ভাবুন তো সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে চারদিকে শুধু ঘন শালবন। হঠাৎ গাড়ি থেমে গেল নির্জন রাস্তায়। মোবাইলে কোনো নেটওয়ার্ক নেই বাতাসে অদ্ভুত শীতলতা আর দূরে কে যেন হঠাৎ হাহাকার করে উঠল। এক মুহূর্তেই বোঝা গেলআজকের রাতটা আর সহজে ফুরোবে না। সেই রাতেই আমরা আটকে গেলাম চন্দ্রপুড়ের জঙ্গলপথে এক রাত যা শুধু ভয়ের নয় জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষাও হয়ে গেল।
প্রকৃতির অরণ্যপথ যেন মানুষের জীবনের প্রতিচ্ছবিদিনে আলো ঝলমল সবুজে ভরা প্রাণবন্ত; আর রাতে একই পথ হয়ে ওঠে অচেনা রহস্যময় কখনো বা ভীতিকর। শহরের আলো-ঝলমল পৃথিবীতে আমরা বুঝিই না অন্ধকারের ভেতর কত ইতিহাস কত শক্তি লুকিয়ে আছে। চন্দ্রপুড়ের জঙ্গলের সেই এক রাত আমাদের শিখিয়েছিলপ্রকৃতির সামনে মানুষ আসলে কতটাই ক্ষুদ্র কতটাই নির্ভরশীল।
শহর জীবনের কোলাহল থেকে সাময়িক মুক্তি পেতে আমরা প্রায়ই প্রকৃতির কাছে আশ্রয় খুঁজি। ভাবি সবুজ অরণ্য পাখির ডাক আর মাটির সোঁদা গন্ধ আমাদের ভেতরের সমস্ত ক্লান্তি ধুয়েমুছে দেবে। কিন্তু প্রকৃতি যেমন তার অপার সৌন্দর্য দিয়ে আমাদের মুগ্ধ করে তেমনই তার রুক্ষ আদিম রূপ দিয়ে আমাদের অসহায়ত্বকেও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারে। আমার আর আমার বন্ধু অমিতের জীবনে এমনই এক অবিস্মরণীয় রাত এসেছিল যে রাতে আমরা চন্দ্রপুড়ের জঙ্গলের কাছে স্রেফ হার মেনেছিলাম। সে রাত ছিল ভয়ের তবে তার চেয়েও বেশি ছিল উপলব্ধির।
সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি। পুজোর ছুটি সবে শুরু হয়েছে। আকাশটা যেন শিল্পী পাবলো পিকাসোর ক্যানভাসকোথাও গভীর নীল কোথাও আবার সাদা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়াচ্ছে। আমরা বেরিয়েছিলাম চন্দ্রপুড়ের সেই বিখ্যাত শালবন পেরিয়ে পাশের এক পুরোনো জমিদার বাড়ি দেখব বলে। উদ্দেশ্য ছিল দিনের আলো থাকতে থাকতেই ফিরে আসা। আমাদের সঙ্গী ছিল আমার বিশ্বস্ত পুরনো মারুতি গাড়িটা যাকে আমি আদর করে পথিক বলে ডাকি।
চন্দ্রপুড়ের জঙ্গলের রাস্তাটা যারা চেনেন তারা জানেন এর দ্বৈত রূপ। দিনের বেলায় ফুরফুরে হাওয়া শাল গাছের ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে পড়া সোনালী রোদ আর রাঙা মাটির পথ মন ভালো করে দেয়। কিন্তু সূর্য ডুবলেই এই একই রাস্তা হয়ে ওঠে রহস্যময় কিছুটা ভুতুড়েও। আমরা যখন জঙ্গলের প্রায় মাঝামাঝি তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। পাখিরা শেষবারের মতো ডেকে বাসায় ফিরছে। হঠাৎই ঘটল বিপত্তিটা। কোনো সতর্কবার্তা ছাড়াই পথিক-এর ইঞ্জিনটা কয়েকবার কাঁপল একটা অদ্ভুত গোঙানির মতো শব্দ হলো আর তারপর সব চুপ। গাড়িটা রাস্তার মাঝখানেই থেমে গেল।
প্রথম কয়েক মিনিট আমরা ব্যাপারটাকে তেমন পাত্তা দিইনি। ভাবলাম ছোটখাটো কোনো সমস্যা। অমিত ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছে সে বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে বনেট খুলে ঝুঁকে পড়ল। আমি টর্চলাইট ধরে তাকে সাহায্য করছিলাম। কিন্তু মিনিট পনেরো চেষ্টার পরেও যখন ইঞ্জিন চালু হলো না তখন আমাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। সবচেয়ে বড় সমস্যাটা টের পেলাম যখন মোবাইল বের করে দেখলামনেটওয়ার্কের একটি দাগও নেই। আমরা সভ্য জগৎ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন।
সূর্যটা ততক্ষণে পশ্চিমের গাছপালার আড়ালে পুরোপুরি মুখ লুকিয়েছে। অন্ধকার যে এত দ্রুত ও এমন সর্বগ্রাসীভাবে নামতে পারে তা শহরে থেকে বোঝা যায় না। মনে হচ্ছিল কেউ যেন একটা বিশাল কালো চাদর দিয়ে চারপাশটা ঢেকে দিচ্ছে। যে শালবন একটু আগেও বন্ধুসুলভ ছিল এখন তার প্রতিটি গাছ যেন এক-একজন অচেনা প্রহরী। ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা ঐকতান ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। সেই নীরবতা যেন কানের ভেতরে চাপ সৃষ্টি করছিল।
কী হবে রে এবার?অমিতের গলায় প্রথমবারের মতো আমি স্পষ্ট ভয় টের পেলাম। ওর মতো যুক্তিবাদী ছেলের এমন কণ্ঠস্বর আমার বুকের ভেতরটা কাঁপিয়ে দিল।
সময় যত বাড়ছিল আমাদের ভয় ততই বাড়ছিল। টর্চের আলোয় জঙ্গলের যতটুকু দেখা যাচ্ছিল তা আরও বেশি আতঙ্ক তৈরি করছিল। শুকনো পাতার ওপর দিয়ে কিছু হেঁটে যাওয়ার শব্দ হলে আমরা দুজনই চমকে উঠছিলাম। ওটা কি কোনো বন্য জন্তু? শেয়াল? নাকি অন্য কিছু? মনের ভেতরে নানা অমূলক চিন্তা ভিড় করছিল। ছোটবেলায় শোনা জঙ্গলের ভূতের গল্পগুলোও মনে পড়তে লাগল।
আমরা গাড়ির ভেতরেই বসে থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। দরজা-জানালা ভালোভাবে বন্ধ করে দিলাম। গাড়ির ভেতরটা নিরাপদ হলেও একটা বদ্ধ বাক্সের মতো মনে হচ্ছিল। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার আর তার মধ্যে আমরা দুজন অসহায় প্রাণী। খিদেও পাচ্ছিল কিন্তু আমাদের কাছে জলের বোতল আর কয়েকটা বিস্কুট ছাড়া কিছুই ছিল না।
মাঝরাতে হঠাৎ করেই বৃষ্টি নামল। প্রথমে টিপটিপ করে, যা জঙ্গলের অসহ্য নীরবতা ভাঙার কারণে কিছুটা স্বস্তিদায়ক মনে হচ্ছিল। কিন্তু সেই স্বস্তি বেশিক্ষণ থাকল না। মিনিট দশেকের মধ্যেই টিপটিপ বৃষ্টি রূপান্তরিত হলো এক ভয়ঙ্কর তাণ্ডবে। ঝমঝম শব্দে মোটা মোটা ফোঁটা পড়তে লাগল গাড়ির ছাদে। মনে হচ্ছিল, যেন হাজার হাজার পাথর কেউ একসাথে ছুড়ে মারছে আমাদের টিনের বাক্সের ওপর। শব্দের তীব্রতায় আমরা একে অপরের কথাও শুনতে পারছিলাম না।
এর সাথে যোগ হলো দমকা হাওয়া। আমাদের পুরনো পথিক গাড়িটা হাওয়ার দাপটে রীতিমতো কাঁপতে শুরু করল। বাইরে গাছপালা ভাঙার মড়মড় শব্দ পাচ্ছিলাম। হঠাৎ আকাশ চিরে বিদ্যুতের এক ঝলকানি! এক সেকেন্ডের জন্য চারপাশটা দিনের মতো আলোকিত হয়ে উঠল। আর সেই আলোতেই আমি দেখলাম, আমাদের গাড়ি থেকে হাত দশেক দূরে একটা বিশাল গাছের ডাল রাস্তার ওপর ভেঙে পড়েছে। যদি আর একটু সামনে গাড়িটা থাকলে আমাদের ভাগ্যে খারাপ কিছু হতে পারতো, তাহলে কী হতো সেই কথা ভেবেই আমার রক্ত জল হয়ে গেল। বিদ্যুতের ঝলকানির পরেই কানে তালা লাগানো বাজ পড়ার শব্দ হলো। মনে হলো যেন ঠিক আমাদের গাড়ির পাশেই কোথাও বাজটা পড়েছে। আমরা দুজনই ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম।
হঠাৎ গাড়ির বাঁ দিকের জানালায় একটা আঁচড়ের মতো শব্দ হলো। খসখস... খসখস...। শব্দটা হাওয়ায় ডাল ঘষা খাওয়ার মতো ছিল না ছিল অনেক বেশি তীক্ষ্ণ আর ইচ্ছাকৃত। যেন কেউ লম্বা নখ দিয়ে ধাতব শরীরে আঁচড় কাটছে। আমরা দুজনই চমকে সেদিকে তাকালাম। অমিত কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, শুনলি? আমি শুধু মাথা নাড়লাম। কথা বলার শক্তি ছিল না। শব্দটা থেমে গেল। কয়েক মুহূর্তের জন্য শুধু বৃষ্টির শব্দ। তারপর আবার... খসখস... খসখস... এবার গাড়ির পিছনের জানালায়।
কিছুক্ষণ পর গাড়ির ছাদের ওপর ধুপ করে একটা ভারী কিছু পড়ার শব্দ হলো। এবার আমাদের দুজনেরই হৃৎপিণ্ড প্রায় থেমে যাওয়ার জোগাড়। ওটা কী ছিল? ভেঙে পড়া ডাল? নাকি কোনো জন্তু? ভয়ে আমাদের শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছিল। এরপর ছাদের ওপর দিয়ে একটা ঘষা টানা টানির শব্দ পেলাম। যেন সেই ভারী জিনিসটা ধীরে ধীরে ছাদের এপাশ থেকে ওপাশে যাচ্ছে। আমরা টর্চ জ্বালিয়ে ওপরে দেখার সাহসটুকুও পাচ্ছিলাম না। মনে হচ্ছিল, এই টিনের বাক্সটা আর নিরাপদ নয়। যেকোনো মুহূর্তে কিছু একটা আমাদের এই ভঙ্গুর আশ্রয় ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়তে পারে।
হঠাৎ করেই গাড়ির ভেতর একটা অদ্ভুত গন্ধ ছড়াতে লাগল। ভেজা মাটি আর পচা পাতার গন্ধের সাথে মেশানো তীব্র, আঁশটে একটা গন্ধ। গন্ধটা এতটাই অস্বস্তিকর যে আমাদের বমি পাচ্ছিল। অমিত ফিসফিস করে বলল, আমার মনে হচ্ছে বাইরে কিছু একটা আছে। শুধু হাওয়া বা বৃষ্টি নয়। ওর গলার স্বর শুনে আমার ভয়টা দ্বিগুণ হয়ে গেল। ও সাধারণত এমন ভয় পাওয়ার ছেলে নয়। আমি কোনোমতে বললাম, চুপ কর। ও কিছু না। কিন্তু আমার নিজের গলাও আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছিল।
ঠিক তখনই আবার বিদ্যুতের ঝলকানি। এবার আলোটা অনেকক্ষণ স্থায়ী ছিল। আর সেই আলোয়, গাড়ির সামনের উইন্ডশিল্ড দিয়ে আমি স্পষ্ট দেখলামরাস্তার ওপারে, একটা বড় শাল গাছের আড়ালে আবছা একটা লম্বাটে ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। কোনো পশুর মতো নয়, মানুষের মতোও নয়। অস্বাভাবিক লম্বা আর শীর্ণ। আলোটা মিলিয়ে যাওয়ার আগেই ছায়ামূর্তিটা যেন গাছের গভীরে মিলিয়ে গেল। আমি ভয়ে চিৎকার করে উঠতে গিয়েও পারলাম না। আমার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বেরোলো না।
অমিত আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুইও দেখেছিস? আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম, সেও একই জিনিস দেখেছে। আমাদের ভয়টা তখন আতঙ্কের পর্যায়ে চলে গেছে। হঠাৎ করে গাড়িটা সজোরে একবার দুলে উঠল। যেন বাইরে থেকে কেউ প্রবল শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিল। এটা বাতাসের ধাক্কা ছিল না, ছিল অনেক বেশি নির্দিষ্ট। আমরা বুঝতে পারলাম, আমরা একা নই। কিছু একটা আমাদের উপস্থিতি টের পেয়েছে এবং সেটার উদ্দেশ্য ভালো নয়।
বাইরে তখন প্রকৃতির উন্মত্ত গর্জন। বৃষ্টি, হাওয়া, বাজ পড়ার শব্দসব মিলেমিশে একাকার। তার মধ্যেই আমরা কান পেতে ছিলাম অন্য কোনো শব্দের জন্য। সেই আঁচড়ের শব্দ, সেই ভারী জিনিস পড়ার শব্দ। আমাদের সমস্ত স্নায়ু টানটান হয়ে ছিল। প্রতিটি মুহূর্ত মনে হচ্ছিল অনন্তকাল। অমিত হঠাৎ আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল। ওর হাত বরফের মতো ঠান্ডা। ও ফিসফিস করে বলল, জানিস, এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে আমরা পৃথিবীর শেষ দুই মানুষ। আর বাইরে পুরো পৃথিবীটা আমাদের শেষ করে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। ওর কথায় এবার কোনো অতিরঞ্জন ছিল না। ওই পরিস্থিতিতে আমাদের ঠিক তাই মনে হচ্ছিল। আমরা সভ্য জগৎ থেকে এতটাই বিচ্ছিন্ন, এতটাই অসহায় যে আমাদের অস্তিত্ব আছে কি নেই, তাতে যেন কারও কিছু যায় আসে না।
একটা সময় ভয়টা ধীরে ধীরে সহনীয় হয়ে এলো। আমরা বুঝতে পারলাম অযথা আতঙ্কিত হয়ে কোনো লাভ নেই। বরং এই রাতটাকে পার করতে হবে। আমরা গল্প শুরু করলাম। ছেলেবেলার গল্প কলেজ জীবনের মজার ঘটনা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাকত কথা যে বেরিয়ে এলো! যে কথাগুলো শহরের ব্যস্ততায় আমরা একে অপরকে বলার সুযোগ পাই না সেই কথাগুলোই সেই রাতে আমাদের একমাত্র সঙ্গী হয়ে উঠল।
ভোর চারটের দিকে বৃষ্টি থামল। আমরা গাড়ির জানালা নামিয়ে বাইরে তাকালাম। আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। লক্ষ লক্ষ তারা যেন আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমি জীবনে এত তারা একসঙ্গে দেখিনি। শহরের দূষিত আলোয় ঢাকা আকাশে এই সৌন্দর্য দেখা অসম্ভব। চাঁদের আলোয় গাছের পাতাগুলো রুপোলি দেখাচ্ছিল। ঝিঁঝিঁর ডাকের সাথে যোগ হয়েছিল কয়েকটি নিশাচর পাখির ডাক। সেই মুহূর্তে আমার ভয় করছিল না বরং একটা অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করছিলাম। মনে হচ্ছিল প্রকৃতির এই আদিম রূপের কাছে আমাদের শহুরে অহংকার কত তুচ্ছ! আমরা কতটা যন্ত্রনির্ভর আর ঠুনকো তা সেই রাতে বুঝতে পেরেছিলাম।
ভোরের প্রথম আলো যখন জঙ্গলের গাছপালা ভেদ করে মাটিতে পড়ল তখন মনে হলো যেন নতুন করে জীবন ফিরে পেলাম। ভোরের আলো যে এতটা আশাব্যঞ্জক হতে পারে তা আগে কখনো অনুভব করিনি। কিছুক্ষণ পরেই আমরা দেখলাম দূর থেকে একজন লোক সাইকেল নিয়ে আসছেন। তিনি পাশের গ্রামের বনরক্ষক। আমাদের দেখে তিনি এগিয়ে এলেন এবং সব শুনে সাহায্যের আশ্বাস দিলেন। প্রায় দুই ঘণ্টা পর তার সহায়তায় গ্রাম থেকে একজন মেকানিক এসে আমাদের গাড়িটা সারিয়ে দিলেন। জানতে পারলাম ইঞ্জিনের একটা ছোট যন্ত্রাংশ বিগড়ে গিয়েছিল।
যখন আমরা আবার গাড়িটা চালু করে শহরের দিকে রওনা দিলাম তখন আমরা আর আগের মানুষটি ছিলাম না। একটা রাত আমাদের অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। আমরা শিখেছিলাম
প্রকৃতিকে সম্মান করতে: প্রকৃতি শুধু সুন্দর নয় সে শক্তিশালী এবং অপ্রত্যাশিতও বটে। তাকে হালকাভাবে নেওয়ার ভুল করা উচিত নয়।
মানুষের অসহায়ত্বকে স্বীকার করতে: প্রযুক্তি আমাদের অনেক ক্ষমতা দিয়েছে কিন্তু প্রকৃতির কাছে আমরা এখনো শিশু।
বিপদে ধৈর্য ধরতে: আতঙ্কিত হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। মাথা ঠান্ডা রাখলে কঠিন সময়ও পার করা যায়।
সম্পর্কের গুরুত্ব: কঠিন সময়ে একজন ভালো বন্ধু বা সঙ্গী যে কতটা বড় শক্তি তা আমরা সেই রাতে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম।
যদি আপনি এমন পরিস্থিতিতে পড়েন? (পাঠকের জন্য ব্যবহারিক পরামর্শ)
আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে আমি কিছু ব্যবহারিক পরামর্শ দিতে চাই যা হয়তো কোনোদিন আপনার কাজে লাগতে পারে। যদি কখনো এমন নির্জন জায়গায় আপনার গাড়ি খারাপ হয়ে যায় বা আপনি আটকে পড়েন:
১. আতঙ্কিত হবেন না: প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো মাথা ঠান্ডা রাখা। আতঙ্কগ্রস্ত হলে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে যায়। গভীর শ্বাস নিন এবং নিজেকে শান্ত করুন।
২. গাড়ির ভেতরেই থাকুন: নির্জন বা বন্য এলাকায় গাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। গাড়ি আপনাকে বন্য জন্তু এবং খারাপ আবহাওয়া থেকে সুরক্ষা দেবে। এটি একটি আশ্রয়স্থল।
৩. গাড়িকে দৃশ্যমান করুন: যদি সম্ভব হয় আপনার গাড়ির হ্যাজার্ড লাইট (জরুরি আলো) জ্বালিয়ে রাখুন। তবে ব্যাটারি বাঁচানোর জন্য এটি একটানা না করে কিছুক্ষণ পর পর করতে পারেন। দিনের বেলায় গাড়ির বনেটের ওপর উজ্জ্বল রঙের কাপড় রাখতে পারেন যা দূর থেকে দেখা যায়।
৪. যোগাযোগের চেষ্টা করুন: প্রথমেই দেখুন মোবাইলে নেটওয়ার্ক আছে কিনা। যদি খুব দুর্বল সিগন্যাল থাকে তাহলে শুধু মেসেজ পাঠানোর চেষ্টা করুন। ফোন কল করতে বেশি পাওয়ার খরচ হয়। পাওয়ার ব্যাংক থাকলে তা বুদ্ধি করে ব্যবহার করুন।
৫. শক্তি ও সম্পদ সংরক্ষণ করুন: আপনার কাছে যা খাবার ও জল আছে তা মেপে ব্যবহার করুন। কখন সাহায্য আসবে তা আপনি জানেন না। গাড়ির ব্যাটারি অপ্রয়োজনে শেষ করবেন না। হেডলাইট বা ভেতরের আলো জ্বালিয়ে রাখবেন না।
৬. এক জায়গায় থাকুন: সাহায্যের জন্য হেঁটে বেরিয়ে পড়ার চিন্তা করবেন না বিশেষ করে যদি এলাকাটি আপনার অপরিচিত হয়। উদ্ধারকারী দল আপনাকে আপনার গাড়ির কাছেই খুঁজবে। হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি।
৭. সকালের জন্য অপেক্ষা করুন: অন্ধকার নামলে কোনো ঝুঁকি না নেওয়াই ভালো। ভোরের আলো ফোটার জন্য অপেক্ষা করুন। দিনের আলোয় পরিস্থিতি বোঝা এবং সাহায্য পাওয়া অনেক সহজ হয়ে যায়।
আজও যখন বন্ধুদের আড্ডায় চন্দ্রপুড়ের জঙ্গলের সেই রাতের কথা ওঠে আমার গায়ে কাঁটা দেয়। কিন্তু সেই কাঁটা শুধু ভয়ের নয় তাতে মিশে আছে এক গভীর উপলব্ধি এবং রোমাঞ্চ। সেই এক রাত আমাদের শিখিয়েছিল জীবনের সবচেয়ে বড় পাঠবিপদ আমাদের দুর্বল করার জন্য আসে না আসে আমাদের ভেতরের শক্তিকে চিনিয়ে দেওয়ার জন্য। শহরের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে আমরা যে সুরক্ষা অনুভব করি তা কতটা ঠুনকো আর প্রকৃতির বুকে সামান্য আশ্রয়টুকু যে কতটা মূল্যবান তা আমরা সেই রাতে শিখেছিলাম। চন্দ্রপুড়ের জঙ্গল আমাদের পথ আটকে দিয়েছিল ঠিকই কিন্তু জীবনের এক নতুন পথের সন্ধানও দিয়ে গিয়েছিল।
চন্দ্রপুড়ের জঙ্গল আমাদের আটকে দিয়েছিল মাত্র এক রাতের জন্য। কিন্তু সেই রাত যেন এক পুরো জীবনের পাঠ হয়ে গিয়েছিল। আমরা বুঝেছিলাম
প্রকৃতিকে অবহেলা করার সুযোগ নেই মানুষের অহংকার প্রকৃতির কাছে কিছুই নয়। ভয় যতই গভীর হোক ধৈর্য আর একে অপরের প্রতি বিশ্বাস থাকলে মানুষ সব পার হয়ে যেতে পারে। আর সবচেয়ে বড় শিক্ষা ছিলঅন্ধকার যত ঘনই হোক না কেন ভোরের আলো একদিন ঠিকই এসে যায়।
আজও মনে হয়যদি সেই রাতে আমরা হাল ছেড়ে দিতাম? যদি ভয় আমাদের গ্রাস করত? হয়তো কখনোই এই গল্প বলার সুযোগ পেতাম না।
তাহলে কি আমাদের প্রতিটি অন্ধকার সময়ও আসলে এমনই এক পরীক্ষা নয় যা পেরোলে নতুন এক সকাল আমাদের জন্য অপেক্ষা করে?
প্রকৃতির সামনে মানুষের অসহায়ত্ব আর সেই অসহায়ত্ব থেকে পাওয়া শক্তির গল্পআপনার জীবনে কি কখনো এমন কোনো অভিজ্ঞতা হয়েছে?
আপনার মতামত কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না আর যদি লেখাটি ভালো লেগে থাকে তবে শেয়ার করুন বন্ধুদের সাথে।
ভ্রমণ কাহিনী, চন্দ্রপুড়ের জঙ্গল, জঙ্গলে এক রাত, রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা, সারভাইভাল টিপস, প্রকৃতি।


🌸 আপনার মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ!
আপনার মতামত আমাদের অনুপ্রাণিত করে এবং আগামীতে আরও মানসম্পন্ন কনটেন্ট তৈরিতে সহায়তা করে।
আপনি যদি কোনো নির্দিষ্ট বিষয় বা গল্প পছন্দ করে থাকেন, জানালে ভালো লাগবে।
নিয়মিত পাশে থাকুন — আপনার সহযোগিতা ও ভালোবাসাই আমাদের এগিয়ে চলার শক্তি।
শুভ কামনায়,
✍️ কল্পকথা-৩৬০ ব্লগ টিম
https://kalpakatha360.blogspot.com