বাংলাদেশ, এক রূপসী বাংলা! নদীমাতৃক এই দেশ শুধু সবুজের সমারোহ আর বিচিত্র সংস্কৃতির ধারক নয়, এটি যেন এক জীবন্ত ক্যানভাস, যেখানে প্রতিটি দিনে আঁকা হয় নতুন নতুন গল্প। গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত এর প্রতিটি কোণে লুকিয়ে আছে জীবনের এক অন্যরকম ছন্দ। কোথাও ধুলো ওড়ানো মেঠো পথে রাখালের বাঁশির সুর, তো কোথাও শহরের কংক্রিটের জঙ্গল থেকে ভেসে আসা জীবনের কোলাহল। একজন ভ্রমণপিপাসু হিসেবে, আমি বরাবরই এই দেশের সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে ভালোবাসি। আর এই পর্যবেক্ষণের ফলেই আমার চোখে ধরা পড়েছে এক অদ্ভুত, অনেকটা প্রহেলিকাময় 'হাট'যাকে আমি বলি ‘হাসির হাট’।
প্রথমবার যখন এই নামকরণটি মাথায় এলো, তখন আমার মনে হয়েছিল, আহা, কী আনন্দ! বুঝি কেবল হাসি আর ঠাট্টা-তামাশাতেই ভরে আছে এই হাট। কিন্তু যত দিন গড়িয়েছে, যত মানুষের সাথে মিশেছি, যত জীবনের গল্প শুনেছি, তত বুঝেছি, এই 'হাসির হাট' শুধুই হাসির নয়। এর পসরা সাজানো থাকে হরেক রকম ঘটনায়, যেখানে হাসি আর কান্না যেন মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। বাইরে থেকে যা নিরীহ হাসি মনে হয়, এর গভীরে লুকিয়ে থাকে জনজীবনের এক সুদীর্ঘ অন্তর্দহন, এক বুকচাপা দীর্ঘশ্বাস। এই হাসি কখনো আসে ক্ষমতাবানদের চাতুরী দেখে, কখনো সাধারণ মানুষের অসহায়ত্ব দেখে, আর কখনো আসে কেবল জীবন-যাপনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।
আমার ভ্রমণপঞ্জিকায় আমি বাংলাদেশের শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত ঘুরে দেখেছি, এবং প্রতিটি জায়গায় এই 'হাসির হাটের' ভিন্ন ভিন্ন চিত্র দেখেছি। শহরের ঝলমলে আলোয় মোড়ানো বড় বড় অট্টালিকা আর ব্যস্ত সড়কের ভিড়েও এর অস্তিত্ব স্পষ্ট। এখানে ক্ষমতা আর অর্থের এক অদ্ভুত খেলা চলে, যেখানে অদৃশ্য এক সুতোয় বাঁধা পড়ে যায় সাধারণ মানুষ। আপনি যখন একটি সরকারি দপ্তরে সামান্য একটি কাজের জন্য দিনের পর দিন ঘুরবেন, যখন একটি ফাইল টেবিল থেকে টেবিলে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে পড়বে আর শেষমেশ 'বিশেষ' কোনো ব্যবস্থার ইশারায় তা দ্রুত এগোবে, তখন আপনার মুখে এক অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠবে। এ হাসি ক্ষোভের, এ হাসি পরিস্থিতির সাথে আপোষের। আবাসন খাতের চটকদার বিজ্ঞাপনের পেছনে লুকিয়ে থাকা প্রতারণার ফাঁদগুলো যখন আপনার স্বপ্নের ফ্ল্যাটকে ধূসর করে দেবে, অথবা উন্নয়নের নামে নিম্নমানের কাজ আর টেন্ডারবাজির দৃশ্য দেখবেন, তখন এই হাসি আরও তিক্ত মনে হবে। শহর যেন এক বিদ্রূপের ক্ষেত্র, যেখানে ক্ষমতা তার কদর্য রূপ প্রকাশ করে।
অন্যদিকে, যখন গ্রামের সবুজ শ্যামল প্রকৃতির মাঝে পা রাখবেন, তখন ভাববেন, এখানে বুঝি জীবনের সরলতা বিরাজমান। কিন্তু না, এখানেও ক্ষমতার খেলা চলে, তবে তার ধরনটা ভিন্ন। ইউনিয়ন পরিষদের সালিশে যখন আইনের নামে অবিচার দেখবেন, যখন অসহায় কৃষকের ভিটেমাটি দখলের পাঁয়তারা দেখবেন, অথবা যখন দুর্যোগের ত্রাণ চুরি হয়ে যেতে দেখবেন আর পেটে টান পড়া মানুষগুলোকে সংগ্রাম করতে দেখবেন, তখন আপনার মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠবে। গ্রামের এই ঘটনাগুলো যেন আরও বেশি হৃদয়বিদারক, কারণ এখানে সরলতা আর বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে ছলনা করা হয়। এই চিত্রগুলো যেন প্রকৃতির শান্ত বুকে এক বিষাদের ছাপ ফেলে যায়।
এই ব্লগ পোস্টে, আমার লক্ষ্য হলো সেই 'হাসির হাটের' কিছু জানা-অজানা ঘটনার চিত্র তুলে ধরা। এটি কোনো নেতিবাচক সমালোচনা নয়, বরং জনজীবনের এক বাস্তব পর্যবেক্ষণ, এক ভ্রমণপিপাসুর চোখ দিয়ে দেখা বাংলাদেশের ভিন্ন এক আখ্যান। এই আখ্যান ক্ষমতা ও ছলনার, যেখানে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে থাকা অনিয়মগুলো সাধারণ মানুষের জীবনে কী প্রভাব ফেলে, তার একটি সহজ ও সাবলীল চিত্র তুলে ধরা হবে। এই গল্পগুলো আমাদের নিজেদের ভেতরের 'হাসির হাট' কে বুঝতে সাহায্য করবে এবং হয়তো একদিন এই তিক্ত হাসির বদলে সত্যিকারের আনন্দের হাসি ফোটানোর পথ দেখাবে।
বাংলাদেশের শহর আর গ্রামের প্রতিটি মোড়ে, প্রতিটি হাটে-বাজারে, প্রতিটি অফিস আদালতেএক অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়ে। বাইরে থেকে সবকিছু যেন এক রকম হাসির নাটককেউ ক্ষমতার দাপটে হেসে বেড়াচ্ছে, কেউ টাকার জোরে অন্যকে ফাঁদে ফেলছে, আবার কেউ ক্ষমতাশালী মহলের ছত্রছায়ায় নিজেকে আইন মান্য নাগরিক ভেবে বুক ফুলিয়ে হাঁটছে। অথচ ভেতরে ভেতরে এই হাসির হাট আসলে এক রকম কান্নার আসর। যেখানে সাধারণ মানুষ প্রতিদিন প্রতারিত হয়, হারায় নিজের অধিকার, অথচ কিছুই করার থাকে না।
ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায় ফুটপাত দখল করা দোকান থেকে শুরু করে কর্পোরেট অফিসের চেয়ারসবখানেই চলছে ছলনা। একদিকে সাধারণ মানুষ ফুটপাতের জায়গা না পেয়ে হেঁটে চলতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়, অন্যদিকে সেই অবৈধ দোকান বসানো লোকটির পেছনে থাকে কোনো না কোনো নেতা বা প্রভাবশালী ব্যক্তির ছায়া। পুলিশের ভ্রুক্ষেপ নেই, কারণ মাসোহারা ঠিকই পৌঁছে যায়।
অফিস আদালতে একই দৃশ্য। সঠিক কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষকে বছরের পর বছর মামলা চালাতে হয়, অথচ ক্ষমতাশালী বা টাকার জোরে দাঁড়ানো মানুষ একদিনেই ফাইল সরিয়ে নিয়ে কাঙ্ক্ষিত আদেশ পেয়ে যায়। যেন শহরটা এক ‘হাসির হাট’যেখানে হাসছে কেবল প্রভাবশালী শ্রেণি, কাঁদছে সাধারণ মানুষ।
গ্রামে চাষির ঘাম ঝরে মাঠে, কিন্তু ধান বিক্রি করতে গেলে তাকে দালালের হাতে পড়তে হয়। সরকারি ধান সংগ্রহ কর্মসূচি কাগজে-কলমে সুন্দর শোনালেও বাস্তবে সেই সুবিধা পৌঁছে যায় রাজনৈতিকভাবে ‘নির্বাচিত’ ধান ব্যবসায়ীর হাতে। সাধারণ কৃষক ধান বেচে পানির দামে, আর দালাল হেসে ওঠে লাখ লাখ টাকার মুনাফা নিয়ে।
অন্যদিকে গ্রামে উন্নয়ন প্রকল্পের নামে খাল খনন, রাস্তা নির্মাণ, কিংবা ঘর তৈরির কাজ হয় ঢাকঢোল পিটিয়ে। কিন্তু শেষমেষ দেখা যায়খালের জায়গায় আধপেটা গর্ত, রাস্তার বিটুমিন ধুয়ে গেছে প্রথম বৃষ্টিতেই, আর ঘরের দেওয়ালে ফাটল ধরেছে কয়েক মাসেই। কারণ বাজেটের বড় অংশই ‘উপরে’ ভাগ হয়েছে। গ্রামের মানুষ ঠকলেও নীরবে সহ্য করে, কারণ প্রভাবশালীদের সঙ্গে শত্রুতা মানে পরের দিন গায়ে মিথ্যা মামলা ঝুলে যাওয়া।
হাওর-বাওর কিংবা পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষ যেন এক চিরন্তন প্রহসনের চরিত্র। উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি কেবল নির্বাচনের সময় তাদের কানে পৌঁছায়, তারপর বছরের পর বছর তারা রয়ে যায় অবহেলিত। বর্ষায় হাওরের মানুষ নৌকা ছাড়া বের হতে পারে না, কিন্তু সেখানে হাসপাতাল, স্কুল কিংবা বাজারে যাওয়ার মতো স্থায়ী রাস্তা হয় না। অথচ বরাদ্দের টাকা প্রতি বছরই খরচ দেখানো হয়।
পাহাড়ি এলাকায়ও একই কাহিনি। উপজাতি বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জমি কাগজে-কলমে অধিকার থাকলেও, শক্তিশালী কোনো সিন্ডিকেট এসে সেই জমি দখল করে নেয়। তাদের কণ্ঠরোধ করা হয় ভয় বা মামলা দিয়ে। ফলে তারা বঞ্চনার চক্রেই বন্দি থাকে।
একবার ঢাকার এক প্রান্তে ফুটপাত সংস্কারের নামে কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল। কাজও হলো। কিন্তু কয়েক মাস পরেই ফুটপাত ভেঙে আবার আগের মতো গর্ত আর বালি হয়ে গেল। স্থানীয় দোকানিরা হাসতে হাসতে বলল“ভাই, এটা তো ফুটপাত না, বরং সরকারি কুমিরের পেট!”
আমাদের এই প্রিয় বাংলাদেশ, রূপ-বৈচিত্র্যে ভরা এক অপূর্ব দেশ। এর জনজীবন বহমান এক নদীর মতো, যেখানে হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি মিলেমিশে একাকার। তবে এই বহমানতার মাঝেও লুকিয়ে আছে এক অদ্ভুত বাজার, এক 'হাসির হাট'। এখানে হরেক রকম ঘটনার পসরা সাজানো থাকে, যেখানে ক্ষমতাশীলদের ছলচাতুরী আর সাধারণ মানুষের অসহায়ত্ব এক তিক্ত হাসির জন্ম দেয়। এই হাসি বাইরে থেকে নিরীহ মনে হলেও এর গভীরে লুকিয়ে থাকে জনজীবনের অন্তর্দহনের এক দীর্ঘশ্বাস। এই লেখা সেই হাসির হাটের কিছু জানা-অজানা ঘটনার চিত্র তুলে ধরবে, যা শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত, এবং যার কেন্দ্রে রয়েছে অনিয়ম ও ক্ষমতাধরদের কৌশলী জাল।
শহর, আধুনিকতার প্রতীক, উন্নয়নের প্রাণকেন্দ্র। ঝলমলে আলোয় মোড়ানো অট্টালিকা, দ্রুতগতির যান আর মানুষের নিরন্তর ছোটাছুটিসব মিলিয়ে এক প্রাণবন্ত দৃশ্য। কিন্তু এই চাকচিক্যের আড়ালেই চলে আসে এক অন্য খেলা। এখানে ক্ষমতা আর অর্থ যেন এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা, যার টানে সাধারণ মানুষরা নিজেদের অজান্তেই ঘুরপাক খেতে থাকে।
শহরের সরকারি দপ্তরগুলো যেন এক জাদুর বাক্স। এখানে ফাইল নড়ে না সহজে, ‘বিশেষ’ ব্যবস্থা করা হয়। সামান্য একটি কাজ, যেমন একটি জমির দলিল তোলা, একটি ট্রেড লাইসেন্স বা নির্মাণ অনুমোদন পাওয়া, এমনকি পাসপোর্ট তৈরি করতে গিয়েও মানুষকে হয়রানির শিকার হতে হয়। সরকারি ফি দেওয়ার পরও দেখা যায়, অদৃশ্য হাতের ইশারায় ফাইলটি আটকে আছে মাসের পর মাস। এখানে কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী ক্ষমতাকে পুঁজি করে এক অলিখিত নিয়ম তৈরি করেছেন। তাদের কাছে নিয়ম কানুন নয়, 'উপহার'ই আসল। যিনি এই উপহার দিতে পারলেন, তার কাজ দ্রুত সম্পন্ন হলো। আর যিনি পারলেন না, তার ফাইল বছরের পর বছর ধুলো জমিয়ে পড়ে রইল। এই পরিস্থিতি সাধারণ মানুষের জন্য একদিকে যেমন আর্থিক ক্ষতি বয়ে আনে, তেমনি অন্যদিকে সৃষ্টি করে মানসিক যন্ত্রণা ও হতাশা। কত স্বপ্ন, কত পরিকল্পনা এই ফাইলবন্দী আমলাতন্ত্রের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে যায়, তার হিসেব নেই।
শহরের জমির মূল্য আকাশছোঁয়া। এই সুযোগে কিছু আবাসন ব্যবসায়ী নিরীহ মানুষের দুর্বলতাকে পুঁজি করে প্রতারণার জাল ফেলে। চটকদার বিজ্ঞাপন, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি আর লোভনীয় অফার দিয়ে তারা মানুষকে আকৃষ্ট করে। স্বপ্নের ফ্ল্যাট কেনার জন্য মানুষ নিজেদের সারা জীবনের সঞ্চয় ঢেলে দেয়, ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়। কিন্তু দেখা যায়, প্রকল্পের কাজ বছরের পর বছর ধরে আটকে আছে, সময়মতো ফ্ল্যাট হস্তান্তর হচ্ছে না, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে একই ফ্ল্যাট একাধিক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করা হয়েছে। যখন ভুক্তভোগীরা প্রতিবাদ করতে যান, তখন ক্ষমতাবান এই ব্যবসায়ীরা তাদের পেশীশক্তি বা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সব কিছু ধামাচাপা দিয়ে দেন। তাদের কাছে আইন যেন একটি মাকড়শার জালের মতো, যা শুধু ছোট মাছদের আটকে রাখে, বড়দের নয়। এই প্রতারিত মানুষেরা পথে পথে ঘুরে বেড়ান, আইনের দ্বারস্থ হন, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ন্যায়বিচার অধরাই থেকে যায়। তাদের স্বপ্নভঙ্গের এই করুণ দৃশ্য শহরের হাসির হাটে এক বিদ্রূপের নতুন মাত্রা যোগ করে।
শহরের উন্নয়নের নামে যে বিশাল বাজেট বরাদ্দ হয়, তার সিংহভাগই চলে যায় দুর্নীতিবাজদের পকেটে। রাস্তাঘাট নির্মাণ, ড্রেন সংস্কার, ভবন তৈরিপ্রতিটি প্রকল্পে দেখা যায় ত্রুটিপূর্ণ কাজ আর নিম্নমানের সামগ্রীর ব্যবহার। টেন্ডার প্রক্রিয়ায় চলে এক নীরব যুদ্ধ। ক্ষমতাশীলদের আশ্রিত ঠিকাদাররা বিভিন্ন ছদ্মবেশে টেন্ডার বাগিয়ে নেন, কখনো কখনো প্রতিযোগিতা ছাড়াই। এরপর শুরু হয় লুটপাট। কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন তুললে নানা অজুহাত দাঁড় করানো হয়, বা প্রভাবশালীরা হুমকি-ধামকি দিয়ে মুখ বন্ধ করে দেন। কিছুদিন পরই দেখা যায় নতুন নির্মিত রাস্তা ভেঙেচুরে একাকার, ড্রেনগুলো আবর্জনায় ভর্তি, আর সরকারি ভবনগুলো জীর্ণ দশায়। অথচ এগুলোর পেছনে ব্যয় হয়েছে জনগণের করের হাজার কোটি টাকা। এই দৃশ্যগুলো দেখলে হাসি পায়, কিন্তু সে হাসি হতাশার, ক্ষোভের।
গ্রাম, যেখানে বাংলাদেশের আত্মিক পরিচয় মিশে আছে, যেখানে সবুজ প্রকৃতি আর সরল মানুষের জীবনযাপনের ছবি। এখানেও ক্ষমতা আর প্রভাবের খেলা চলে, তবে তার ধরনটা কিছুটা ভিন্ন। শহরের মতো এখানে কর্পোরেট ছলচাতুরী না থাকলেও, স্থানীয় ক্ষমতাধরদের দাপট প্রান্তিক মানুষের জীবনকে বিষিয়ে তোলে।
গ্রামের বিচার ব্যবস্থা বা সালিশ, ঐতিহাসিকভাবে যা গ্রামীণ শালীনতা ও ন্যায়বিচারের প্রতীক ছিল, তা আজ অনেক জায়গায় ক্ষমতাধরদের হাতের পুতুল। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা সদস্য, স্থানীয় প্রভাবশালী মাতব্বররা অনেক সময় নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সালিশকে ব্যবহার করেন। গ্রামের দরিদ্র, অসহায় মানুষেরা যখন কোনো সমস্যায় পড়েন, তখন তারা আইনের আশ্রয় নেওয়ার বদলে সালিশের দ্বারস্থ হন, কারণ আদালত তাদের কাছে অনেক দূরের এবং ব্যয়বহুল এক প্রক্রিয়া। এই সুযোগে, সালিশে প্রভাবশালীরা নিজেদের পক্ষে রায় দেন বা মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেন। অনেক সময় নারী নির্যাতন, জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ বা তুচ্ছ কলহকে কেন্দ্র করে সালিশে এমন সব অদ্ভুত ও হাস্যকর রায় দেওয়া হয়, যা মানবিকতার সব সীমা অতিক্রম করে যায়। এসব রায়ে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নারীরা, চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। তাদের চোখের জল আর বুকের হাহাকার গ্রামের সবুজ শ্যামলে বিষাদ ছড়ায়, আর সেই বিচারে জন্ম নেয় এক ক্রূর হাসি।
গ্রামের সহজ সরল কৃষকদের জমি দখল করা ক্ষমতাধরদের জন্য এক সাধারণ ঘটনা। মিথ্যা কাগজপত্র তৈরি করে, জাল দলিল বানিয়ে অথবা পেশীশক্তি খাটিয়ে অন্যের জমি নিজের নামে করে নেওয়ার প্রবণতা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। যারা প্রতিবাদ করেন, তাদের হুমকি-ধামকি দেওয়া হয়, মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়, এমনকি প্রাণনাশের ভয়ও দেখানো হয়। অনেক সময় দেখা যায়, গ্রামের নিরীহ কৃষক যুগ যুগ ধরে যে জমি চাষ করে আসছেন, হঠাৎ করে সে জমির মালিকানা দাবি করে বসেছেন একজন ক্ষমতাশীল ব্যক্তি, যিনি হয়তো কখনোই সেই এলাকায় ছিলেন না। ভূমি অফিসগুলোতেও দুর্নীতির ছড়াছড়ি, যার কারণে ভুক্তভোগীরা সহজে প্রতিকার পান না। ভূমিদস্যুদের এই থাবায় অসহায় কৃষকরা ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন। তাদের এই আর্তনাদ গ্রামের হাসির হাটে এক করুন সুর তোলে।
গ্রামের দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের জন্য সরকার বিভিন্ন ত্রাণ ও উন্নয়নমূলক কর্মসূচি হাতে নেয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, এই ত্রাণ বা উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ সঠিক মানুষের কাছে পৌঁছায় না। চাল, ডাল, কম্বল অথবা নগদ অর্থযা অসহায় মানুষের জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য, তা মাঝপথেই লুট হয়ে যায়। স্থানীয় প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি বা তাদের ঘনিষ্ঠজনরা এই ত্রাণ আত্মসাৎ করেন, অথবা নিজেদের সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর মধ্যে ভাগ করে দেন। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতাএসবেরও একটি অংশ কেটে রাখা হয়। গ্রামীণ রাস্তাঘাট বা কালভার্ট নির্মাণের জন্য যে বরাদ্দ আসে, তার একটি বড় অংশ চলে যায় দুর্নীতিবাজদের পকেটে। ফলস্বরূপ, নিম্নমানের কাজ হয়, বা কাজ সম্পূর্ণ না করেই বিল তুলে নেওয়া হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ও এই অসাধুতা চোখে পড়ে। যারা দিনের পর দিন দুবেলা দুমুঠো খাবারের জন্য সংগ্রাম করেন, তাদের অধিকার যখন কেড়ে নেওয়া হয়, তখন তাদের চোখে জল থাকলেও মুখে ফুটে ওঠে এক অসহায় হাসি, যা বলে দেয়"এটাই বুঝি আমাদের নিয়তি!"
"হাসির হাটে হরেক ঘটনা" এই শিরোনামটি কেবল হাস্যরসের জন্য নয়, এর গভীরে লুকিয়ে আছে এক গভীর সামাজিক বার্তা। এই হাসি কেবল বিদ্রূপের নয়, এটি অসহায়ত্বের, হতাশার এবং কখনো কখনো নির্লিপ্ততারও হাসি।
এই অনিয়ম এবং ছলচাতুরীর মূল কারণগুলোর একটি হলো বিচারহীনতার সংস্কৃতি। যখন অপরাধীরা বারবার পার পেয়ে যায়, যখন ক্ষমতা তাদের ঢাল হয়ে দাঁড়ায়, তখন সাধারণ মানুষের মনে আইনের প্রতি আস্থা কমে যায়। এই বিচারহীনতার সুযোগে ক্ষমতাশীলরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এর ফলে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে নৈতিকতার চরম স্খলন ঘটে। ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যার সীমারেখাগুলো যেন ঝাপসা হয়ে যায়। মানুষ দেখে, অন্যায়ের পথেই যেন দ্রুত সাফল্য আসে, আর সৎ পথে থাকলে কেবল দুর্ভোগ বাড়ে। এই দৃষ্টিভঙ্গিই সমাজের ভিত্তি দুর্বল করে দেয়।
অনেক সময় দেখা যায়, সাধারণ মানুষ এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে সাহস পান না। এর পেছনের কারণগুলো খুবই বাস্তবসম্মত। প্রথমত, ভয়। ক্ষমতাধরদের প্রভাব, পেশীশক্তি বা রাজনৈতিক দাপট তাদের ভীত করে তোলে। দ্বিতীয়ত, দীর্ঘসূত্রিতা ও হয়রানির ভয়। একটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গেলে যে সময়, অর্থ এবং মানসিক শক্তির প্রয়োজন হয়, তা অনেকেরই থাকে না। তৃতীয়ত, বিচার পাওয়ার অনিশ্চয়তা। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, অভিযোগ করেও কোনো লাভ হয় না, বরং উল্টো হয়রানির শিকার হতে হয়। এই সম্মিলিত কারণে মানুষ এক প্রকার নীরব আত্মসমর্পণের পথ বেছে নেয়, যা অশুভ শক্তিকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। এই নীরবতা এক প্রকার সম্মতি হয়ে দাঁড়ায়, যা এই হাসির হাটের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
বাংলাদেশের প্রথম সারির দৈনিক পত্রিকাগুলো এই অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিয়মিতভাবে সোচ্চার। তারা সাহসের সঙ্গে নানা ঘটনা তুলে ধরেন, জনমত তৈরি করেন। তাদের প্রতিবেদনগুলো প্রায়শই পাঠককে সচেতন করে, ক্ষোভ জাগায়। কিন্তু গণমাধ্যমেরও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহার এতটাই ব্যাপক যে, সব ঘটনা তুলে ধরা বা তার দ্রুত প্রতিকার পাওয়া সব সময় সম্ভব হয় না। অনেক সময় প্রভাবশালীরা সংবাদ প্রকাশেও বাধা দেন। তবে, তাদের নিরন্তর প্রচেষ্টা জনসচেতনতা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাদের সাহিত্যিক ও পত্রিকার ভাবধারায় লেখা প্রতিবেদনগুলো এই 'হাসির হাট'-এর ঘটনাগুলোকে জনসম্মুখে নিয়ে আসে।
এত কিছুর পরও, আমরা কি শুধু এই তিক্ত হাসি নিয়েই বাঁচব? অবশ্যই নয়। এই হাসির হাটের অন্ধকারের মধ্যেও আশার আলো জ্বলে ওঠে। কিছু মানুষ আছেন, যারা এখনো সততা আর ন্যায়ের জন্য সংগ্রাম করেন। কিছু সরকারি কর্মকর্তা আছেন, যারা নির্লোভভাবে জনসেবা করেন। কিছু সাংবাদিক আছেন, যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সত্য প্রকাশ করেন।
সচেতনতা বৃদ্ধি: জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যখন মানুষ নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ করবে, তখন ক্ষমতাধরদের পক্ষে ছলচাতুরী করা কঠিন হয়ে উঠবে।
আইনের প্রয়োগ: আইনের সঠিক ও নিরপেক্ষ প্রয়োগ নিশ্চিত করা অপরিহার্য। বিচার বিভাগকে আরও শক্তিশালী ও স্বাধীন করতে হবে, যাতে কোনো অপরাধী ক্ষমতা বা অর্থের জোরে পার পেয়ে যেতে না পারে।
নৈতিক শিক্ষার প্রসার: পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সমাজের সর্বস্তরে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের চর্চা বাড়ানো প্রয়োজন। একটি শক্তিশালী নৈতিক ভিত্তি ছাড়া টেকসই সমাজ গঠন অসম্ভব।
প্রযুক্তি ব্যবহার: দুর্নীতি ও অনিয়ম প্রতিরোধে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো যেতে পারে। ই-গভর্নেন্স, অনলাইন পরিষেবা এবং ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম দুর্নীতির সুযোগ কমাতে সাহায্য করবে।
গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের ভূমিকা: গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজকে তাদের স্বাধীন ভূমিকা পালনে আরও সুযোগ ও সমর্থন দিতে হবে। তারা সমাজের চোখ এবং কান হিসেবে কাজ করে, যা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে সাহায্য করে।
বাংলাদেশের শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত এই হাসির হাটে ঘটে চলেছে হরেক রকম ঘটনা। ক্ষমতাশীলদের ছলচাতুরী, অনিয়ম আর দুর্নীতির এই খেলায় সাধারণ মানুষরা প্রায়শই বলি হন। এই পরিস্থিতি জনজীবনে এক গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে, যা তাদের স্বপ্ন আর সম্ভাবনাকে ম্লান করে দেয়। যে হাসি এই হাটে শোনা যায়, তা আনন্দের হাসি নয়, বরং এক প্রকার নিছক অস্তিত্বের স্বীকৃতি। তবে, এই চিত্রের ভেতরেই লুকিয়ে আছে পরিবর্তনের বীজ। যখন মানুষ সচেতন হবে, যখন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরগুলো শক্তিশালী হবে, যখন আইনের শাসন নিরপেক্ষভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে, তখন এই হাসির হাটের ছবিটা বদলে যেতে পারে। হয়তো একদিন তিক্ত হাসির বদলে সত্যিকারের আনন্দের হাসি ফুটবে প্রতিটি মুখে। সেই দিনের স্বপ্নই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে, সেই দিনের আলোর সন্ধানই আমাদের পথচলার প্রেরণা।
হাসির হাট, শহরের অনিয়ম, গ্রামীণ দুর্নীতি, ক্ষমতাশালীর ছলনা, সাধারণ মানুষের বেদনা, বাংলাদেশের বাস্তবতা।
🌸 আপনার মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ!
আপনার মতামত আমাদের অনুপ্রাণিত করে এবং আগামীতে আরও মানসম্পন্ন কনটেন্ট তৈরিতে সহায়তা করে।
আপনি যদি কোনো নির্দিষ্ট বিষয় বা গল্প পছন্দ করে থাকেন, জানালে ভালো লাগবে।
নিয়মিত পাশে থাকুন — আপনার সহযোগিতা ও ভালোবাসাই আমাদের এগিয়ে চলার শক্তি।
শুভ কামনায়,
✍️ কল্পকথা-৩৬০ ব্লগ টিম
https://kalpakatha360.blogspot.com