন স্বাস্থ্যকর্মী থাকা প্রয়োজন যেখানে বাংলাদেশে এই সংখ্যা মাত্র ৯.৯ এর কাছাকাছি।
কিন্তু সংখ্যার চেয়েও ভয়াবহ হলো এর বণ্টনের বৈষম্য। দেশের প্রায় ৩৫ শতাংশ ডাক্তার এবং ৩০ শতাংশ নার্স কর্মরত আছেন শুধু ঢাকা চট্টগ্রাম রাজশাহী ও খুলনার মতো বড় শহরগুলোতে যেখানে দেশের মাত্র ১৫ শতাংশ মানুষের বাস। এর অর্থ দেশের যে বিশাল গ্রামীণ জনগোষ্ঠী তাদের জন্য স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা নিতান্তই অপ্রতুল। গ্রামে প্রতি ১০০০০ মানুষের জন্য যেখানে মাত্র ১.১ জন ডাক্তার পাওয়া যায় শহরে সেই সংখ্যা প্রায় ১৮.২ জন। ডাক্তাররা গ্রামে যেতে চান না কারণ সেখানে নেই নিরাপদ আবাসন সন্তানদের জন্য ভালো স্কুল কিংবা পেশাগত উন্নতির সুযোগ। ফলে গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো প্রায়ই ডাক্তারশূন্য থাকে আর শহরের হাসপাতালগুলো থাকে অতিরিক্ত চাপে জর্জরিত।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় ক্ষতটি হলো শহর এবং গ্রামের মধ্যকার আকাশ-পাতাল বৈষম্য। শহরের জৌলুসের আড়ালে যেমন আছে বস্তির হাহাকার তেমনি গ্রামের শান্ত প্রকৃতির মাঝে লুকিয়ে আছে চিকিৎসার জন্য নীরব আর্তনাদ।
গ্রামের মানুষের জন্য হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছানোই চিকিৎসার প্রথম এবং সবচেয়ে কঠিন ধাপ। ভাঙা রাস্তা বর্ষায় নৌকার অনিশ্চয়তা এবং অ্যাম্বুলেন্সের মতো জরুরি পরিষেবার অভাবএসব মিলিয়ে একজন মুমূর্ষু রোগীকে হাসপাতালে নিতে নিতেই মূল্যবান সময় হারিয়ে যায়। প্রসবকালীন জটিলতায় ভোগা একজন মা কিংবা হার্ট অ্যাটাকের রোগীকে যখন খাটিয়ায় করে মাইলের পর মাইল হেঁটে হাসপাতালে নেওয়া হয় তখন আধুনিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যেন পরিহাসের মতো শোনায়।
সুনামগঞ্জের হাওর এলাকার মেয়ে জমিলা। ১৯ বছর বয়সেই দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম দিতে চলেছেন। মাঝরাতে প্রসব বেদনা উঠলে গ্রামের দাই এসে হাল ধরেন। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পার হলেও যখন সন্তানের আগমন ঘটল না তখন দাইয়ের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। তিনি জানিয়ে দিলেন অবস্থা ভালো না হাসপাতালে নিতে অইব। কিন্তু এই ভরা বর্ষায় রাতের আঁধারে হাওরে নৌকা পাওয়া মানে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া। ভোরের আলোর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। ভোরের দিকে একটি মাছ ধরার নৌকায় যখন জমিলাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দিকে রওনা করানো হলো তখন তিনি ব্যথায় জ্ঞান হারানোর মতো অবস্থায়। দীর্ঘ নৌপথ আর তারপর ভাঙা রাস্তায় ভ্যানের ঝাঁকুনি সহ্য করে হাসপাতালে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর গড়িয়ে গেল। ডাক্তাররা জানালেন অনেক দেরি হয়ে গেছে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মা ও শিশু দুজনই চরম ঝুঁকিতে। জমিলার এই একার লড়াই বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এটিই বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের হাজারো মায়ের প্রতিচ্ছবি যেখানে একটি জীবন বাঁচানোর যুদ্ধ শুরু হয় হাসপাতাল খোঁজার লড়াই দিয়ে।
গ্রামে স্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকলেও ২৪ ঘণ্টা ডাক্তার পাওয়া প্রায় অসম্ভব। তাই মানুষের প্রথম ভরসার জায়গা হয়ে ওঠে স্থানীয় ওষুধের দোকানদার বা গ্রাম্য ডাক্তার। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই তারা অ্যান্টিবায়োটিক থেকে শুরু করে স্টেরয়েডসবকিছুই দিয়ে থাকেন। এতে রোগ সাময়িকভাবে চাপা পড়লেও দীর্ঘমেয়াদে তা রোগীর জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করে বিশেষ করে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের মতো নীরব ঘাতকের জন্ম দেয়।
তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য কমিউনিটি ক্লিনিক একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। দেশজুড়ে প্রায় পনেরো হাজার ক্লিনিক প্রাথমিক চিকিৎসা ও পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এর বাস্তবতা মিশ্র। অনেক ক্লিনিকে প্রয়োজনীয় ওষুধের অভাব স্বাস্থ্যকর্মীর অনুপস্থিতি এবং রোগ নির্ণয়ের যন্ত্রপাতির স্বল্পতা এর কার্যকারিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। রেফারেল সিস্টেম বা উন্নত চিকিৎসার জন্য রোগীকে সঠিক জায়গায় পাঠানোর প্রক্রিয়াটি দুর্বল হওয়ায় রোগীরা প্রায়ই দিশেহারা হয়ে পড়েন।
শহরে বড় বড় হাসপাতাল ক্লিনিক এবং বিশেষজ্ঞ ডাক্তারসবই আছে। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। সরকারি হাসপাতালগুলোর বহির্বিভাগ থেকে শুরু করে ওয়ার্ড পর্যন্ত শুধু মানুষের ভিড়। একজন ডাক্তারকে দিনে শত শত রোগী দেখতে হয় যেখানে প্রত্যেক রোগীর জন্য তিনি কয়েক মিনিটের বেশি সময় দিতে পারেন না। হাসপাতালের মেঝেতে করিডোরে বিছানা পেতে রোগীদের শুয়ে থাকা এক পরিচিত দৃশ্য। এখানে চিকিৎসা পাওয়াটা অনেকটা লটারি জেতার মতো।
সরকারি হাসপাতালের ভিড় এড়াতে যাদের সামর্থ্য আছে তারা ছোটেন বেসরকারি ক্লিনিক বা হাসপাতালের দিকে। কিন্তু সেখানে চিকিৎসার খরচ আকাশছোঁয়া। অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা বাণিজ্যিক মনোভাব এবং স্বচ্ছতার অভাবের কারণে বেসরকারি খাত অনেক ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষের জন্য একটি ফাঁদে পরিণত হয়েছে। একটি আইসিইউ-এর বিল মেটাতে গিয়ে বহু পরিবার সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে এমন উদাহরণ অহরহ।
শহরের সবচেয়ে বিপন্ন জনগোষ্ঠী হলো বস্তিবাসী। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ বিশুদ্ধ পানির অভাব এবং পুষ্টিহীনতার কারণে তারা নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়। কিন্তু তাদের জন্য মানসম্মত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা প্রায় নেই বললেই চলে। শহরের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা মূলত বড় হাসপাতাল কেন্দ্রিক যা বস্তিবাসীর নাগালের বাইরে।
একসময় কলেরা ডায়রিয়া যক্ষ্মার মতো সংক্রক রোগই ছিল বাংলাদেশের মানুষের মৃত্যুর প্রধান কারণ। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলেছে। উচ্চ রক্তচাপ ডায়াবেটিস হৃদরোগ ক্যান্সার এবং কিডনি রোগের মতো অসংক্রামক ব্যাধি (NCDs) মৃত্যুর প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের মোট মৃত্যুর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই এখন এসব রোগের কারণে হয়।
এই রোগগুলোর চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদী এবং ব্যয়বহুল। এর জন্য প্রয়োজন নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও জীবনযাত্রার পরিবর্তন। কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এখনো সংক্রামক রোগ মোকাবিলার মানসিকতাতেই রয়ে গেছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য যে ধারাবাহিক পরিচর্যা দরকার তা প্রায় অনুপস্থিত। ফলে রোগ যখন জটিল আকার ধারণ করে তখন রোগীরা বড় হাসপাতালে ছোটেন যা ব্যবস্থার ওপর চাপ আরও বাড়িয়ে দেয়।
খুলনার এক মফস্বল শহরের অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক হাশেম সাহেব। সারাজীবন আদর্শ আর সততা দিয়ে ছাত্র পড়িয়েছেন। বছর দুয়েক আগে তার দুটি কিডনিই অকেজো হওয়ার পথে বলে জানালেন ডাক্তার। সপ্তাহে দুবার ডায়ালাইসিস করাতে হবে। শহরে ডায়ালাইসিসের ব্যবস্থা নেই যেতে হয় জেলা সদরের হাসপাতালে। প্রতিবার যাওয়া-আসা আর ডায়ালাইসিসের খরচ মেটাতে গিয়ে পেনশনের টাকা আর ছেলের সামান্য আয়ে সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ল। হাশেম সাহেব তার ডায়েরিতে লিখতেন শরীরটা একটা ভাঙা নৌকার মতো হয়ে গেছে। প্রতিবার ডায়ালাইসিস দিয়ে ফেরার পথে মনে হয় জীবনের আয়ু কিনছি কিন্তু বিনিময়ে সন্তানদের ভবিষ্যৎ বিক্রি করে দিচ্ছি। চিকিৎসার খরচ মেটাতে গিয়ে তার শেষ সম্বল ভিটেমাটিটুকুও বিক্রি করতে হলো। একদিন ডায়ালাইসিস করতে যাওয়ার টাকা না থাকায় তিনি আর হাসপাতালে গেলেন না। কয়েকদিন পর তার নিথর দেহ পাওয়া গেল পড়ার টেবিলে খোলা ডায়েরির পাতার পাশে। হাশেম মাস্টারের গল্পটি শুধু একজন ব্যক্তির নয় এটি অসংক্রামক রোগের আঘাতে জর্জরিত লক্ষ লক্ষ পরিবারের নীরব কান্নার প্রতিধ্বনি যেখানে চিকিৎসা করাতে গিয়ে মানুষ অর্থনৈতিকভাবে মৃত্যুবরণ করে শারীরিক মৃত্যুর আগেই।
এর পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য রয়ে গেছে সবচেয়ে উপেক্ষিত অধ্যায়। হতাশা উদ্বেগ বা অন্যান্য মানসিক সমস্যায় ভোগা মানুষকে পাগল বলে আখ্যা দেওয়া হয়। এর জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা যেমন কম তেমনি সামাজিক সচেতনতাও প্রায় শূন্য।
এই ভগ্ন দশা থেকে উত্তরণের জন্য শুধু নতুন হাসপাতাল তৈরি করা বা কিছু যন্ত্রপাতি কেনাই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন পুরো ব্যবস্থার মানসিকতা এবং কাঠামোর পরিবর্তন।
ব্যবস্থার ভিত্তি মজবুত করতে হবে। কমিউনিটি ক্লিনিক ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোকে শুধু ডাক্তার ও ওষুধ দিয়ে নয় বরং রোগ নির্ণয়ের আধুনিক যন্ত্রপাতি ২৪/৭ জরুরি সেবা এবং একটি কার্যকর রেফারেল সিস্টেম দিয়ে শক্তিশালী করতে হবে।
ডাক্তাররা কেন গ্রামে থাকতে চান না সেই কারণগুলো চিহ্নিত করে সমাধান করতে হবে। তাদের জন্য উন্নত আবাসন নিরাপত্তা সন্তানদের পড়াশোনার সুযোগ এবং ক্যারিয়ারে অগ্রগতির জন্য বিশেষ প্রণোদনা দিতে হবে।
প্রতিটি পরিবারের জন্য একজন নির্দিষ্ট ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মী দল নির্ধারণ করা যেতে পারে যারা সেই পরিবারের সব সদস্যের স্বাস্থ্য বৃত্তান্ত জানবেন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী পরামর্শ দেবেন। এটি রোগ প্রতিরোধ এবং প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয়ে সাহায্য করবে।
চিকিৎসার ব্যয় থেকে মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য সার্বজনীন স্বাস্থ্য বীমা চালু করা সময়ের দাবি। এর মাধ্যমে আউট-অব-পকেট খরচ কমিয়ে আনা সম্ভব।
প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য টেলিমেডিসিন একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে। ডিজিটাল স্বাস্থ্য কার্ডের মাধ্যমে রোগীর তথ্য সংরক্ষণ করা গেলে চিকিৎসার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা সহজ হবে।
স্বাস্থ্য শুধুমাত্র চিকিৎসার বিষয় নয়। রোগ প্রতিরোধের গুরুত্ব সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে হবে। নিরাপদ পানি স্যানিটেশন পুষ্টি এবং সুস্থ জীবনযাত্রা সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি করতে পারলে হাসপাতালের ওপর চাপ অনেকাংশে কমে আসবে।
করিম শেখের বুকের ব্যথা বা আয়েশা বেগমের সন্তানের জ্বরএগুলো শুধু বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় এগুলো আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। একটি দেশের উন্নয়ন শুধু তার জিডিপি বা বড় বড় ফ্লাইওভার দিয়ে মাপা যায় না; তার আসল পরিমাপ হয় সবচেয়ে অসহায় মানুষটি কেমন স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে তার ওপর।
স্বাস্থ্য মানুষের মৌলিক অধিকার কোনো অনুদান নয়। এই অধিকার নিশ্চিত করতে হলে রাজনৈতিক অঙ্গীকার সঠিক পরিকল্পনা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা প্রয়োজন। আমাদের এমন একটি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে যেখানে গ্রামের করিম শেখ এবং শহরের আয়েশা বেগমউভয়েই সমান মর্যাদা ও আস্থার সাথে চিকিৎসা পাবে। যেদিন সেই সমতা প্রতিষ্ঠা হবে সেদিনই বাংলাদেশ সত্যিকারের অর্থে একটি সুস্থ ও সবল জাতি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে।
শেষে এসে একটা ছোট্ট দৃশ্য কল্পনা করিরাত বারোটা চরপাড়ার নৌঘাটে একটা টর্চলাইট হাঁটার পথটাকে সূঁচের চোখের মতো সরু করে রেখেছে। দূরে হাসপাতালের আলো দেখা যায় না শোনা যায় শুধু পানি ঠুকে আসা ঢেউয়ের শব্দ। ওই অন্ধকারে যে মা শিশুটাকে আঁকড়ে ধরেছেন তিনি কোনো পরিসংখ্যানে নেই; আবার শহরের করিডোরে যে বাবা বেডের অপেক্ষায় দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সেও কোনো বক্তৃতার অংশ নয়। দুজনই একই দেশের নাগরিকতবু তাদের চিকিৎসার দূরত্বটা এমন যেন মানচিত্রে কোথাও একটা অদৃশ্য ভাঁজ পড়ে আছে।
আমরা কি এই ভাঁজটা মেনে নেব? এভাবেই চলেএই বাক্যটা কি আমাদের বিবেকের জন্য যথেষ্ট? নাকি আমরা স্বীকার করবস্বাস্থ্য মানে কেবল ওষুধের নাম নয় বরং সময়মতো রওনা হওয়া একটা অ্যাম্বুলেন্স খোলা থাকা কমিউনিটি ক্লিনিকের দরজা গ্রামীণ পোস্টিংয়ে টেকে যাওয়ার মতো প্রণোদনা আর এমন একটা রেফারাল–চেইনযেখানে নিয়মই জীবন বাঁচায়। শহরে বেড নাই শুনে স্থবির হয়ে যাব না; গ্রামে ডাক্তার নাই শুনে চুপ করে থাকব না। কারণ প্রতিটা দেরিএকটা শিশুর ভবিষ্যৎ একটা পরিবারের শেষ সম্বল একটা জীবনের অশেষ আক্ষেপ।
হয়তো বড় পরিবর্তনের আগেও ছোট ছোট কাজ আছেনিজের ইউনিয়নের ক্লিনিক কখন খোলা থাকে সেটা জানা প্রতিবেশীর জরুরি সময়ে রক্ত দিতে তালিকাভুক্ত হওয়া স্থানীয় জনপ্রতিনিধিকে লিখে শহর গ্রামের সেবার ফারাকের কথা মনে করিয়ে দেওয়া আর সবচেয়ে জরুরিঅন্যায়ের সঙ্গে স্বাভাবিক শব্দটা আর না বসানো। দেশটি যদি সত্যিই একটি শরীর হয় তবে রক্তটি সমানভাবে চলতে দেওয়াই আমাদের ন্যূনতম দায়িত্ব।
এই লেখার শেষে আপনাকে দুটা প্রশ্ন রেখে যাচ্ছি: আপনার এলাকার স্বাস্থ্যসেবায় সবচেয়ে বড় বাধা কোনটিঅ্যাক্সেস অর্থ নাকি আস্থা? আর আপনি নিজেআজ এই সপ্তাহেইকোন ছোট্ট পদক্ষেপটা নিতে পারেন যাতে কারও আর একটু দেরি আর মৃত্যুবাণী না হয়?
আপনার নিজের অভিজ্ঞতা মতামত ও পরামর্শ মন্তব্যে লিখুনআমরা পড়ব শিখব এবং একসঙ্গে চাপ তৈরি করব বদলের জন্য। আর যদি মনে হয় এই কথাগুলো কারও কাজে আসতে পারে অনুগ্রহ করে লেখাটি শেয়ার করুন। হয়তো আপনার শেয়ারের লিঙ্কটাই কোনো এক রাতের টর্চলাইটঅন্ধকার ভেদ করে কারও জীবনে আলো হয়ে পৌঁছে যাবে।
বাংলাদেশ স্বাস্থ্যব্যবস্থা, শহর_গ্রাম বৈষম্য, প্রাইমারি হেলথ কেয়ার, কমিউনিটি ক্লিনিক, রেফারাল, মাতৃস্বাস্থ্য, NCD, আউট_অব_পকেট, হাসপাতাল শয্যা, স্বাস্থ্যনীতি।
🌸 আপনার মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ!
আপনার মতামত আমাদের অনুপ্রাণিত করে এবং আগামীতে আরও মানসম্পন্ন কনটেন্ট তৈরিতে সহায়তা করে।
আপনি যদি কোনো নির্দিষ্ট বিষয় বা গল্প পছন্দ করে থাকেন, জানালে ভালো লাগবে।
নিয়মিত পাশে থাকুন — আপনার সহযোগিতা ও ভালোবাসাই আমাদের এগিয়ে চলার শক্তি।
শুভ কামনায়,
✍️ কল্পকথা-৩৬০ ব্লগ টিম
https://kalpakatha360.blogspot.com