বাংলাদেশের প্রতিটি হাট-বাজারে, শহর-গ্রামে, মোড়ের দোকানে কিংবা বড় বড় সুপারশপে একটি অদ্ভুত কিন্তু অদৃশ্য ব্যাধি ছড়িয়ে আছে, যার নাম “ওজনে কম”। আপাতদৃষ্টিতে এটি যেন শুধুই একটি অনিয়ম; কেউ আপেল বা কমলা কিনে বাসায় গিয়ে দেখে ১ কেজির জায়গায় ৮৫০ গ্রাম, কেউ চালের বস্তা থেকে খুঁজে পায় বালির হালকা ছোঁয়া, আবার কেউ লিটার হিসাবে কেনা তেলে খুঁজে পায় ১০০ মিলি রহস্যজনকভাবে উধাও। কিন্তু আসলেই কি এটি কেবল মানুষের লোভ? নাকি এর পেছনে আছে কোনো রহস্যময় শক্তি, এক অদৃশ্য হাত যা আমাদের হিসেবের পাল্লা থেকে গ্রাম চুরি করে নিচ্ছে নীরবে? আসুন, সেই অদৃশ্য গল্পের গভীরে ডুব দেওয়া যাক।
ওজনপুর সে এক পরিমাপের ছলনা,
যেখানে প্রতিটি কাঁটা মিথ্যের আলপনা আঁকে।
কম-গ্রামের অভিশাপে বাঁধা এখানকার নিঃশ্বাস,
মানুষ বাঁচে না, যেন খড়ায় খণ্ডিত বিশ্বাস।
বাজারের বাটখারা হেলে থাকে শোষকের দিকে,
সের হয়ে ওঠে আধসের, দিন কাটে ফিকে।
শ্রমিকের ঘাম ঝরে নোনাধরা মাটিতে,
বঞ্চনার সেই লবণাক্ত স্বাদ তার রুটিতে।
ধানের শরীর জুড়ে প্রতিশ্রুতির অসারতা,
বস্তার গভীরে শুধু শূন্যতার হাহাকার ও নিস্তব্ধতা।
মিষ্টির দানায় মেশে তিক্ততার ইতিহাস,
হাসির আড়ালে কাঁপে চাপা দীর্ঘশ্বাস।
জ্ঞানের প্রদীপে আজ আলো নেই, আছে শুধু ধোঁয়া,
ক্ষমতার ঝলকানিতে মেধার আকাশ ছোঁয়া।
প্রতিভার ডানা বাঁধা অদৃশ্য সুতোয়,
স্বপ্নের কঙ্কালগুলো পড়ে থাকে পথের ধূলোয়।
নেতারা আসে, ছড়ায় কথার ইন্দ্রজাল,
উন্নয়নের নামে বোনে লঘুকরণের নতুন ফাল।
প্রতিশ্রুতির পাল্লা শূন্যকেও হার মানায়,
জনতার চোখে জমে আগুনের কণা, ভিসুভিয়াস হতে চায়।
আরোগ্যের নামে বিকোয় রোগীর শেষ আস্থা,
ওষুধের মোড়কে ঢাকা প্রাণহীন রাসায়নিক সস্তা।
বিচারের এজলাসে কাঁদে ন্যায়ের শবদেহ,
ওজনপুরের বাতাসে ভাসে শুধু পাপের সন্দেহ।
কিন্তু আর নয় এই কম-গ্রামের আত্মপ্রবঞ্চনা,
জাগো জনতা, জাগো! করো মিথ্যের মূলোৎপাটন।
কণায় কণায় চাই জীবনের পূর্ণ অধিকার,
শ্রমে-ঘামে ভেজা মাটির হারানো এ'তেবার।
আজ সত্যের ওজনে ভারী হোক প্রতিটি পাল্লা,
ঘুচে যাক শোক, মুছে যাক শোষণের এই কাল্লা।
ওজনপুরের অভিশাপেই লেখা হোক মুক্তির নতুন গান,
এই ভাঙনের সুরেই হোক সৃষ্টির নব উত্থান!
সবকিছু শুরু হয়েছিল এক কাল্পনিক জনপদ 'ওজনপুর' থেকে। ওজনপুরের মানুষজন ছিল অত্যন্ত সৎ ও নিষ্ঠাবান। তাদের বাজারে প্রতিটি কেনাবেচা হতো পরম বিশ্বস্ততার সাথে। সেখানে প্রতিটি ব্যবসায়ী পণ্যের ওজনে এক গ্রামও কম দিত না। তারা বিশ্বাস করত, ওজনের হিসেব শুধু এই দুনিয়াতে নয়, পরকালেও দিতে হবে। তাই ওজনপুরী ব্যবসায়ীরা ওজন মাপার আগে পরম ভক্তিভরে দোয়া পড়ত: “হে মহান, যেন আমি কারও হক নষ্ট না করি।” তাদের ওজনের পাল্লাগুলোও যেন ছিল আশীর্বাদপুষ্ট সততার ছোঁয়ায় প্রতিটি পাল্লায় সত্য ও ন্যায় প্রতিফলিত হতো। ক্রেতারা নিশ্চিন্তে কেনাকাটা করত, আর বিক্রেতারাও তাদের সততার পুরস্কার পেত মানুষের অকৃত্রিম আস্থা ও ভালোবাসার মাধ্যমে। ওজনপুর ছিল যেন এক স্বপ্নরাজ্য, যেখানে ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল বিশ্বাস আর মর্যাদার ভিত্তিতে। এই গ্রামটি কেবল ব্যবসার কেন্দ্র ছিল না, ছিল এক সামাজিক বন্ধনের উদাহরণ, যেখানে প্রত্যেকের প্রতি প্রত্যেকের সম্মান ছিল অটুট।
একদিন এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। ওজনপুরের একজন নবীন বণিক ভুলক্রমে একজন দরবেশের পুরোনো মাপের পাল্লা ব্যবহার করে ফেলে। দরবেশের পাল্লাটি ছিল অলৌকিক শক্তিতে পূর্ণ। যুবক বণিক অবাক হয়ে দেখে, ক্রেতার দেওয়া মুদ্রা নিজে থেকেই পাল্লার ওপর এমন ভারসাম্য আনছে, যা তার সাধারণ পাল্লায় সম্ভব ছিল না। পণ্য ওজন করার সময় সে লক্ষ্য করল, সামান্য কম দিলেও পাল্লায় ওজনের কাঁটা ঠিকঠাক দেখাচ্ছে। লাভ বেড়ে যায়, খরিদ্দার খুশি কারণ তারা বোঝেই না যে তাদের ওজনে কম দেওয়া হচ্ছে। প্রথম দিকে বণিক নিজেও দ্বিধায় ছিল, কিন্তু যখন দেখল এতে তার লাভ বাড়ছে এবং কেউ কিছু বলছে না, তখন তার নীতিবোধে চিড় ধরতে শুরু করল। সে জানে না, এটি ছিল এক মারাত্মক পরীক্ষা। সেই দিন থেকেই ছড়িয়ে পড়ে এক অদৃশ্য ভাইরাস ‘কম-গ্রাম’। এটি কোনো জৈবিক ভাইরাস নয়, এটি একটি নৈতিক ব্যাধি। যেখানেই একজন ব্যবসায়ী অসৎ উদ্দেশ্যে এক চিমটি কম দেয়, সেখানেই এই ভাইরাসের ছায়া পড়ে। এই ভাইরাস প্রথমে বিক্রেতার বিবেককে গ্রাস করে, তারপর তার পাল্লার কাঁটাকে প্রভাবিত করে, আর সবশেষে তার চারপাশের পরিবেশকেও কলুষিত করে তোলে।
ক্রমশ এটি ছড়িয়ে পড়ে পুরো দেশে। প্রথম দিকে দোকানিরা নিজেরাও বুঝতে পারে না কেন যেন তাদের পাল্লা আজকাল একটু কম দেখাচ্ছে। তারা ভাবে হয়তো পাল্লার সমস্যা, কিংবা আবহাওয়ার প্রভাব, অথবা অন্য কোনো অজুহাত খুঁজে নেয়। কিন্তু আসলে এটি ছিল ‘কম-গ্রাম’ ভাইরাসের প্রভাব, যা তাদের মন ও কর্মকে অগোচরেই নিয়ন্ত্রণ করছিল। সময়ের সাথে সাথে, এই ব্যাধি এতটাই ব্যাপক আকার ধারণ করে যে, সততার সাথে ব্যবসা করাটাই যেন এক অস্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। ছোট ছোট অসততা প্রথমে গোপন থাকে, পরে তা প্রকাশ্য দিবালোকে স্বাভাবিক হয়ে যায়, এবং এই অসততার ধারাবাহিকতা জন্ম দেয় আরও বড় দুর্নীতির।
আশ্চর্যজনকভাবে, এই ‘কম-গ্রাম’ ভাইরাস শুধু এনালগ পাল্লাতেই আটকে থাকেনি। আধুনিকতার ছোঁয়ায় যখন ডিজিটাল মাপযন্ত্র এলো, তখন অনেকেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। ভেবেছিল, এবার বুঝি ঠকে যাওয়ার দিন শেষ। কিন্তু কোথায় কী! ডিজিটাল মাপযন্ত্রও যেন এক রহস্যময় চুম্বকের টানে গ্রাম হারিয়ে ফেলে। আপনি যখন একটি সুপারশপে প্যাকেটের ফল বা সবজি কিনছেন, তখন হয়তো দেখছেন মেশিন ঠিকঠাক ওজন দেখাচ্ছে। কিন্তু বাসায় এসে যখন নিজের মাপযন্ত্রে আবার ওজন করছেন, তখন প্রায়শই দেখা যায় সেখানেও অদৃশ্যভাবে কিছু গ্রাম উধাও!
এই রহস্যের পেছনে কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি নেই, আছে নিপুণ হাতসাফাইয়ের কারসাজি। বিক্রেতারা নানান কৌশলে ডিজিটাল মাপযন্ত্রের সেটিং পরিবর্তন করে রাখে, যাতে কাগজে-কলমে ওজন ঠিক দেখালেও, বাস্তবে পণ্য কম দেওয়া হয়। কখনো একই পণ্যের গায়ে ভিন্ন দাম বা ওজনের স্টিকার লাগিয়ে দেয়, কখনো আবার মেশিনে এমন প্রোগ্রাম সেট করে রাখে যা নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে কম পণ্যকে সঠিক বলে দেখায়। ফলে আধুনিক প্রযুক্তির ওপর ভরসা করেও ভোক্তারা প্রতিনিয়ত ঠকছেন, আর এই ‘কম-গ্রাম’ ব্যাধি আরও সুদূরপ্রসারী হয়ে উঠছে।
জনশ্রুতি আছে, কোনো এক গহীন হাওরে বাস করে ‘ওজনের যাদুকর’। সে নাকি তিনটি মায়াবী চুক্তি দেয় সেই সব ব্যবসায়ীদের, যারা সহজে ধনী হতে চায়:
১. "তুমি যত কম দেবে, ততই লাভ হবে।" এই চুক্তিটি লোভের বিষকে আরও উসকে দেয়। ব্যবসায়ী ভাবে, 'একটু কম দিলেই তো লাভ, তাহলে কেন দেবো না?' এই লোভই তাদের বিবেককে অসাড় করে তোলে, কারণ স্বল্প সময়ের লাভ তাদের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির পথ খুলে দেয়।
২. "তুমি যদি ধরা না পড়ো, সমাজ তোমাকে সফল বলবে।" এই চুক্তিটি সামাজিক চাপের একটি কুৎসিত রূপ। সমাজে যখন অসৎ উপায়ে ধনী হওয়াকে সম্মান দেওয়া হয়, তখন অনেকেই মনে করে 'ধরা না পড়লে সব জায়েজ।' এই মনোভাব তাদের অনৈতিক পথ বেছে নিতে উৎসাহিত করে, কারণ তারা দেখে যে অসৎ মানুষেরা প্রায়শই সমাজে বেশি প্রভাবশালী হয়।
৩. "তুমি যেহেতু একাই করছো না, এতে কোনো পাপ নেই।" এটি হলো আত্মপ্রবঞ্চনার চরম রূপ। যখন একজন দেখে যে তার পাশের ব্যবসায়ীও একই কাজ করছে, তখন সে ভাবে, 'সবাই যখন করছে, তাহলে আমি একা কেন সৎ থাকব? এতে তো কোনো দোষ নেই!' এই সম্মিলিত অসততাই সমাজের নৈতিক মেরুদণ্ডকে ভেঙে দেয় এবং একে অপরের ওপর দোষ চাপানোর এক অশুভ প্রবণতা সৃষ্টি করে।
অনেকেই এই তিনটি মায়াবী চুক্তিতে সই করে। তারা ধীরে ধীরে পরিণত হয় ‘ওজন হরণকারী’তে। তারা প্রকাশ্যে সৎ সাজার ভান করে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ওজনের গ্রাম চুরি করতে থাকে। কিন্তু কেউ জানে না, এই চুক্তির শেষ লাইনটিতে অদৃশ্য কালিতে লেখা থাকে “তবে মনে রেখো, প্রতিটি কম-গ্রামের হিসেব রাখে আসমানের এক ফেরেশতা।” এই অলিখিত শর্তটি কেবল তখনই প্রকাশ পায়, যখন ‘ওজন হরণকারী’ তাদের অসৎ কর্মের চূড়ান্ত পরিণতি ভোগ করতে শুরু করে। ফেরেশতার হিসেব কোনোদিন ভুল হয় না, আর তার বিচারও হয় কঠিন।
এই ওজন হরণকারী ব্যবসায়ীদের কার্যকলাপের কিছু অদ্ভুত এবং হাস্যকর উদাহরণ আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে। একবার এক ক্রেতা আপেল কিনতে গিয়েছেন। বললেন, “ভাই, এক কেজি আপেল দেন।” বিক্রেতা চটজলদি চারটা মোটা-মোটা আপেল পাল্লায় তুলে দিলেন। দেখতে বেশ সুন্দর আর টাটকা। ক্রেতা খুশি হয়ে বাসায় এসে আপেলগুলো কাটলেন, দেখলেন ভেতরে আধা পোকা, আধা আশা। মানে অর্ধেক ভালো, অর্ধেক নষ্ট বা পোকা ধরা। ক্রেতা পরদিন বিক্রেতার কাছে অভিযোগ করতে গেলেন। ফল বিক্রেতা নির্বিকার মুখে বলল, “ভাই, আপেল তো আপেলই! ভেতরে কী আছে, সেটা তো বাইবেলেও লেখা নাই!” এই ধরনের যুক্তিগুলো প্রায়শই শুনতে পাওয়া যায়, যা বিক্রেতাদের নির্লজ্জতা এবং নৈতিক অবক্ষয়কেই তুলে ধরে। তারা পণ্যের গুণগত মান নিয়ে কোনো দায়বদ্ধতা অনুভব করে না, শুধু ওজনে কারসাজি করেই ক্ষান্ত হয় না, বরং নিম্নমানের পণ্য দিয়েও ঠকানোর চেষ্টা করে।
তেল কিনতে গিয়েছেন। দোকানি বোতল ভর্তি তেল দিল, কিন্তু ওজন করতেই দেখা গেল ২০ মিলি তেল গায়েব! আপনি প্রশ্ন করলেন, “ভাই, তেল কম কেন?” উনি মুচকি হেসে বললেন, “এইটা হলো ‘উবে যাওয়া’ তেল। বোতলে থাকলেও আত্মা থাকে না।” এই ‘উবে যাওয়া’ তেলের রহস্য শুধু ক্রেতাকে বিভ্রান্ত করার একটি কৌশল মাত্র। তেলের ঘনত্বের পার্থক্য বা বোতল থেকে কিছুটা তেল ফেলে দেওয়ার মতো সাধারণ কারসাজিই এর পেছনে কাজ করে। এমনকি কেউ কেউ তো তেলের বোতলের ঢাকনাতেই লিখে রাখে: “১ লিটার না হলেও, মন ভরবে।” এটা যেন উপহাসের চূড়ান্ত পর্যায়! তারা ক্রেতাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এবং সরলতাকে পুঁজি করে প্রতারণা চালিয়ে যায়।
মুদি দোকানে গিয়েছেন ডাল কিনতে। আপনি বললেন, “ভাই, এক কেজি মসুর ডাল দেন।” দোকানি হাত ঘুরিয়ে পাল্লায় কিছু ঢাললেন, তারপর ছিটকে বললেন, “এইডা এক কেজির চাইতেও একটু বেশি হইছে!” আপনি কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন, ভাবলেন যাক, এবার অন্তত কম দিল না। কিন্তু বাসায় এসে মেপে দেখলেন ৮৮০ গ্রাম! আসলে ওজনপুরে এক কেজির মানদণ্ড একটাই যতটুকু দিলে ক্রেতা চুপ থাকে, সেটাই এক কেজি! এই এক কেজির সংজ্ঞা প্রতিটি অসাধু ব্যবসায়ীর কাছে আলাদা, যা তাদের ব্যক্তিগত লাভের হিসাবের উপর নির্ভর করে। তারা জানে, সাধারণ ক্রেতারা সব সময় দোকানে গিয়ে ওজন মেপে দেখার সুযোগ পান না, আর এই সুযোগটাই তারা কাজে লাগায়।
শহর থেকে দূরে, গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলোও কিন্তু এই ‘কম-গ্রাম’ ভাইরাসের শিকার। গ্রামের হাটে বা ছোট মুদির দোকানে প্রতারণার ধরন কিছুটা ভিন্ন, কিন্তু ফলাফল একই।
ধরা যাক, আমাদের রহিম চাচা। তিনি গ্রামের একজন পুরনো চাল ব্যবসায়ী। বহু বছর ধরে তিনি সততার সাথে চাল বিক্রি করে আসছেন। কিন্তু আজকাল গ্রামের বড় ব্যবসায়ীরা এবং শহরের মিল মালিকরা তার থেকে চাল কেনার সময় ওজনে কম দেয়। তাদের প্রভাবশালী হওয়ায় রহিম চাচা কিছু বলতে পারেন না। বাধ্য হয়ে যখন তিনি নিজেই গ্রামের মানুষের কাছে চাল বিক্রি করেন, তখন দেখা যায়, লাভ টিকিয়ে রাখতে তিনিও অজান্তেই সামান্য কম দিয়ে ফেলছেন। এটি যেন একটি দুষ্টচক্র, যেখানে একজন ঠকছে বলে অন্যজনকেও ঠকাতে হচ্ছে। গ্রামের হাটে রহিম চাচার মতো অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আছেন, যারা পরিস্থিতির শিকার হয়ে এই অনিয়মের অংশ হয়ে যাচ্ছেন। তাদের মনে হয়, "আমি একা সৎ থেকে কী করব, যখন সবাই ঠকাচ্ছে?"
করিম, গ্রামের একজন ছোট ফল বিক্রেতা। সে নিজেই প্রতিদিন ভোরে শহর থেকে ফল এনে গ্রামে বিক্রি করে। শহরে পাইকারি বাজারে সে নিয়মিতভাবে ঠকে আসে। আপেল বা কমলা কেনার সময় তাকে ১ কেজির নামে ৯০০ গ্রাম দেওয়া হয়। এই ঘাটতি পূরণ করতে গিয়ে করিমও গ্রামের মানুষদের কাছে সামান্য কম দিয়ে বসে। গ্রামের হাটে করিমের মতো অনেকেই আছেন যারা মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে ঠকে এসে, সেই ক্ষতিটুকু পুষিয়ে নিতে গিয়ে গ্রামের সাধারণ মানুষকে ঠকাচ্ছেন। এতে দেখা যায়, এই ‘কম-গ্রাম’ ভাইরাসের শেকড় কতটা গভীর।
গ্রামের কিছু সচেতন গৃহিণী কিন্তু এই ওজনে কম দেওয়ার বিরুদ্ধে নীরব লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। জমিলা খালা, যিনি গ্রামের হাট থেকে নিয়মিত বাজার করেন, তিনি সব সময় হাতে একটি ছোট ডিজিটাল ওজন পরিমাপক যন্ত্র রাখেন। তিনি সব দোকানে ওজন পরীক্ষা করেন এবং কম হলে সরাসরি বিক্রেতাকে বলেন। প্রথম দিকে বিক্রেতারা বিরক্ত হলেও, জমিলা খালার মতো কয়েকজন সচেতন ক্রেতার কারণে অনেক দোকানে এখন সঠিক ওজন দেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। এটি এক ধরনের নীরব প্রতিবাদ, যেখানে ব্যক্তিগত সচেতনতা সমষ্টিগত পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে। তবে এটি একটি ধীর প্রক্রিয়া, যার জন্য প্রয়োজন আরও অনেক মানুষের সচেতনতা।
আজও কিছু মানুষ আছে যারা এই ‘কম-গ্রাম’ ব্যাধির প্রতিরোধক হয়ে বেঁচে আছেন। তারা এখনো এক কেজিকে এক কেজিই ভাবে, এক লিটারকে এক লিটারই বিশ্বাস করে। তারা যখন বাজারে যায়, তখন অসৎ ব্যবসায়ীদের কাছে স্পষ্ট করেই বলেই ওঠে "ভাই, দেইখা নেন, কম যেন না হয়।" তাদের এই সোজাসাপ্টা কথাগুলো যেন ওজন হরণকারীদের নৈতিক মেরুদণ্ডকে চ্যালেঞ্জ করে। তারা ওজনপুরের সেই সৎ মানুষের উত্তরসূরি। তারা হয়তো সংখ্যায় কম, কিন্তু তারা জানে ওজনের বিচার শুধু দুনিয়াতে নয়, আখিরাতে হবে। তারা বিশ্বাস করে, প্রতিটি কম-গ্রামের জন্য আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে, আর এই বিশ্বাসই তাদের সততার পথে অটল রাখে।
এই উত্তরসূরিরা কেবল নিজেদের জন্য সৎ নন, বরং তারা অন্যদের জন্যও অনুপ্রেরণা। যখন একজন ক্রেতা দেখেন যে একজন ব্যবসায়ী তার পণ্যের সঠিক ওজন দিচ্ছে, তখন তাদের মধ্যে একটি নতুন বিশ্বাস জন্ম নেয়। এই বিশ্বাসই পারে ধীরে ধীরে ‘কম-গ্রাম’ ভাইরাসকে নির্মূল করতে এবং ওজনপুরের সেই সোনালী ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে। যেমন, গ্রামের বাজারে সাকুর চায়ের দোকান। সে চায়ে কম দুধ বা চিনি দেয় না। বরং, গ্রাহকদের মুখে তার দোকানের সুনাম শুনে তার দোকানে সব সময় ভীড় লেগে থাকে। তার এই সততা অন্য দোকানদারদেরও সঠিক পথে আসতে উৎসাহিত করে।
ওজনে কম দেওয়া কেবল একটি অর্থনৈতিক অনিয়ম নয়, এটি একটি গভীর আধ্যাত্মিক ও নৈতিক ব্যাধি। এটি সমাজের ভিত্তি দুর্বল করে দেয়, মানুষের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা নষ্ট করে, এবং সততাকে উপহাসের পাত্র বানিয়ে দেয়। যখন একজন ক্রেতা বারবার ঠকে যায়, তখন তার মনে হতাশা জন্ম নেয়। সে বুঝতে পারে না কার কাছে সুবিচার চাইবে, আর কিভাবে এই অনিয়মের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। এই নীরব বঞ্চনা ধীরে ধীরে সমাজের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে পড়ে, যা এক অদৃশ্য দারিদ্র্য তৈরি করে।
অজুহাতের সংস্কৃতি: “ডিজিটাল পাল্লা একটু কম দেখায়”, “শুকিয়ে গেছে”, “প্যাকেটের ওজন ধরা”এ রকম কথায় আমরা চুপ করে যাই।
অদক্ষতা ও অভ্যাস: পাতিলে রাখার থালা, প্লাস্টিক ব্যাগ, বরফ-জলসব মিলিয়ে ওজন বাড়ে বা কমে। “ট্যার” বোতাম না চাপলে ব্যাগের ওজন বাদই পড়ে না।
প্রতিযোগিতার চাপ: মুনাফা সামান্য, ভিড়ের বাজারে “কম দিয়ে বেশি লাভ”এই ভুল সমীকরণ দ্রুত ছড়ায়।
যন্ত্রের ত্রুটি ও কুমন্ত্রণা: ডিজিটাল পাল্লা বা ফুয়েল ডিসপেন্সার ইচ্ছাকৃতভাবে ছেঁড়াছেঁড়িখবরের কাগজে এমন অভিযানের রিপোর্ট আছে। উদাহরণ হিসেবে, বিএসটিআই কিছু পেট্রল পাম্প ও দোকানের বিরুদ্ধে ওজনে কারচুপির মামলা করেছেযা দেখায়, এই ব্যাধি কল্পকাহিনি নয়, বাস্তব।
বাংলাদেশে ভোক্তার অধিকার সুরক্ষায় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ কার্যকর। এই আইনে স্পষ্ট বলা আছেওজন বা পরিমাপে কম দিয়ে পণ্য বিক্রি করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দণ্ড হতে পারে অনধিক ১ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ড।
অভিযোগ করার নিয়মও নির্দিষ্ট: সাধারণত ঘটনার ৩০ দিনের মধ্যে অভিযোগ করতে হয়। অভিযোগ প্রমাণিত হলে যে জরিমানা আদায় হয়, তার ২৫ শতাংশ অভিযোগকারীকে দেওয়া হয়এটা আইনে বিধিবদ্ধ। অর্থাৎ আপনি যদি সাহস করে অভিযোগ করেন, ন্যায়বিচারের সঙ্গে সামান্য আর্থিক প্রাপ্তিও আপনার অধিকার।
অভিযোগ জানাতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের হটলাইন ১৬১২১এখানে ফোন করে সরাসরি জানানো যায়। অনেক ক্ষেত্রে ভোক্তারা অভিযোগ করে ক্ষতিপূরণ পেয়েছেনবিভিন্ন গণমাধ্যমেও এর উদাহরণ আছে।
বাংলাদেশে ওজন-পরিমাপের মানদণ্ড তদারকির দায়িত্ব বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)-এর। ওজন ও পরিমাপ মানদণ্ড আইন, ২০১৮ অনুযায়ী আন্তর্জাতিক একক পদ্ধতি বাধ্যতামূলক; ওজন বা পরিমাপযন্ত্রকে নির্দিষ্ট সময় পরপর বিএসটিআই-সংশ্লিষ্ট যাচাই ও সিলমোহর (স্ট্যাম্প) নিতে হয়। আনস্ট্যাম্পড যন্ত্র বাণিজ্যে ব্যবহার আইনত দণ্ডনীয়।
মোড়কজাত পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে প্যাকেজড কমোডিটি বিধিমালা, ২০২১ মোতাবেক মোড়কে নিট পরিমাণ, উৎপাদক বা আমদানিকারকের ঠিকানা, উৎপাদন/মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ ইত্যাদি ছাপানো বাধ্যতামূলক। বাজারে অনেক পণ্যের মোড়কে নীট পরিমাপের পাশে ছোট ‘b’ চিহ্ন দেখা যায়এটি বিএসটিআই-অনুমোদিত মোড়কজাতকরণের নির্দেশক হিসেবে প্রচলিত।
আরও একটি কাজে লাগার বিষয়বিএসটিআই লাইসেন্স/সার্টিফিকেট অনলাইনে ভেরিফাই করা যায়। কোনও প্রতিষ্ঠানের বিএসটিআই সনদের কিউআর কোড স্ক্যান করে বা নম্বর দিয়ে যাচাই করলে বোঝা যায় নকল নাকি আসল।
বিএসটিআই’র অভিযানে তেল-জল মেশানো, স্কেলে কারচুপি, পাম্পে কম তেল দেওয়াএসব অপরাধে মামলা/জরিমানার নজিরও রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে জ্বালানি স্টেশনের ডিসপেন্সার বা দোকানের স্কেল ‘টেম্পার’ করায় জরিমানা/মামলা হয়েছে।
শহরে সুপারশপে বারকোড, ডিজিটাল পাল্লা, বিল-স্লিপসব আছে; তবু ব্যস্ততার ভিড়ে অনেকেই নেট ওজন, ট্যার, এমআরপি ঠিকমতো খেয়াল করেন না। ফল-মাছ-মাংস কাউন্টারে প্লাস্টিক ট্রে বা বরফের পানি উঠলে ট্যার না দিলে সেগুলোর ওজনও ভোক্তার ঘাড়ে পড়ে।
গ্রামেহাটের দিন “এক কেজি” কথাটা অনেক সময় হাতের মুঠোর আন্দাজে ঠিক হয়। পুরোনো অভ্যাসে “সের” বা “পাওয়া” শব্দ চললেও, আইন কেবল কেজি/গ্রাম/লিটারকেই স্বীকৃতি দেয়। অনেক গ্রামীণ দোকানদার অজান্তেই পুরোনো পাল্লা বা যাচাইহীন দণ্ড ব্যবহার করেনএগুলো আইনসম্মত নয়।
“ট্যার” চাই: খোলা ডাল-চাল, মাছ-মাংস তোলার আগে প্লাস্টিক ব্যাগ/ট্রে পাল্লায় রেখে ট্যার করতে বলুনঅর্থাৎ মোড়কের ওজন যেন বাদ যায়। সুপারশপ হলেও বলবেনএটি আপনার অধিকার।
পুনর্মাপের অভ্যাস: দোকান থেকে বেরোনোর আগে পাশের ‘ভেরিফাই পাল্লা’ (অনেক সুপারশপে থাকে) বা পাশের বিশ্বস্ত দোকানে মিলিয়ে দেখুন। কম পেলে সঙ্গে সঙ্গে কথা বলুন।
মোড়কে নীট পরিমাণ পড়ুন: প্যাকেটজাত পণ্যে “নিট” কত লেখাখেয়াল রাখুন। নীট মানে কেবল পণ্যের ওজন; প্যাকেটের নয়। সন্দেহ হলে স্কিলে মেপে নিন।
সিলমোহর দেখুন: দোকানের পাল্লায় বিএসটিআইয়ের যাচাই-স্ট্যাম্প/স্টিকার আছে কি না লক্ষ্য করুন। না থাকলে প্রশ্ন তুলুন“এই পাল্লা শেষ কবে যাচাই হয়েছে?”
জ্বালানি নিলে নজর দিন: ফুয়েল স্টেশনে নির্দিষ্ট পরিমাপ (যেমন ৫ লিটার) দিয়ে ‘ডিসপেন্সার টেস্ট’ দেখতে চাইতে পারেনঅনেক স্টেশনের কাছে মানদণ্ড ক্যান থাকে। সন্দেহ হলে অভিযোগ করুন।
বিল-স্লিপ রাখুন: বিল, রসিদ, পণ্যের মোড়কসব প্রমাণ সংরক্ষণ করুন। অভিযোগ করতে এগুলোই আপনার ঢাল-তলোয়ার।
অভিযোগ করতে দ্বিধা করবেন না: ৩০ দিনের মধ্যে অভিযোগযোগ্য ঘটনা হলে ফোন করুন ১৬১২১ (ভোক্তা অধিকার), প্রয়োজনে ১৬১১৯ (বিএসটিআই) নম্বরে তথ্য দিন। অভিযোগ প্রমাণিত হলে যে জরিমানা আদায় হবে, তার ২৫ শতাংশ আপনার পাওনাআইন তাই বলে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর অভিযোগ পেলে অভিযান চালায়, জরিমানা করে এবং প্রমাণিত অভিযোগকারীকে জরিমানার ২৫ শতাংশ প্রদান করেএ নিয়ে সরকারি ও গণমাধ্যমের নথিপত্র রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে অভিযানে উল্লেখযোগ্য অঙ্কের জরিমানা আদায় হয়েছে এবং অনেক ভোক্তা আর্থিক প্রাপ্তিও পেয়েছেনএমন খবর প্রকাশিত হয়েছে।
আমরা অভিযোগ করিঠিকই। কিন্তু মনে রাখতে হয়, বিক্রেতারাও আমাদের সমাজের অংশ। সঠিক প্রশিক্ষণ, যাচাই করা যন্ত্র, নিয়মিত সচেতনতাএসব পেলে অধিকাংশই ঠিক থাকতে চায়। তাই
বাজার সমিতি প্রতি তিন মাসে একবার “পাল্লা-যাচাই দিবস” করতে পারেসব দোকান নিজেদের পাল্লা নিয়ে এসে একসঙ্গে চেক করাবে।
ইউনিয়ন পরিষদ/পৌরসভা একটি কমিউনিটি-ওজন স্টেশন বসাতে পারেযেখানে ক্রেতা বিনা খরচে পুনর্মাপ করতে পারবেন।
হাটে ঘোষণাপত্র: মাইকিং করে জানানো“ওজনে কারচুপি শাস্তিযোগ্য অপরাধ; অভিযোগ ফোন: ১৬১২১”দ্রুতই আচরণ বদলায়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছোটদের জন্য “ওজন-পরিমাপ সচেতনতা” ক্লাসযাতে ভবিষ্যৎ ক্রেতা-ব্যবসায়ী দুই পক্ষই সৎ অভ্যাস গড়ে তোলে।
ওজনে/পরিমাপে কম দিলে শাস্তি: অনধিক ১ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, বা উভয় দণ্ড।
অভিযোগের সময়সীমা: সাধারণত ৩০ দিনের মধ্যে অভিযোগ।
অভিযোগকারীর পুরস্কার: প্রমাণিত হলে আদায়কৃত জরিমানার ২৫% অভিযোগকারীকে।
কোন একক চলবে: কেবল কিলোগ্রাম/গ্রাম/লিটারসহ আন্তর্জাতিক একক পদ্ধতি; পুরোনো একক ব্যবহার চলবে না।
যন্ত্রের যাচাই বাধ্যতামূলক: ওজন/পরিমাপ যন্ত্র বিএসটিআই দ্বারা যাচাই ও স্ট্যাম্পযুক্ত হতে হবে; আনস্ট্যাম্পড যন্ত্র বাণিজ্যে বেআইনি।
মোড়কে কী থাকবে: নিট পরিমাণ, উৎপাদক/আমদানিকারকের তথ্য, প্রয়োজনীয় ঘোষণাপ্যাকেজড কমোডিটি বিধিমালা, ২০২১ অনুসারে।
এক তরুণ দুধের প্যাক নিলেননীট ১ লিটার। বাড়ি ফেরার আগে দোকানের ভেরিফাই পাল্লায় ওজন মেপে দেখলেন ঠিক আছে। অভ্যাসটা সহজকিন্তু বাজারে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে খুবই কার্যকর।
মাছ বিক্রেতা বরফসহ মাছ তোলেন। ক্রেতা বিনয়ের সঙ্গে বলেন“ভাই, বরফ-ট্রে রেখে ট্যার দিয়ে নিন।” বিক্রেতা হাসিমুখে ট্যার দিলেন। কারও ক্ষতি হলো নাবরং বিশ্বাস বাড়ল।
মোটরসাইকেলে তেল নিতে গিয়ে ৫ লিটার “টেস্ট ক্যান” দিয়ে দেখলেন পরিমাপ ঠিক। সন্দেহ হলে কিন্তু আপনি সঙ্গে সঙ্গে বলতে পারেন“আমি ভোক্তা অধিকার ১৬১২১-এ ফোন করব”এই বাক্যটুকুই অনেক সময় যথেষ্ট।
চোখ খোলা রাখুন: নীট পরিমাণ, এমআরপি, মেয়াদসব পড়ুন।
প্রতি ক্রয়ে স্বচ্ছতা চান: ট্যার, পুনর্মাপ, সিলমোহরএসব চাইতে সংকোচ করবেন না।
প্রমাণ রাখুন: একখানা ছবি, রসিদের কপিঅভিযোগের প্রাণ।
অভিযোগ করুন: ১৬১২১ নম্বরে ফোন, অনলাইন অভিযোগ, কিংবা জেলা অফিসে লিখিত আবেদনসবই চলবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে ২৫% আপনারএটা জানুন, অনেকে জানে না।
বিএসটিআই সনদ যাচাই করুন: কিউআর কোড স্ক্যান করে সার্টিফিকেট সত্যি কি না মিলিয়ে নিন।
আমরা প্রায়শই কেবল আর্থিক ক্ষতির দিকটি দেখি, কিন্তু এর মানসিক ও সামাজিক প্রভাব অনেক গভীর। যখন একজন ব্যক্তি তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হয়, তখন তার মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ এবং বিতৃষ্ণা জন্ম নেয়। এই বিতৃষ্ণা সময়ের সাথে সাথে সামাজিক অস্থিরতা এবং আস্থাহীনতার জন্ম দেয়। এটি একটি চক্রের মতো, যেখানে অসততা আরও অসততাকে উৎসাহিত করে। সমাজের প্রতিটি সম্পর্ক, প্রতিটি লেনদেন যখন সন্দেহের চোখে দেখা হয়, তখন মানব সম্পর্কের ভিত দুর্বল হয়ে পড়ে। এটি শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, সামাজিক ও নৈতিক কাঠামোকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে।
এই ব্যাধি প্রতিরোধের একমাত্র উপায়নিজের বিবেক জাগ্রত রাখা, আসমানের ফেরেশতার হিসেব মনে রাখা, এবং সাহস করে সত্যের পাল্লা ভারী করা। আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি কেনাবেচায় সততার প্রতি অবিচল থাকতে হবে। শুধু বিক্রেতা নয়, ক্রেতা হিসেবেও আমাদের সচেতন হতে হবে। পণ্যের ওজন সঠিক আছে কিনা তা পরীক্ষা করতে হবে, প্রয়োজনে প্রতিবাদ করতে হবে। আমরা যদি এই অনিয়মের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে রুখে দাঁড়াই, তবেই হয়তো পরিবর্তন সম্ভব।
সরকারের দায়িত্ব হলো ভোক্তা অধিকার রক্ষা করা এবং আইন প্রয়োগের মাধ্যমে অসাধু ব্যবসায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করা। নিয়মিত বাজার মনিটরিং, ডিজিটাল মাপযন্ত্রের যাচাই-বাছাই এবং কঠোর শাস্তির বিধান এই সমস্যা সমাধানে অপরিহার্য। পাশাপাশি, ধর্মীয় ও সামাজিক সংগঠনগুলোরও উচিত মানুষকে সততার গুরুত্ব বোঝানো এবং ওজনে কম দেওয়ার নৈতিক ও আধ্যাত্মিক ক্ষতি সম্পর্কে সচেতন করা।
কিন্তু শুধুমাত্র আইন দিয়ে এই ব্যাধির পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক মূল্যবোধের জাগরণ। যদি প্রতিটি ব্যক্তি নিজের জায়গা থেকে সৎ থাকে এবং অসততাকে প্রত্যাখ্যান করে, এমনকি সামান্য লাভের আশায়ও নিজের বিবেককে বিক্রি না করে, তবেই সম্ভব একটি সুন্দর ও ন্যায্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। সৎ ব্যবসায়ীদের সমর্থন করুন এবং তাদের কাছ থেকে কেনাকাটা করুন, এমনকি যদি তাতে সামান্য বেশি খরচও হয়। আপনার এই সিদ্ধান্তই অন্যদের সৎ হতে উৎসাহিত করবে।
তাহলে হয়তো একদিন ওজনপুর আবার ফিরে আসবে, বাস্তবের বাংলাদেশে। যেখানে প্রতিটি লেনদেনে সততা থাকবে, প্রতিটি পাল্লায় সত্যের জয় হবে। আসুন, আমরা সকলে মিলে সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিই, যেখানে ওজনের পাল্লা একটাই জিনিস যেটা সবসময় সঠিক দিকেই ঝুঁকে থাকে!
কম-গ্রাম, ওজন কমানো প্রতারণা, বাংলাদেশ বাজার, ন্যায্য ওজন, ক্রেতা সচেতনতা, সৎ ব্যবসা।
📢 এই দেশে ওজনের পাল্লা একটাই জিনিস যেটা সবসময় অন্য দিকেই ঝুঁকে থাকে!

🌸 আপনার মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ!
আপনার মতামত আমাদের অনুপ্রাণিত করে এবং আগামীতে আরও মানসম্পন্ন কনটেন্ট তৈরিতে সহায়তা করে।
আপনি যদি কোনো নির্দিষ্ট বিষয় বা গল্প পছন্দ করে থাকেন, জানালে ভালো লাগবে।
নিয়মিত পাশে থাকুন — আপনার সহযোগিতা ও ভালোবাসাই আমাদের এগিয়ে চলার শক্তি।
শুভ কামনায়,
✍️ কল্পকথা-৩৬০ ব্লগ টিম
https://kalpakatha360.blogspot.com